Logo
Logo
×

২ যুগে যুগান্তর

নিরাপদ বাসস্থান হোক বাংলাদেশ

Icon

একেএম শামসুদ্দিন

প্রকাশ: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০২:০০ পিএম

নিরাপদ বাসস্থান হোক বাংলাদেশ

গত বছর বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের পর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সংযোগ সড়ক নিয়ে ঢাকার জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোতে বেশ কয়েকটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। ৬ থেকে ৮ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর করেন। প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় হিলি থেকে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতের মেঘালয়ের মহেন্দ্রগঞ্জ মহাসড়কসহ কয়েকটি সংযোগ সড়ক স্থাপন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সফর শেষে প্রকাশিত যৌথ বিবৃতির ১৯ অনুচ্ছেদে হিলি-মহেন্দ্রগঞ্জ মহাসড়ক নির্মাণের বিষয়ে একটি বিস্তারিত প্রকল্প প্রতিবেদন প্রস্তুতের জন্য ভারত প্রস্তাব দিয়েছে। সফর উত্তর বাংলাদেশে নিয়োজিত ভারতের তৎকালীন হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামীও ১৪ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে, এ মহাসড়কসহ আরও বেশ কয়েকটি সড়ক সংযুক্তি নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আলোচনা চলছে বলে জানিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের সঙ্গে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, বিশেষ করে আসামের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের কথাও বলেছেন। এ সংযোগ সড়ক নির্মাণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ভারতের উত্তাঞ্চল থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে যাওয়ার পথ শিলিগুড়ি করিডোর। ওই পথে পণ্য পরিবহনের পরিমাণ সীমিত। এ কারণেই বিকল্প পথ হিসাবে ভারত, বাংলাদেশ, উত্তর-পূর্ব ভারত এবং এর বাইরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে নতুন নতুন সড়কের মাধ্যমে যুক্ত করার পথ খোঁজা হচ্ছে।’ উল্লেখ্য, হিলি থেকে মহেন্দ্রগঞ্জ পর্যন্ত প্রস্তাবিত মহাসড়ক প্রকল্পটি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলকে সংযুক্ত করার প্রস্তাবগুলোর অন্যতম।

সফর শেষে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে ফিরে এলে, পরের দিন ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার এক দৈনিক পত্রিকা, প্রস্তাবিত হিলি-মহেন্দ্রগঞ্জ মহাসড়ক নিয়ে বিস্তারিত খবর প্রকাশ করে। সন্দেহ নেই, হিলি-মহেন্দ্রগঞ্জ মহাসড়ক উপ-আঞ্চলিক সংযোগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এ মহাসড়ক নির্মিত হলে ভারতও অর্থনৈতিকভাবে সুবিধা পাবে। বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ মহাসড়ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও, কৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য এ মহাসড়ক কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ, সে আলোচনার দাবি রাখে। এ সড়ক ভবিষ্যতে বাংলাদেশের নিরপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হবে কিনা তা যাচাই করে দেখা যেতে পারে। বাণিজ্যিক এবং কিছু কৌশলগত দিক দিয়ে এ মহাসড়ক ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ সড়কটি বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্যকার ভারতের ‘চিকেন-নেক’ হিসাবে পরিচিত পথের বিকল্প পথ হিসাবে ব্যবহৃত হবে। এ মহাসড়ক হবে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের পশ্চিম ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মধ্যে সরাসরি ও সংক্ষিপ্ত যোগাযোগ মাধ্যম। ঢাকার সেই দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুসারে জানা গেছে, গত তিন-চার বছর আগে বাংলাদেশের এক ঊর্ধ্বতন কূটনীতিককে ভারতীয় পক্ষ থেকে এ মহাসড়ক নির্মাণের ধারণা দিয়েছিলেন। কূটনৈতিক সূত্রের বরাত দিয়ে ঢাকার অপর একটি সংবাদপত্র জানিয়েছে, ২০২১ সালের মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকা সফরের সময় এ মহাসড়কের প্রস্তাব করেছিলেন।

২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর সঙ্গে সড়ক, রেল ও নৌপথে যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি সাধন হয়েছে। উল্লিখিত অঞ্চলের সাধারণ মানুষের উপকারের কথা বিবেচনা করেই এ যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। বাংলাদেশও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে কিছুটা লাভবান হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এক সময় কলকাতা থেকে আগরতলায় পণ্য পৌঁছাতে যেখানে ১৬৫০ কিলোমিটার পথ চার-পাঁচ দিনে পাড়ি দিতে হতো; এখন চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে নতুন নির্মিত বারৈয়ারহাট-হোঁয়াকো-রামগড় মাত্র ৮০ কিলোমিটার সড়ক পাড়ি দিয়ে অতি অল্প সময় ও কম খরচে আগরতলায় পণ্য পৌঁছে যাবে।

