Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

জুলাই সনদ নিয়ে অসন্তুষ্টি : জামায়াত ও এনসিপি কতদূর যাবে

Icon

মোবায়েদুর রহমান

প্রকাশ: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

জুলাই সনদ নিয়ে অসন্তুষ্টি : জামায়াত ও এনসিপি কতদূর যাবে

ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে : ‘If wishes were horses, beggars would ride’. অনুবাদ : মানুষের ইচ্ছাগুলো যদি ঘোড়া হতো, তাহলে ভিক্ষুকরাও ঘোড়ায় চড়ত। এটি অন্তত ৪০০ বছর আগের প্রবাদ। কিন্তু আক্ষরিক অর্থ বাদ দিলে সমাজ ও রাজনীতির ব্যাপক পরিসরে এ প্রবাদটি আজও প্রযোজ্য। ৩১ আগস্ট প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দল বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং এনসিপির সঙ্গে আলাদা আলাদা বৈঠকে ড. ইউনূস ভালো নির্বাচন সম্পর্কে যে গভীর আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, সেই আশাবাদ শুনে ওই প্রাচীন প্রবাদবাক্যটির কথা মনে পড়ল।

প্রধান তিনটি দল ছাড়াও ২ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা হেফাজতে ইসলাম, নাগরিক ঐক্য, এবি পার্টিসহ সাতটি দলের সঙ্গে বৈঠকেও একইরকম উক্তি করেন। এসব বৈঠকে তিনি বলেন, ‘ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কেউ যদি নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নিয়ে ভাবে, সেটি হবে জাতির জন্য গভীর বিপজ্জনক।’ প্রধান উপদেষ্টা আরও আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচন পৃথিবীর একটি শ্রেষ্ঠ নির্বাচন হবে। সব ভোটার ভোট দিতে যাবেন। এটি হবে একটি উৎসবমুখর নির্বাচন।

এ নির্বাচন একটি ভালো নির্বাচন হবে। হয়তো সেখানে কোনো কারচুপি থাকবে না। হয়তো ভোটার টার্নআউট সন্তোষজনক হতে পারে। কিন্তু তাই বলে কি আগামী নির্বাচন উৎসবমুখর হবে? নির্বাচনের সর্বাঙ্গীণ সাফল্য কামনা করেও ওই সংশয় প্রকাশ করতেই হচ্ছে। ৫ আগস্ট বিপ্লবের পর থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার দেশের তিনটি দলকে প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দল হিসাবে ট্রিট করছে। এ তিনটি দল হলো-বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি। আসন্ন নির্বাচন সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টা ৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে মধ্য ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এরপর আন্তর্জাতিক ফোরামে এবং দেশের মধ্যেও ওই নির্বাচনের কথা বলেছেন। 

ড. ইউনূসই প্রথম বলেছিলেন, জুলাই বিপ্লবের মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার, ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচারের বিচার ও নির্বাচন। জনগণের তরফ থেকে কোনো দাবি না উঠলেও ড. ইউনূসই প্রথম দফায় ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করেন। পরবর্তীকালে তিনি আরও পাঁচটি সংস্কার কমিটি গঠন করেন। মোট ১১টি সংস্কার কমিশন গঠিত হয়। এগুলো ছাড়াও ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে অর্থনীতিতে ১৫ বছরের দুর্নীতি ও লুণ্ঠন খুঁজে বের করার জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠন করেন। ওই টাস্কফোর্স কয়েক মাস খাটাখাটনি করে যে রিপোর্ট প্রণয়ন করেছে, তাতে দেখা যায়, শেখ হাসিনার আমলে ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়েছে। ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাংলাদেশের টাকায় অন্তত আড়াই লাখ কোটি টাকা হবে। এছাড়া খেলাপি ঋণ প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। ঘুস, দুর্নীতি, সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, এসব ক্ষেত্রে লাখ কোটি টাকার ওপর দুর্নীতি নয়, পুরোপুরি লুণ্ঠন হয়েছে। পাচার হওয়া আড়াই লাখ কোটি টাকা, লুণ্ঠন করা লাখ কোটি টাকা এবং খেলাপি ঋণ দেড় লাখ কোটি টাকা-প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকা নিয়ে ছিনিমিনি খেলার বিপরীতে গত ১৩ মাসে সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে, সেটি দেশবাসীকে এখনো জানানো হয়নি।

বিডিআর ম্যাসাকার নিয়ে বিপ্লবের পর কত তোলপাড় হলো। কত ইনভেস্টিগেটিভ অর্থাৎ অনুসন্ধানমূলক রিপোর্ট ও ইউটিউব ভিডিও ভাইরাল হলো। জনমতের চাপে বিডিআর ম্যাসাকার তদন্তের জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমানের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। এ কমিটি নির্ভীক ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করে যাচ্ছিল; কিন্তু হঠাৎ করে ওই তদন্ত শম্বুকের গতি প্রাপ্ত হয়েছে বলে বিভিন্ন মহল থেকে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ওই তদন্ত রিপোর্ট আদতেই দিনের আলোর মুখ দেখবে কি না, সেটি নিয়ে ওইসব মহল আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।

২.

