ড. ইউনূস-তারেক রহমান বৈঠক: সুড়ঙ্গের শেষে আলোর দেখা মিলবে কি?
প্রকাশ: ১২ জুন ২০২৫, ০৮:৪৯ পিএম
ড. ইউনূস-তারেক রহমান। ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বহুল প্রত্যাশিত ও আলোচিত বৈঠকটি কাল (১৩ জুন ২০২৫) সকালে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।দেশের উত্তাপময় রাজনীতি ও সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের সন্ধিক্ষণে লন্ডনে অনুষ্ঠেয় এই বৈঠকের গুরুত্ব যে অসীম, সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন কোটি কোটি মানুষ তাকিয়ে এই দুই নেতার বৈঠকের দিকে। জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনকে পর্যবেক্ষণে রাখা বিদেশি রাষ্ট্রগুলোও সরকার প্রধানের সঙ্গে বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের ফাংশনাল প্রধানের বৈঠককে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছেন। দেশের ক্রীয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলোও বৃহত্তম স্বার্থে বৈঠকের ইতিবাচক ফলাফল নিয়ে আশাবাদী।
দুই নেতার দেখা, ২ ঘণ্টার রুদ্ধদ্বার ওয়ান টু ওয়ান বৈঠকের আউটকাম কী হতে পারে— এটি নিয়ে ভবিষ্যদ্বানী করা সহজ কাজ নয়। ধারণা করা হচ্ছে-দুপক্ষেরই চাওয়া থাকবে দেশের স্থিতির জন্য রাজনৈতিক সমঝোতার পথ মসৃণ করা। কারণ দেশে ফ্যাসিবাদী শাসনের দীর্ঘ যাতাকালে দুজনকেই বহু মূল্য দিতে হয়েছে। একজন আশি বছর বয়সে দিনের পর দিন আদালতে ছুটে বেড়িয়েছেন, অন্যজন তো দেশেই আসতে পারেননি। একজন হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে থেকে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের নেপথ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছেন। অন্যজন হাসিনা পলায়নের পর জাতির ক্রান্তিলগ্নে শক্ত হাতে হাল ধরেছেন, নিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানের দায়িত্ব। দুজনের দৃঢ়তা-প্রতিজ্ঞা ও মিল-তাল দেখে অনেকের মনে প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে—ইউনূস তারেক বৈঠকের মধ্য দিয়ে সুড়ঙ্গের শেষে আলোর দেখা মিলবে কি?
ধারণা করা হচ্ছে-দুপক্ষেরই চাওয়া থাকবে দেশের স্থিতির জন্য রাজনৈতিক সমঝোতার পথ মসৃণ করা। কারণ দেশে ফ্যাসিবাদী শাসনের দীর্ঘ যাতাকালে দুজনকেই বহু মূল্য দিতে হয়েছে।একজন আশি বছর বয়সে দিনের পর দিন আদালতে ছুটে বেড়িয়েছেন, অন্যজন তো দেশেই আসতে পারেননি। একজন হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে থেকে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের নেপথ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছেন। অন্যজন হাসিনা পলায়নের পর জাতির ক্রান্তিলগ্নে শক্ত হাতে হাল ধরেছেন, নিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানের দায়িত্ব।
ইউনূস-তারেক বৈঠকে ভোটের দিনক্ষণ, জুলাইর আন্দোলনে নির্মমতা চালানোর নির্দেশদাতা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার আসামিদের বিচার, গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার, জুলাই সনদসহ নানা ইস্যুতে আলোচনা হতে পারে। যদিও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে বলা হয়েছে-এ বৈঠকের কোনো ধার্য বিষয় নেই। সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে কী বোঝাপড়া হয়, তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা আলোচনা চলছে। তবে এই আলোচনায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাবে নির্বাচনি রোডম্যাপ।
প্রধান উপদেষ্টা ঈদুল আজহার আগের দিন ৬ জুলাই জাতির উদ্দেশে দেওয়া বক্তৃতায় ঘোষণা দেন যে, আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন হবে। বিএনপি এর কড়া প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। দলটি ডিসেম্বরেই নির্বাচনের দাবিতে অনড়। মে মাসে ঢাকায় এক জনসভায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান জোর দিয়ে বলেন, ডিসেম্বরেই নির্বাচন হতে হবে। দলের শীর্ষ নেতার বক্তব্যই বিএনপির অবস্থান। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দেশকে রাজনৈতিক সমঝোতার দিকে এগিয়ে নিতে হলে অধ্যাপক ইউনূস ও তারেক রহমান দুজনকেই তাদের অবস্থান থেকে সরে আসতে হতে পারে।
সরকার ডিসেম্বরের মধ্যে না পারলে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতেও যদি নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করে, সেটা বিএনপির জন্য মানা সহজ। আর এতে জরুরি সংস্কারও সম্পন্ন করা সম্ভব। বাকি সংস্কার নির্বাচিত সরকার এসে করবে।
সরকার ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে, জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ রেকর্ড করার আগপর্যন্ত সরকারঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ও উপদেষ্টা পরিষদের কেউ কেউ ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করতে প্রধান উপদেষ্টাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা এপ্রিলেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে অনড়। অন্যদিকে বিএনপি বলছে এপ্রিল মাস ভোটের উপযোগী নয়। কারণ, এপ্রিল মাসে নির্বাচনের যে সম্ভাব্য সময় নির্ধারণ করা হয়েছে, সেই সময়ে একদিকে প্রচণ্ড গরম আবহাওয়া থাকে, ঝড়বৃষ্টির আশঙ্কাও থাকে। তার আগে রোজা ও ঈদুল ফিতর। এরপর মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষা আছে। ওই সময় ভোট করতে গেলে রমজান মাসেও নির্বাচনি প্রচার চালাতে হবে। যেটি অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ও ব্যয় সাপেক্ষ। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল তো বলেই দিয়েছেন যে, আমরা আশা করছি, বাস্তবতার প্রেক্ষিতে সরকার এটা বিবেচনা করবেন। সময়টা তো ঠিক না। রোজার মাস, ঈদ শেষ হবে– তার কয়েকদিন পরেই নির্বাচন। রোজার সময় নির্বাচনি প্রচারণা চালাতে প্রার্থী ও রাজনৈতিক কর্মীদের দুর্ভোগ হবে। আমি তো এখন থেকেই উদ্বিগ্ন যে আমাকে প্রতিদিনই ইফতার পার্টি করতে হবে। এতে নির্বাচনের ব্যয়টাও দ্বিগুণ হয়ে যাবে। গরমে দিনের বেলায় জনসভায় লোকজন কীভাবে আসবে। রাত্রে গিয়ে মিটিং করতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকার এপ্রিলে নির্বাচন ঘোষণার পেছনে বড় যুক্তি হচ্ছে—এই সময়টুকু না পেলে জরুরি সংস্কার কাজগুলো করা সম্ভব হবে না। সেক্ষেত্রে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের যে উদ্দেশ্য ও আকাঙক্ষা সেটি ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে।
এ বছরের ডিসেম্বরেই নির্বাচন হওয়া সম্ভব এবং সেটা সবচেয়ে উপযুক্ত হবে। এমতাবস্থায় বিএনপি কি ডিসেম্বরে নির্বাচনের বিষয়ে তাদের অনড় অবস্থান থেকে সরে আসবে? ড. ইউনূস-তারেক রহমানের আলোচনার বার্গেনিং পয়েন্ট এটিই হতে পারে।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা মনে করেন, এ বছরের ডিসেম্বরেই নির্বাচন হওয়া সম্ভব এবং সেটা সবচেয়ে উপযুক্ত হবে। এমতাবস্থায় বিএনপি কি ডিসেম্বরে নির্বাচনের বিষয়ে তাদের অনড় অবস্থান থেকে সরে আসবে? ড. ইউনূস-তারেক রহমানের আলোচনার বার্গেনিং পয়েন্ট এটিই হতে পারে।
তবে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীল নেতাদের কথায় এই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে, সরকার ডিসেম্বরের মধ্যে না পারলে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতেও যদি নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করে, সেটা বিএনপির জন্য মানা সহজ। আর এতে জরুরি সংস্কারও সম্পন্ন করা সম্ভব। বাকি সংস্কার নির্বাচিত সরকার এসে করবে। জানা গেছে, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া যিনি যৌক্তিক রাজনৈতিক সমঝোতার মধ্য দিয়ে দেশের স্থিতি আনয়নে দীর্ঘ ত্যাগ স্বীকার করেছেন তিনিও মনে করেন, ডিসেম্বরে সম্ভব না হলে ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত সময়।
কালকের বৈঠকে অধ্যাপক ইউনূস ও তারেক রহমান যদি জানুয়ারি কিংবা ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের বিষয়ে একমত হন তবে সেটি দুপক্ষের জন্যই উইন-উইন সিচুয়েশন হবে। সংকটও কেটে যাবে।
এই বৈঠকটিকে মোড় ঘোরানো বড় রাজনৈতিক ঘটনা আখ্যা দিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, সাম্প্রতিককালের রাজনৈতিক যে প্রেক্ষাপট, যে অবস্থান এটা (বৈঠকটি) একটা বড় ইভেন্ট। যদি সব কিছু সঠিকভাবে চলে, তাহলে নিঃসন্দেহে এটা একটা বড় টার্নিং পয়েন্ট হতে পারে। এই মিটিংটা হলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যেতে পারে এবং অনেক কিছু সহজ হয়ে যেতে পারে, নতুন ডাইমেনশন সৃষ্টি হতে পারে…সম্ভাবনা অনেক। এখন এটা নির্ভর করবে আমাদের নেতাদের (মুহাম্মদ ইউনূস-তারেক রহমান) ওপর, তারা কীভাবে সেই সম্ভাবনার দিকে নিয়ে যাবেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও অধ্যাপক ইউনূস ও তারেক রহমান বৈঠকটিকে একটি মাইলফলক মনে করছেন। তারা বলছেন, গত কয়েক মাসে নানা ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে বিএনপির যে সম্পর্কের তিক্ততা তৈরি হয়েছে সেটি কাটতে পারে এই বৈঠকের মাধ্যমে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক কাজী মারুফুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, বর্তমানে সরকারের সঙ্গে বিএনপির যে আস্থার সংকট চলছে সেটা নিরসন হওয়া দরকার। সেটা দলের চেয়ে দেশের স্বার্থেই বেশি প্রয়োজন।
ড. ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠক নির্বাচনি টাইমফ্রেমকেন্দ্রিকই হওয়া উচিত হবে না। দূরদৃষ্টি সম্পন্ন এই দুই নেতার বৈঠকে ভবিষ্যত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের রূপরেখা কী হবে সেটি নিয়ে বিশদ আলোচনা হওয়া দরকার। বিশেষ করে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের পর একটি গণতান্ত্রিক সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর বাংলাদেশকে একটি ওয়েলফেরার স্টেটে পরিণত করতে কী করতে হবে সেটির রূপরেখা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। ভবিষ্যতে যেন স্বৈরতন্ত্র কায়েম না হয় সেজন্য রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করার প্রতিজ্ঞা এই বৈঠকের পর উচ্চারিত হবে এমন আশা তো করাই যায়। স্বৈরাচারবিরোধী ও দীর্ঘ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যারা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন, যারা নানাভাবে অবদান রেখেছেন তারা যেন ভবিষ্যতে বিস্মৃতির অন্তরালে হারিয়ে না যান সেই বন্দোবস্তও করা দরকার।
তবে ড. ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠক নির্বাচনি টাইমফ্রেমকেন্দ্রিকই হওয়া উচিত হবে না। দূরদৃষ্টি সম্পন্ন এই দুই নেতার বৈঠকে ভবিষ্যত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের রূপরেখা কী হবে সেটি নিয়ে বিশদ আলোচনা হওয়া দরকার। বিশেষ করে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের পর একটি গণতান্ত্রিক সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর বাংলাদেশকে একটি ওয়েলফেরার স্টেটে পরিণত করতে কী করতে হবে সেটির রূপরেখা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। ভবিষ্যতে যেন স্বৈরতন্ত্র কায়েম না হয় সেজন্য রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করার প্রতিজ্ঞা এই বৈঠকের পর উচ্চারিত হবে এমন আশা তো করাই যায়। স্বৈরাচারবিরোধী ও দীর্ঘ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যারা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন, যারা নানাভাবে অবদান রেখেছেন তারা যেন ভবিষ্যতে বিস্মৃতির অন্তরালে হারিয়ে না যান সেই বন্দোবস্তও করা দরকার।
লেখক: সাংবাদিক ও লেখক।

