কার হাতে উঠবে বুকার ২০২৫
মেজবাহ উদ্দিন
প্রকাশ: ০৭ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
প্রায় পঁয়তাল্লিশ দিন আগে লন্ডনের রয়্যাল ফেস্টিভ্যাল হলে এক আলো ঝলমলে সন্ধ্যায় ঘোষণা করা হয়েছিল এ বছরের বুকার পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকা। আর মাত্র কয়েক দিনের অপেক্ষা-১০ নভেম্বর জানা যাবে, কার হাতে উঠবে এ মর্যাদাপূর্ণ সাহিত্য পুরস্কার। সাহিত্য জগতের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ এ পুরস্কারের ইতিহাসে প্রতি বছরই উঠে আসে এমন কিছু নাম, যারা কেবল বই লেখেন না-মানুষ, সময় ও নীরবতার মানচিত্র অঙ্কন করেন। এবারের ছয়জন মনোনীত লেখকের মধ্য দিয়ে যেন ধরা পড়েছে আমাদের সময়ের সবচেয়ে মানবিক, সবচেয়ে ভঙ্গুর, আবার সবচেয়ে আশাবাদী প্রতিধ্বনি।
কিরণ দেশাইয়ের ‘দ্য লোনলিনেস অব সোনিয়া অ্যান্ড সানি’: তালিকার সবচেয়ে আলোচিত বই নিঃসন্দেহে কিরণ দেশাইয়ের নতুন উপন্যাস ‘দ্য লোনলিনেস অব সোনিয়া অ্যান্ড সানি’। প্রায় সাতশ পৃষ্ঠার এক ব্যাপ্ত আখ্যান-একটি প্রেমের গল্প, যা পেরিয়ে গেছে মহাদেশ, সংস্কৃতি ও মানসিকতার সীমান্ত। প্রকাশের পর থেকেই বইটি সমালোচকদের উচ্ছ্বাসে ভাসছে। দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের আলেক্সান্দ্রা জ্যাকবস লিখেছেন, ‘এটি কেবল একটি উপন্যাস নয়-এ এক বিস্ময়।’ দ্য গার্ডিয়ান-এর অ্যান্থনি কামিন্সের ভাষায়, ‘দেশাই যদি আবার বুকার জেতেন, তাতে আপত্তি করার কোনো কারণ নেই।’ দেশাইয়ের এ উপন্যাসে প্রেম আছে, আছে আত্মপ্রবঞ্চনা ও অভিবাসনের ক্লান্ত দীর্ঘশ্বাস। সোনিয়া ও সানির প্রেম যেন আজকের মানুষের নিঃসঙ্গতার প্রতীক-যে পৃথিবীতে সম্পর্ক ক্রমে ছায়ার মতো অনিশ্চিত, সেখানে এ গল্প খোঁজে হারিয়ে যাওয়া মানবিক উষ্ণতা।
ক্যাটি কিতামুরার ‘অডিশন’: মাত্র দুইশ পৃষ্ঠার এক মনস্তাত্ত্বিক থ্রিলার। এক অভিনেত্রীর জীবনে হঠাৎ প্রবেশ করে এক অচেনা পুরুষ-যে হয়তো তার হারানো ছেলে কিংবা কেবল এক ছায়া। বাস্তব ও অভিনয়ের সীমানা ঝাপসা করে কিতামুরা নির্মাণ করেছেন এক আশ্চর্য মঞ্চ, যেখানে ভয়, মাতৃত্ব ও সন্দেহের সুর একাকার হয়ে যায়। জীবন যেন এখানে এক নিরন্তর রিহার্সাল-যেখানে প্রতিটি সংলাপের ভেতর লুকিয়ে থাকে অপর এক বাস্তবতা। বইটির সমাপ্তি নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও সেই অনিশ্চয়তাই পাঠককে ভাবায়। প্রতিবার পড়লে নতুন অর্থের জন্ম দেয় ‘অডিশন’; এটাই তার স্থায়িত্বের শক্তি।
সুসান চোইয়ের ‘ফ্ল্যাশলাইট’: পারিবারিক কাহিনি হলেও এটি ছড়িয়ে আছে আমেরিকার উপশহর থেকে উত্তর কোরিয়ার গোপন শহর পর্যন্ত। ব্যক্তিগত স্মৃতি ও জাতির রাজনৈতিক অন্ধকার এখানে মিশে গেছে এক জটিল বয়নকৌশলে। চোইয়ের লেখায় ইতিহাস যেন কখনো পরিবার, কখনো রাষ্ট্র-দুইয়ের মাঝের অদ্ভুত প্রতিসরণ।
ডেভিড সালেইয়ের ‘ফ্লেশ’: এক হাঙ্গেরীয় তরুণের জীবনকথা-যে কিশোর অপরাধ থেকে উঠে আসে উচ্চ সমাজে। কিন্তু এ আরোহণের ভেতরে লুকিয়ে থাকে এক মানবিক ক্ষুধা ও আত্মবিনাশের টানাপোড়েন। ফ্লেশ-এর কণ্ঠ সংযত, বাক্যসংখ্যা অল্প, অথচ তার মধ্যে অনুরণিত হয় গভীর অনুভূতি। কথক সচেতনভাবে নীরব থাকে বহু জায়গায়, যেন সময়ের ফাঁকগুলো পাঠক নিজেই পূরণ করে নেয়। পুরুষত্ব, বিচ্ছিন্নতা ও সামাজিক ব্যাধির এমন সূক্ষ্ম বিশ্লেষণই বইটিকে আধুনিক সাহিত্যের শক্ত আসনে বসিয়েছে।
বেনজামিন মার্কোভিৎসের ‘দ্য রেস্ট অব আওয়ার লাইভস’: এক মার্কিন অধ্যাপক হঠাৎ একদিন ঘর ছেড়ে অজানার পথে পা বাড়ান। তার যাত্রা কি পালানো, নাকি আত্ম অন্বেষণ? এ প্রশ্নই বইটির কেন্দ্রে। ব্যক্তিগত পরিসর ও অস্তিত্ববাদী নিঃসঙ্গতার এমন সংলগ্নতা খুব কম লেখকই ধরতে পারেন, যেমনটি মার্কোভিৎস ধরেছেন।
অ্যান্ড্রু মিলারের ‘দ্য ল্যান্ড ইন উইন্টার’: এখনো আমেরিকায় প্রকাশিত হয়নি এ উপন্যাস, কিন্তু ব্রিটিশ সমালোচকরা একে ইতোমধ্যেই ‘শীতের মতো তীব্র ও নিঃশব্দ’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। দুটি দাম্পত্য জীবনের ঠান্ডা নীরবতায় মিলার খুঁজেছেন সময়ের নৈতিক দ্বন্দ্ব। দ্য গার্ডিয়ান-এর জেমস ওয়ালটন লিখেছেন, ‘প্রত্যেক যুগ কিছু ঠিক করে, কিছু ভুল করে; কিন্তু সেই ফয়সালা কখনোই তখনই সম্ভব হয় না।’ মিলারের বইটি যেন সেই অসম্ভব ফয়সালার এক শিল্পিত প্রয়াস।
সমালোচকদের মতে, এ বছরের তালিকায় সবচেয়ে জোরালো প্রতিদ্বন্দ্বী তিনটি বই-ফ্লেশ, অডিশন এবং দ্য লোনলিনেস অব সোনিয়া অ্যান্ড সানি।
এ বইগুলোর বিশেষত্ব:
ফ্লেশ : সংযত কণ্ঠ, অল্প কথা-তবু গভীর অনুভূতি। কথক সচেতনভাবে বহু ঘটনায় চুপ থাকে, সময়ের ফাঁক এঁকে রেখে পাঠককে অংশগ্রহণ করায়। পুরুষত্ব, বিচ্ছিন্নতা ও সামাজিক ব্যাধি-এসবের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ বইটিকে literary compactness-এ রাখে। এর সংযমই বইটির প্রধান শক্তি। যদি বিচারকের লক্ষ্য হয় ‘সাহিত্যিক ঝাঁকুনি’ ও ভাষার অনুভূতি: ফ্লেশ জয়ী হওয়া উচিত। সীমিত শব্দে ব্যক্তিত্ব ও পুরুষত্বের ভঙ্গুরতা যে রকম দক্ষভাবে অনুধাবিত হয়েছে, তা পুরস্কারের অভিপ্রায়-রেট্রিবিউশন শক্তি ও কণ্ঠের স্বতন্ত্রতা দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
অডিশন: মনস্তাত্ত্বিক থ্রিলার; ন্যারেটিভ ভয়েসের জাদু এখানে কাজ করে। মায়ের সন্তান, অভিনয় ও বাস্তবতার সীমারেখা মিশে যায়-পাঠকের মনস্তত্ত্বকে খুঁচিয়ে দেয়। প্রতিবার পড়লে নতুন অর্থ উদ্ভাসিত হওয়ায় এটির স্থায়িত্ব আছে। সমাপ্তি নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও তার সমস্যাও যে পাঠককে ভাবায়, তা এ বইয়ের কৃতিত্ব। যদি বিচারকের সামাজিক-রাজনৈতিক তীব্রতা ও কনটেক্সটকে অগ্রাধিকার দেয়, ‘অডিশন’ বড় ব্যবধানে এগিয়ে থাকবে।
দ্য লোনলিনেস অব সোনিয়া অ্যান্ড সানি: বিরাট আখ্যান, অভিবাসন ও পরিচয়-এগুলো দেশাইকে তার পুরোনো উচ্চতায় নিয়ে যায়। চরিত্র-নির্মাণ শক্তিশালী; দীর্ঘতর উপন্যাসেও ক্লান্তি নেই। যদি লক্ষ্য হয় পাঠক-প্রবেশযোগ্যতা ও ব্যাপক প্রভাব-‘দ্য লোনলিনেস অব সোনিয়া অ্যান্ড সানি’ ইতিবাচকভাবে বড় আখ্যান, চরিত্রের গভীরতা ও সামাজিক প্রসঙ্গ-সবমিলিয়ে সবচেয়ে ‘দৈনিক পাঠক উপযোগী’ ও বিতর্ক-উত্তেজক বস্তু।
বুকার বিচারকমণ্ডলীর সভাপতি রডি ডয়েল বলেন, ‘এ বছর আমরা যে ছয়টি বই বেছে নিয়েছি, সেগুলো সবই গভীরভাবে মানবিক। অনেক লেখকই গল্পের চেয়ে নিজের বুদ্ধিমত্তাকে বড় করে দেখাতে চান; কিন্তু এ বইগুলো গল্প বলতে জানে, মানুষকে দেখতে জানে।’
এ শর্টলিস্টে কোনো দুর্বল বই নেই। প্রতিটি এসেছে আলাদা শক্তি ও আঙ্গিকে। শেষ পর্যন্ত নির্ধারণ করবে বিচারকের মনোভাব-তিনি কি খুঁজবেন ভাষার সাহস, নাকি আখ্যানের ব্যাপ্তি; ব্যক্তিগত কণ্ঠ, নাকি সামাজিক বিস্তৃতি? ১০ নভেম্বর বিশ্ব জানবে সিদ্ধান্ত। ততদিন আমরা অপেক্ষা করব-কে সেই লেখক, যিনি নিজের গল্পকে সবচেয়ে প্রবলভাবে পৃথিবীর সামনে দাঁড় করাতে পেরেছেন।
সূত্র : নিউইয়র্ক টাইমস