শাপলা চত্বরে আলেম-ওলামাদের ম্যাসাকারের ব্যাপারে কোনো তদন্ত কমিটি গঠিত হয়নি কেন? কোনো দল বা ব্যক্তি আইসিটিতে মামলা করেছেন, সেটি তো ব্যক্তিগত বা দলীয় পর্যায়ে। কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি কেন? আর একথা কে না জানে, বিডিআর ম্যাসাকার এবং শাপলায় আলেম-ওলামাদের ম্যাসাকার ছিল শেখ হাসিনার জন্য টেস্ট কেস। এ দুটি টেস্ট কেসে তিনি সফল হন। তার দুটি হাতই রক্তরঞ্জিত হয় এবং এ রক্তক্ষয়ী অপারেশনের সাফল্য তাকে আরও বেশি করে কনফিডেন্ট করে তোলে। পরবর্তী বছরগুলোয় শেখ হাসিনা যে একজন সাইকোপ্যাথ ও ডাইনিরূপে আবির্ভূত হন, তার পাটাতন গড়ে দিয়েছে এ দুটি গণহত্যা। অথচ সেই দুটি গণহত্যা দৃষ্টির আড়ালে চলে যাচ্ছে। কেন? এসব তদন্তের উদ্যোগের প্রতি কোন বাজপাখি তার কালো থাবা বিস্তার করেছে?

যা হোক, ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হলেও ছয়টি সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে বিগত ছয় মাস রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ড. ইউনূসের তরফ থেকে ড. আলী রীয়াজ মাসের পর মাস বৈঠক করেছেন। এসব বৈঠকের নিট ফলাফল কী? দেশের সমগ্র শিক্ষিত সমাজের প্রধান আগ্রহ ছিল সংবিধান সংস্কারে। অন্যগুলো নিয়ে তাদের তেমন মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু সেই সংবিধান সংস্কারের কী হলো? সংবিধান সংস্কারের প্যাকেটে খুব বড় ধরনের সিল মারা হয়েছে। এখন সংবিধানে হাত দেওয়া যাবে না। পরবর্তী সংসদ যা করার করবে। তাই যদি হয়, তাহলে বিগত ছয় মাস ধরে সংবিধান সংস্কার কমিশন কী করল? ড. আলী রীয়াজ তো শুধু ঐকমত্য কমিশনের চেয়ারম্যানই নন, তিনি সংবিধান সংস্কার কমিটির চেয়ারম্যানও বটে।

ড. ইউনূস সেই ডে-ওয়ান থেকে বলে যাচ্ছেন ঐকমত্যের কথা। সব রাজনৈতিক দলের ঐক্যের কথা। সব রাজনৈতিক দল তো পরের কথা, যাদের তিনি প্রধান রাজনৈতিক দল মনে করেন, তাদের মধ্যেই তো কোনো ঐক্য হলো না। বিশেষ করে নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং সংবিধান সংস্কারের বিষয়ে।

দুটি বড় দল বলল, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হতে হবে। অপর বড় দলটি সেটিতে ভেটো দিল। সেটি হয়নি। আর একটি বড় দল নিম্নকক্ষ এবং উচ্চকক্ষ-উভয় কক্ষেই সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) দাবি করেছিল। ৩২টি দলের মধ্যে অন্তত ২৫টি দল নিম্নকক্ষে সরাসরি নির্বাচন চেয়েছিল। তবে তারা উচ্চকক্ষে পিআর চেয়েছিল। এখন পর্যন্ত জানা যায়নি, কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে। এটাও জানা যায়নি, আদতেই উচ্চকক্ষ হবে কিনা।

এনসিপি শুরু থেকেই বলে আসছে, তারা বর্তমান সংবিধানকে মুজিববাদী সংবিধান বলে। তাই তারা এ সংবিধান বাতিল করতে চায়। আর সেজন্যই তারা প্রথমে সংসদ নির্বাচন না করে গণপরিষদ নির্বাচন করতে চায়। সেই গণপরিষদ যুগপৎ পার্লামেন্ট ও গণপরিষদ হিসাবে দেশ চালাবে এবং সংবিধান প্রণয়ন করবে। এ দাবিটি মানা হয়নি। বর্তমান সংবিধান অর্থাৎ ১৯৭২ সালের সংবিধান দিয়েই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

৩.