এ মহাসড়ক নির্মাণের অন্যতম উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ-নেপালের মধ্যকার শিলিগুড়ি করিডোর হিসাবে পরিচিত পথের বিকল্প পথ হিসাবে ভারত এ মহাসড়ক ব্যবহার করবে। অর্থাৎ ভবিষ্যতে এমন কোনো পরিস্থিতির যদি সৃষ্টি হয় যে, শিলিগুড়ি করিডোর দিয়ে মূল ভূখণ্ড থেকে পণ্যবাহী যানবাহন উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে পৌঁছানো সম্ভব হবে না, তখনই এ বিকল্প পথ ব্যবহারের প্রয়োজন পড়বে। তবে অবস্থা দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, হিলি-মহেন্দ্রগঞ্জ মহাসড়ক ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রধানতম সড়ক হিসাবেই ব্যবহৃত হবে। বাংলাদেশের ম্যাপ লক্ষ করলেই বোঝা যায়, পশ্চিমবঙ্গ থেকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত বা কম দূরত্ব হলো হিলি থেকে মহেন্দ্রগঞ্জের দূরত্ব। যদি মহাসড়ক নির্মাণ করা হয়, তাহলে রণকৌশলের দৃষ্টিকোণ থেকেও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। ভবিষ্যতে যদি এমন কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টির ফলে, পশ্চিম ও পূর্বদিক থেকে হিলি-মহেন্দ্রগঞ্জ মহাসড়ক বরাবর বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়, তাহলে সম্পূর্ণ রংপুর বিভাগ বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। অতএব, এটা অনুমান করা ভুল হবে না যে, এ মহাসড়ক নির্মিত হলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়বে। যদিও এ মহাসড়ক নির্মাণে, ভারতের দেওয়া প্রস্তাবে কী কী আছে, তা এখনো পুরোপুরি স্পষ্ট নয়; তবুও হিলি থেকে মহেন্দ্রগঞ্জের মধ্যকার যে কোনো যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার আগে ওপরে উত্থাপিত প্রশ্নের সঠিক উত্তর আমাদের জানতে হবে। এ সড়ক নির্মাণের পেছনে শুধু বাণিজ্যিক লাভের বিষয় বিবেচনা করলেই চলবে না। রণকৌশলগত দিক থেকে কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ, সেদিকেও সতর্ক দৃষ্টি দিতে হবে। তা ছাড়াও হিলি-মহেন্দ্রগঞ্জ মহাসড়ক নিঃসন্দেহে একটি ব্যয়বহুল প্রকল্প হবে। এ মহাসড়ক নির্মাণে যমুনা নদীর ওপর পদ্মা সেতুর দ্বিগুণ দীর্ঘ অর্থাৎ প্রায় ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সেতু নির্মাণ করতে হবে। এটি নির্মাণে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে অর্থের জন্য তখন হাত পাততে হতে পারে।

অপরদিকে, রাঙামাটির বরকল উপজেলার থেগা বাজার সীমান্তে সেতু নির্মাণ করতে বাংলাদেশকে অনুরোধে করেছে ভারত। চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে সড়কপথে মিজোরাম রাজ্যের যোগাযোগ স্থাপন করাই ভারতের লক্ষ্য। ইতঃপূর্বে ত্রিপুরার সাব্রুম শহরকে চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে সড়কপথে যুক্ত করতে গত ২০২১ সালের মার্চে খাগড়াছড়ির রামগড়ে ফেনী নদীর ওপর অনুরূপ একটি সেতু উদ্বোধন করা হয়েছে। একই প্রক্রিয়ায় বরকল সীমান্তে সেতু নির্মাণের প্রস্তাব দেয় ভারত। থেগা সেতু নির্মাণে যৌথভাবে জরিপ কাজও সম্পন্ন হয়ে গেছে। থেগা বাজার সীমান্তে থেগা নদীর ওপর সেতু নির্মাণে ভারত পাঁচ বছর ধরে চিঠি চালাচালি করে আসছে। ভারতের প্রস্তাব অনুযায়ী চট্টগ্রাম বন্দর থেকে রাঙামাটি পর্যন্ত ৮৯ কিলোমিটার দূরত্ব সড়কপথে এবং রাঙামাটি থেকে থেগা মুখ পর্যন্ত ৬৫ কিলোমিটার নদীপথে সংযুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। থেগা সেতুর নির্মাণের এলাকাটি একেবারে সীমান্তের কাছে বলে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ পার্বত্য অঞ্চলে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতা রয়েছে। এ অঞ্চলে গত কয়েক বছরে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সংঘর্ষের ফলে অনেক নিরীহ মানুষ মারা গেছে। এমনকি সেনাবাহিনীর টহলের ওপরও হামলা হয়েছে। এমন ‘স্পর্শকাতর’ এলাকায় আন্তর্জাতিক যোগাযোগ স্থাপিত হলে স্থানীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। রণকৌশলের দৃষ্টিকোণ থেকে থেগা নদীর ওপর সেতু নির্মাণ করা উচিত হবে না। বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও থেগা সেতু নির্মাণে অনুরূপ পর্যবেক্ষণ দিয়েছে বলে জানা গেছে।

‘সেভেন সিস্টার’ নামে পরিচিত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাত রাজ্য ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে অনেক দূরে। এ কারণে এসব রাজ্যে পণ্য পরিবহনে শিলিগুড়ি করিডোর দিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়। তা ছাড়াও ভারত-চীন দ্বন্দ্বের কারণে ভারতীয় কৌশলবিদরা এ করিডোরকে নিরাপদ মনে করেন না। এ কারণে দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে খুব দ্রুত ও কম খরচে পণ্য উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পৌঁছাতে বাংলাদেশের কাছে ট্রানজিট সুবিধা দাবি করে আসছিল ভারত। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালেই সড়কপথে ভারতকে পণ্য পরিবহণে ট্রানজিট সুবিধা দেয় এবং ২০১৫ সালের চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার সম্পর্কে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। আগে কলকাতা বন্দর থেকে ত্রিপুরার দূরত্ব ছিল ১৬৫০ কিলোমিটার। যা এখন নেমে এসেছে মাত্র ৪০০ কিলোমিটারে। শুধু কি তাই, পণ্য পরিবহণে প্রতি কিলোমিটার সড়ক ব্যবহারের খরচ বাবদ ভারত বাংলাদেশকে দেবে মাত্র দুই টাকা। এক হিসাবে দেখা গেছে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করার জন্য আগরতলা-কলকাতা পণ্য পরিবহণে ভারতের খরচ কমবে ৮০ শতাংশ!

কলকাতা থেকে আগরতলার সবচেয়ে সহজ ও সংক্ষিপ্ত রুট হলো, কলকাতা বন্দর থেকে নদীপথে সরাসরি আশুগঞ্জ নদী বন্দর। সেখান থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিলেই আগরতলা। আরও একটি রুট দিয়ে সহজেই কলকাতা থেকে আগরতলা পৌঁছানো যাবে। সেটি হলো, কলকাতা সমুদ্রবন্দর থেকে সোজা চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর, সেখান থেকে মাত্র ৮০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে নতুন নির্মিত বারৈয়ারহাট-হোঁয়াকো-রামগড় হয়ে ত্রিপুরার সাব্রুম শহর। কিন্তু মুশকিল হলো আশুগঞ্জ-আখাউড়া এক লেনের সড়কটি ট্রানজিট সুবিধার উপযুক্ত নয়। একইভাবে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে রামগড় সড়কটিও পর্যাপ্ত প্রশস্ত নয়। তাই ভারতকে এ ট্রানজিট সুবিধা দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার উভয় সড়ককে চার লেনে প্রশস্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে। আশুগঞ্জ-আখাউড়া সড়কটি প্রশস্তকরণের কাজ পাঁচ বছর আগে শুরু হলেও নানাবিধ টেকনিক্যাল কারণে এখন পর্যন্ত সম্পূর্ণ হয়নি। আশুগঞ্জ-আখাউড়া সড়কের মোট খরচ ধরা হয় প্রায় তিন হাজার ৫৬৮ কোটি টাকা। অপরদিকে বারৈয়ারহাট-হোঁয়াকো-রামগড় সড়ক প্রশস্তকরণের জন্য খরচ ধরা হয়েছে ৮৪৫ কোটি টাকা। উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে বাংলাদেশে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ভারত সরকারের ঘোষিত দুই বিলিয়ন ডলার ঋণের আওতায় যে কয়টি প্রকল্প রয়েছে তার মধ্যে এ সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পগুলো অন্যতম। স্মরণে রাখা ভালো, ভারতের এ ঋণ কিন্তু বাংলাদেশকেই পরিশোধ করতে হবে।

বাংলাদেশের জন্যও ভালো খবর আছে। বিনা মাশুলে ভারতের নির্দিষ্ট বন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় কোনো দেশে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির প্রস্তাব দিয়েছে ভারত। ২০১৫ সালেই ভারতের সঙ্গে অবাধ যান চলাচল চুক্তি হলেও ভারত এতদিন এটিকে ঝুলিয়ে রেখেছিল। দেরিতে হলেও ভারতের এ প্রস্তাব বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির সুযোগ করে দিয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকালে স্থলবন্দর, সমুদ্রবন্দর ও বিমানবন্দর ব্যবহার করে বিনা মাশুলে ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্টের প্রস্তাবটি দেয় ভারত। প্রস্তাবটি কার্যকর হলে বাংলাদেশের ট্রাক ভারত হয়ে মূলত নেপাল ও ভুটানে পণ্য প্রেরণ করতে পারবে। তাতে ওই দুটি দেশে বাংলাদেশের বাণিজ্য বৃদ্ধির সুযোগ বাড়বে। তবে কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, এটি একটি ছায়া (শ্যাডো) প্রস্তাব, যাতে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে অন্য দেশে আমদানি-রপ্তানি করতে পারে। এ ছাড়া বিনা মাশুলের সঙ্গে প্রকৃত প্রস্তাবে আর কী কী শর্ত যোগ হয় সেটিও দেখার প্রয়োজন আছে। বেশ কিছুদিন আগে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের নির্বিঘ্ন পরিবহণ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হলে বাংলাদেশের ১৭ শতাংশ জাতীয় আয় বাড়বে। গত দশকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ব্যাপকভাবে বাণিজ্য বেড়েছে। তারা আরও উল্লেখ করেছে, ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটান পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর গেটওয়ে। আঞ্চলিক বাণিজ্য, ট্রানজিট ও লজিস্টিক নেটওয়ার্ক উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের, এ অঞ্চলে অর্থনৈতিক পাওয়ার হাউজ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর থেকে শুরু করে ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত তদানীন্তন পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে মূলত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কলকাতা থেকে নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন ছোট-বড় নৌবন্দর দিয়ে ভারতের পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল করেছে। এ ছাড়াও ভারতের আশপাশের রাজ্যগুলোর সঙ্গে পূর্ববঙ্গ সড়ক, রেলপথেও সংযুক্ত ছিল। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যাতায়াত বাড়াতে পঞ্চাশ বছর আগে বন্ধ হয়ে যাওয়া সড়ক যোগাযোগের পথগুলো একে একে খুলে দেওয়ার জন্য ভারতের অনুরোধে বাংলাদেশ সরকারের সম্মতি আছে বলেই মনে হয়। বর্তমানে সে লক্ষ্যেই হয়তো বিপুল অর্থ ব্যয়ে অবকাঠামোগত উন্নয়নের কাজ চলছে। তবে এ ট্রানজিট সুবিধায় কে বেশি লাভবান হবে তা নিয়ে বিতর্ক কিন্তু রয়েই গেছে। এ কারণে ভারত-বাংলাদেশ যখন ট্রানজিট চুক্তি করে তখন অনেকেই অনুমান করেছিলেন, ভারত এ ক্ষেত্রে বেশি সুবিধা পেতে পারে! ট্রানজিটে তাদের কী সুবিধা দেওয়া হবে, কিংবা বিনিময়ে বাংলাদেশ কী পাবে, এতে কার লাভ কতটুকু এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সরকারও কখনো খোলাখুলি কিছু জানায়নি। বন্ধুত্ব হতে হবে পরস্পরের চাওয়া-পাওয়া, দেওয়া-নেওয়ায় সমতার ভিত্তিতে। আমরা কী দিয়েছি তারা কী দিল এর হিসাবের প্রয়োজন আছে। এর পাশাপাশি দেশের নিরাপত্তার বিষয়টিও সমভাবে লক্ষ রাখতে হবে। আমরা চাই নিরাপদ বাসস্থান হোক বাংলাদেশ। আমাদের এমন কিছু করা ঠিক হবে না যে, ট্রানজিটের আড়ালে বাংলাদেশের নিরাপত্তাহানিকর কিছু হয়। এ জন্য বাংলাদেশের যে ক্ষতি হয়ে যাবে তার মাশুল কিন্তু আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেই দিতে হবে।

লেখক : মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক লেখক, সাবেক সেনা কর্মকর্তা

যুগান্তর প্রতিষ্ঠা

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম