শাহিদ উল ইসলামের চলে যাওয়া
জামালউদ্দিন বারী
প্রকাশ: ০৮ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
‘আমিও কবি ছিলাম/যদিও পৃথিবী বুকে
আমার সমাধি হবে; তথাপি এর সাথে আমার
কোনো সম্পর্ক থাকবে না।
আমার মৃত্যুর পর কেউ বুক চাপড়িয়ে কাঁদলেও
সে কান্না আমার কানে পৌঁছুবে না।
তবুও কবিতার চাষ হয় কবিতার চাষ করি
যদিও আমি জানতে পারবো না
আমার কোনো কবিতা আপনার
আলোচনায় এলো কিংবা এলো না।
এমনও হতে পারে ... ’
৯০ দশকের কবি শাহিদ উল ইসলাম মৃত্যুর মাত্র কিছুদিন আগে নিজের ফেসবুক টাইমলাইনে এ কবিতাটি পোস্ট করেছিলেন। জন্ম ঢাকার দোহারে ১৯৭২ সালে। কবি নিজের মৃত্যু নিয়ে যেন এপিটাফ লিখে গেলেন! জীবন-যাতনার নীরব অভিমান বহতা নদীতে, অসীম আকাশে বিসর্জন দিয়ে গত ৩০ জুলাই অপরাহ্নে কবি শাহিদ উল ইসলাম চলে গেলেন না ফেরার দেশে। মধ্য ৫০ বয়সি কবির এমন আকস্মিক হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে চলে যাওয়ার অদৃশ্য গতিপথ ঢাকার কবি বন্ধুদের ব্যথিত-বিমর্ষ করেছে। শাহিদ উল ইসলাম শুধু কবিই ছিলেন না, ছিলেন সাহিত্যের নিরলস কর্মী-সংগঠক। কবিধ্বনি নামের একটি সাহিত্যপত্র সম্পাদনা করেছেন আড়াই দশক ধরে।
শাহিদ উল ইসলামকে আমরা পাপ্পু বলে ডাকতাম। আমরা বলতে, ওর পরিচিত কাছের সমবয়সি ও সমকালীন বয়জ্যেষ্ঠ কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিকরা। ওর সঙ্গে আমার স্মৃতিগুলো কিছুটা পুরোনো। ৯০ দশকের শেষদিকে আমরা বেশ কয়েকজন তরুণ কবি, ছাড়াকার, আঁকিয়ে, সম্ভাবনাময় নবীন রিপোর্টার, ফিচার লেখক ৭০ দশকের অন্যতম তুখোড় কবি-সাংবাদিক আবদুল হাই শিকদারের নেতৃত্বে দৈনিক ইনকিলাবের ফিচার বিভাগে যোগ দিয়েছিলাম। সেসময় দেশের দৈনিক পত্রিকাগুলোর মধ্যে ইনকিলাব গতানুগতিকতা থেকে বেরিয়ে এসে একটি বহুমাত্রিক ফিচারধর্মী পত্রিকা হয়ে উঠেছিল। পরে অন্য পত্রিকাগুলোও তা অনুসরণ করে দেশের দৈনিক পত্রিকা জগতে নতুন মাত্রা যুক্ত করে। কবি আবদুল হাই শিকদারের তত্ত্বাবধানে থাকা ফিচার পাতায় ছড়াকার লুৎফুল খবির, আতিক হেলাল, মুহাম্মদ আবদুল বাতেন, আহমদ আকবর, বশির উল হক সিনহা, আবিদুর রহীম ভূঁইয়া, জামালউদ্দিন বারী, অলিউল্ল্যাহ নোমান, আহমদ আতিক, রেহানা সালাম, ফাহমিদা আহমদ, পঙ্কজ পাঠক, জাহিদ হাসান বেনু, ফরিদী নোমানসহ বেশকিছু তরুণের কর্মচাঞ্চল্যে মুখরিত হয়ে উঠেছিল। সে সময় লেখক-কন্ট্রিবিউটর হিসাবে অনেক সৃষ্টিশীল, প্রতিভাবান তরুণ কবি-লেখকের সমাগম ঘটত। কবি শাহিদ উল ইসলাম পাপ্পু সে সময়ের তরুণ কবি ও সাহিত্যকর্মীদের একজন। কবি আবদুল হাই শিকদারের উদাত্ত আন্তরিকতার টানে তিনি প্রায়শ আর কে মিশন রোডের ইনকিলাব ভবনে হাজির হতেন, দীর্ঘক্ষণ আমাদের সঙ্গে প্রাণবন্ত সাহিত্য আড্ডা-আলোচনায় মেতে থাকতেন। প্রায় সমবয়সি হলেও পাপ্পু আমাকে বড়ভাই’র মতো সম্মান ও সম্বোধন করত। কবিতার জন্য আত্মনিবেদিত ৯০ দশকের যে কয়জন তরুণ কবির নাম করা যায়, কবি শাহিদ উল ইসলাম ছিলেন তাদেরই একজন।
শাহিদ উল ইসলামের আকস্মিক চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের মধ্যে কিছু সহজাত ভাবনা ও কষ্টের আঁচড় রেখাপাত করে। এটি হঠাৎ করেই শুরু হয়নি। কবিদের জীবন-মৃত্যুর গল্পের একটা পরম্পরা বিদ্যমান থাকে। সেই পঞ্চাশের দশকে (১৯৫৪, অক্টোবর) নিভৃতচারী কবি জীবনান্দ দাশ কীভাবে, কোন প্রেক্ষাপটে কলকাতায় ট্রামের নিচে পড়ে গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন! ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতায় জীবনান্দ লিখেছেন, নারীর হৃদয় প্রেম, শিশু , গৃহ নয় সবখানি/অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয়, আরও এক বিপন্ন বিস্ময় আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভেতর খেলা করে.. আমাদের ক্লান্ত করে.. ক্লান্ত, ক্লান্ত করে, লাশকাটা ঘরে সেই ক্লান্তি নাই।’ বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাস অসংখ্য কবির অকাল মৃত্যুর বেদনায় যেন ভারাক্রান্ত। আমরাও তার ব্যতিক্রম নই। ৩০ জুলাই কবি শাহিদ উল ইসলামের মৃত্যুর ঠিক ১৫ দিন আগে ৯০ দশকের আরেক কবি মুহিবুর রহিম বিনামেঘে বজ পাতের মতো ইহলোক ত্যাগ করেন। ৯০ দশকের আর কয়েকজন কবির কথা মনে পড়ছে, যারা তাদের ৫০ বছর বয়সের গণ্ডি পেরোনোর আগেই গত কয়েক বছরে মৃত্যুবরণ করেছেন। তাদের একজন কবি ও কবিতাপত্র পথিক সম্পাদক তারেক মাহমুদ। সে জীবিকার প্রয়োজনে নাটক ও বিজ্ঞাপনচিত্রে অভিনয় করত। করোনাকালে আমরা অনেককেই হারিয়েছি। নব্বইয়ের কবি ও সংগঠক কামাল আহসান ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন। এর কয়েক মাস আগে ২০২০ সালের নভেম্বরে তরুণ প্রতিভাবান কবি আহমদ বাসির ইন্তেকাল করেন। এদের কেউই কোনো দুর্ঘটনা কিংবা দীর্ঘদিন রোগাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেননি। যুগযন্ত্রণার যুপকাষ্ঠে পুড়তে পুড়তে নীরব দহনে দহনে এসব তরুণ কবি হঠাৎ করেই যেন সুগন্ধি, বকুলের মতো ঝরে যায়।
শাহিদ উল ইসলামের পৈতৃক নিবাস ঢাকার দোহার উপজেলায়। ঢাকার মিরপুরে সপরিবার বসবাস করেছেন। কিন্তু একজন কবির জন্য এ শহর বড়ই নির্মম। কোনো পেশায় থিতু হতে না পারা এবং একাধিক ক্ষুদ্র ব্যবসায় উদ্যোগে ব্যর্থ ও প্রতারিত হয়ে তাকে ঢাকা ছেড়ে গাজীপুরে বসত গাড়তে হয়েছে। মৃত্যু অবধি তিনি গাজীপুরেই ছিলেন। সাংসারিক টানাপোড়েনে রূঢ় সমাজবাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে তিনি অনেকটা অভিমানী হয়ে উঠেছিলেন! তিনি হয়তো সংসার থেকে বিচ্ছিন্নতা প্রত্যাশা করতেন। ৩০ জুলাই অপরাহ্নে হঠাৎ বুকে ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট উঠলে নিজেই রিকশা নিয়ে কাছের হাসপাতালে যান, সেখানে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও অক্সিজেন লাগিয়ে কুমুদিনী হাসপাতালে রেফার্ড করলে সেখানে পৌঁছানোর আগেই রাস্তায় তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। আমাদের কবি আল মাহমুদ বলতেন, ‘কবিতা কবির জীবন দাবি করে’। এর অর্থ কী, কবিরা স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন অথবা কবিতা যে কোনো একটিকে বেছে নেবেন?
শাহিদ উল ইসলাম সংসার করেছেন, দুটি সন্তানও আছে। তথাপি তিনি কবিতাকেই বেছে নিয়েছিলেন। আকাশ, নদী, মাটির প্রকৃতি আর অন্তর্গত হাহাকার নিয়ে ছুটে বেরিয়েছেন। শুধু নিজের কবিতায়ই সীমাবদ্ধ থাকেননি। অগ্রসর, সমদশকীয় এবং অনুজ কবিদের নিয়ে কাজ করতেন, সাহিত্য সংগঠক হিসাবে কাজ করার প্রতিশ্রুতি ধারণ করতেন। নিজের সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ‘কবিধ্বনি’ নামের একটি লিটলম্যাগ দীর্ঘদিন চালিয়ে নিতে সচেষ্ট ছিলেন। ৭০ দশকের অন্যতম কবি আবদুল হাই শিকদার এবং প্রয়াত কবি আসাদ বিন হাফিজকে নিয়ে কবিধ্বনির বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছিলেন। কাব্যগ্রন্থ বেদনার বালুচরে নদীর কঙ্কাল, অভিসন্ধি পুষ্পের নিজস্ব অভিসন্ধি, কাকাতুয়া তব হেরা, বাঘের বাবা টাগ প্রভৃতি নামের কবিতা ও শিশুতোষ রচনা মিলিয়ে বেশ কয়েকটি বই বেরিয়েছিল কবি শাহিদ উল ইসলামের। তার অগ্রন্থিত কবিতার সংখ্যাও অনেক।