১৯৭১ সালের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রেই তো বলা হয়েছে, ১৯৭০ সালের নির্বাচন হয়েছে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করার জন্য। ড. আলী রীয়াজের সংস্কার কমিশনের রিপোর্টেও একই কথা বলা হয়েছে। ১৯৭২ সালের সংবিধান যে চাপিয়ে দেওয়া সংবিধান, তার একটি প্রমাণ দিচ্ছি।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা, ১৯৬৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ৬ দফা, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের ১১ দফা, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেনিফেস্টো, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র-এসব ডকুমেন্টের কোথাও বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমাজতন্ত্রের কথা ছিল না। তাহলে সংবিধানে সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা কে ঢোকাল? শেখ মুজিব মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস দেশে বা ভারতে ছিলেন না। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র মোতাবেক যে সরকার গঠিত হয়েছিল, সেটি ছিল প্রধানত রাষ্ট্রপতিনির্ভর। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে শেখ মুজিব দেশে ফিরে প্রধানমন্ত্রী হলেন। কে তাকে শপথ বাক্য পাঠ করিয়েছেন? তখন তো কোনো সংবিধানই ছিল না। শেখ মুজিব নিজ থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমাজতন্ত্র সংবিধানে ঢুকিয়েছিলেন। সেই সংবিধান তো জুলাই বিপ্লবের পর চালু থাকতে পারেন না।

৪.

গত ১৩ মাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে জুলাই ঘোষণাপত্র এবং জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি প্রদান। এ দুটি ইনস্ট্রুমেন্টকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান। সেটিও হয়নি। কিন্তু ড. ইউনূস ইলেকশন ডিক্লেয়ার করে দিয়েছেন। তাহলে ওই দুটি ইনস্ট্রুমেন্টের কী হবে? এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার করা দরকার। সেটি হলো, এগুলো কিন্তু সংবিধানের মামুলি সংশোধন নয়। এগুলো হলো সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অংশ করার বিষয়। যদি সেটা না করা হয়, তাহলে শেখ হাসিনা অতীতে যেমন সংশোধনী বাতিল করে এবং নতুন আইন করে ১৯৭৫-এর আগস্ট অভ্যুত্থানের বিচার ও অভ্যুত্থানকারীদের ফাঁসি দিয়েছেন, তেমনি আগামী দিনে ভারতসমর্থিত সরকার এলে জুলাই বিপ্লবের নায়করা এবং ড. ইউনূসসহ অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের সর্বোচ্চ শাস্তির জায়গায় রেখে দেওয়া হবে। শেখ হাসিনা বর্তমান সংবিধানের ৭(ক) অনুচ্ছেদ ঢুকিয়ে সংবিধানবহির্ভূত যে কোনো কাজকে রাষ্ট্রদ্রোহমূলক অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। এ কারণে রাজনৈতিক দলগুলোর একটি অংশ জুলাই সনদ এবং জুলাই ঘোষণাকে সংবিধানের অংশ করার দাবি করে আসছেন।

এগুলো না করায় তারা অসন্তুষ্ট। জামায়াত এবং এনসিপি অতীতে ড. ইউনূসের সমর্থক ছিল। তখন বিএনপি তার বিরোধী ছিল। এখন বিএনপি তার অবস্থান পরিবর্তন করেছে। তারা সরকারের সমর্থক। জামায়াত এবং এনসিপিও অবস্থান পরিবর্তন করেছে। তারা সরকারের বিরোধী। ফেব্রুয়ারির নির্বাচন নিয়ে বিএনপি অনেক বেশি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে। কিন্তু জামায়াত এবং এনসিপি এ ব্যাপারে অত্যন্ত শীতল। ফেব্রুয়ারির নির্বাচন সম্পর্কে তারা স্পষ্ট কোনো অবস্থান জানাচ্ছে না। তবে জুলাই সনদ ও জুলাই ঘোষণা সম্পর্কে তারা প্রতিদিন কঠোর থেকে কঠোরতর অবস্থানে যাচ্ছে। এভাবে যেতে যেতে তারা কতদূর যাবে? এটিই এখন রাজনীতিসচেতন দেশের মানুষ এবং বিদেশিদের প্রধান উৎকণ্ঠার বিষয়।

বিএনপি ছাড়া যেমন ইলেকশন গ্রহণযোগ্য হবে না, তেমনি জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিস ইত্যাদি দল ছাড়াও নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। সে ক্ষেত্রে সেই নির্বাচন হবে One way traffic. সবাইকেই দেখতে হবে, এ ধরনের কোনো ঘটনা যেন না ঘটে।

মোবায়েদুর রহমান : সিনিয়র সাংবাদিক

journalist15@gmail.com

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম