Logo
Logo
×

২ যুগে যুগান্তর

বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির তুলনামূলক চিত্র

Icon

ড. সৈয়দ মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী

প্রকাশ: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০২:০৮ পিএম

বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির তুলনামূলক চিত্র

পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশ যেমন উষ্ণায়নের পরিপ্রেক্ষিতে সমূহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন, তেমনি এর মানবিক পরিবেশও নানাবিধ কারণে এক অস্থির সময় অতিবাহিত করছে। অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির আবিষ্কার ও তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের ফলে মানুষের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনে যে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে তা থেকে পরিত্রাণের আশু কোনো প্রেসক্রিপশন কেউ হাজির করতে পারছে না। এর অন্যতম কারণ হলো পরিবর্তনশীলতার গতি এত তীব্র যে গতকালের সমাধানতত্ত্ব আজকেই অচল হয়ে দেখা দিচ্ছে। আবার আজকের সমাধান আগামীকালই যে অচল বলে প্রতিভাত হবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

বর্তমান বাংলাদেশের মানবসমাজ দীর্ঘ ঔপনিবেশিক তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়ে আজকের রূপ পরিগ্রহ করেছে। এটি একটি সংকর জাতিগোষ্ঠীর বহুত্ববাদী সমাজ। এ সমাজটির মধ্যে হিন্দু সমাজের প্রাচীন কৌলীন্য প্রথা, মধ্যযুগের মুসলিম সমাজের আশরাফ-আতরাফ প্রথা, ব্রিটিশের হিন্দুপ্রীতি ও বৈষম্যমূলক শাসনের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা কট্টর মুসলিম সমাজের ধ্যান-ধারণা, সুফিবাদ-ওহাবি-ফরায়েজি আন্দোলন, সনাতন হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি, নাতিদীর্ঘ ইংরেজ শাসনকালে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার, সাম্যবাদী সমাজ নিমার্ণের তত্ত্ব, মরমিবাদ, বাউলিয়ানা প্রভৃতির অবিমিশ্র প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। বিংশ শতকের আগে এ প্রভাবগুলো সমাজে বিকশিত হতে সময় লেগেছে। এক একটা মূল্যবোধ গড়ে উঠেছে শতশত বছরে। আবার সনাতন মূল্যবোধের পরিবর্তন করতেও বহু চড়াই-উতরাই পেরোতে হয়েছে। কিন্তু বিংশ শতকের পর এ পরিবর্তনের গতি হয়েছে খুবই বেগবান। এ শতকে বাংলাদেশের মানবসমাজ কয়েকটি বড়বড় ঘটনার মুখোমুখি হয় যা তাদের শতশত বছরের ধ্যান-ধারণার উপর প্রচণ্ড অভিঘাত হানে। এগুলো হলো বঙ্গবিভক্তি ও স্বদেশী আন্দোলন, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা ও ভারত বিভক্তি, পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন এবং ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ ও বিজয় লাভ এবং এর অব্যাবহিতে বঙ্গবন্ধুর সপরিবার হত্যাকাণ্ড। ফরায়েজি আন্দোলন থেকে শুরু করে বিগত একশ বছরে বাংলাদেশের মানবসমাজ অসংখ্য আন্দোলন-সংগ্রামে অংশ নিয়েছে এবং অকাতরে জীবন দিয়েছে। প্রতিটি আন্দোলনেই নেতারা মানুষকে শোষণমুক্ত ও সাম্যবাদী সমাজের স্বপ্ন দেখিয়ে রাস্তায় নামিয়েছেন। জনগণও জীবন বাজি রেখে রাস্তায় নেমেছেন। কিন্তু প্রতিবারই আন্দোলনের সুফল ছিনতাই করে নিয়েছে কায়েমী স্বার্থবাদীরা, যাদের আসলে কোনো দেশ-জাতির প্রতি আনুগত্য নেই; আনুগত্য শুধু অর্থ আর সম্পদের প্রতি। সর্বশেষ ১৯৯০ এবং ১৯৯৬ সালে মানুষ দুটি বড় আন্দোলন করে শাসকগোষ্ঠীর অগণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিহত করে। কিন্তু আখেরে লাভবান হয়েছে দুর্নীতিবাজ আমলা, অসৎ ব্যবসায়ী আর পুঁজিপতি শ্রেণি। গণতন্ত্র এখন একটি মডেল মাত্র, যা সেলুলয়েডে বন্দি। রাজনীতিকদের মাধ্যমে তাদের যে ভাগ্যের পরিবর্তন হবে জনগণ তা আর বিশ্বাস করতে পারছে না। বর্তমানে বাংলাদেশে বস্তুবাদী উন্নয়নের যে জোয়ার বইছে তা সীমাহীন দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতার কালিমাকে ঢেকে দিচ্ছে আর বঙ্গবন্ধুকে বিক্রি করে হাইব্রিড রাজনীতিকরা ফুলে-ফেঁপে উঠছে। জনগণের সামনে কিছুই অস্পষ্ট নয়। কিন্তু দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামে জনগণ ক্লান্ত। তা ছাড়া শাসকগোষ্ঠীর ঘারে চেপে বসা পুঁজিবাদী হাইব্রিড দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে যারা মাঠে নেমেছে তাদের অনেকেই অতীতের পরীক্ষিত দুর্নীতিবাজ। কাজেই জনগণ বুঝতে পারছে না যে, ঘুমন্ত ব্যক্তি কী করে অন্যকে জাগ্রত করবে! এর ফলে এটি স্পষ্ট হয়েছে যে, বাংলাদেশের বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এ মুহূর্তে গণআন্দোলন গড়ে ওঠার সম্ভাবনা খুবই কম। ফলে কালো টাকার মালিক, অসৎ আমলা ও সুবিধাবাদী রাজনীতিকরা শাসকগোষ্ঠীর পক্ষেই বাজি ধরে বসে আছে। তা ছাড়া যারা সরকারকে ফেলে দেওয়ার জন্য রাজপথ উত্তপ্ত করার হুমকি দিয়ে যাচ্ছে তাদেরও ইচ্ছা ও সক্ষমতার বিষয়টি প্রশ্নসাপেক্ষ। সমাজ পর্যবেক্ষকদের অনেকের ধারণা, এ ধরনের অন্তঃসারশূন্য লম্ফঝম্পের পেছনে রয়েছে ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা। ফলে এটি নিশ্চিত যে, গণতন্ত্রের যে মডেলটি বর্তমানে শেখ হাসিনা সরকার চালু করেছেন তাকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় চ্যালেঞ্জ করার সক্ষমতা কোনো রাজনৈতিক দলের নেই। মনে হচ্ছে মার্ক টোয়েনের দ্য গিল্ডেড এজ- এ বর্ণিত সমাজের দিকে ধাবিত হচ্ছে বাংলাদেশ।

আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সমাজ-সংস্কৃতি ও রাজনীতির অবস্থা কি আমাদের চেয়ে খুবই প্রাগ্রসর? এটি ঠিক যে শাসন কাঠামোর পদ্ধতিগত দিক দিয়ে ভারত পৃথিবীতে গণতন্ত্রের রোল মডেল। কিন্তু সেখানে দীর্ঘ প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র মৌলবাদকে প্রতিহত করতে পারেনি বরং এগিয়ে দিয়েছে। এদিক দিয়ে বাংলাদেশ বরং সফলতা দেখিয়েছে।

সম্প্রতি ভারতের ২৯টি রাজ্যের বিধানসভার নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) জোট জয়ী হয়েছে ৯টি প্রদেশে এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস জয়ী হয়েছে ৬টি প্রদেশে। বাকি ১৪টি প্রদেশে জয়ী হয়েছে আঞ্চলিক দলগুলো। অন্য ৪টি জাতীয় ভিত্তিক রাজনৈতিক দল যেমন-ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই), ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই-মমতা), বহুজন সমাজ পার্টি (বিএসপি) এবং জাতীয় কংগ্রেস পার্টি (এনসিপি) কোনো আসন পায়নি। কংগ্রেস এবং বিজেপি ব্যতীত অন্য জাতীয় ভিত্তিক দলগুলোও ক্রমে আঞ্চলিক দলে পরিণত হচ্ছে। তা ছাড়া বিজেপিকেও বিধান সভা নির্বাচনে আঞ্চলিক দলগুলোর সঙ্গে কোয়ালিশন করেই জিততে হয়েছে। এ থেকে এটি ক্রমেই পরিষ্কার হচ্ছে যে, সর্বভারতীয় দলগুলো ক্রমেই জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে এবং আঞ্চলিক দলগুলো ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে।

যেসব আদর্শকে সামনে রেখে স্বাধীনতার পর থেকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ভারতীয় সমাজকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে সক্ষম হয়েছিল, বিংশ শতকের শেষ দশকে এসে ভারতীয় জনগণের মানস চেতনায় সেই আদর্শগুলোর আবেদন ক্রমেই ফিকে হতে থাকে। এ দশকে বিজেপির নেতৃত্বে ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে ‘কোয়ালিশন সরকারের’ ধারা শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ভারতীয় জনগণ সর্বভারতীয় একক দলের নেতৃত্বের প্রতি ক্রমেই আস্থা হারাতে থাকে এবং জাতীয় স্বার্থের চেয়ে আঞ্চলিক স্বার্থগুলোর প্রতি বেশি মনোযোগী হতে শুরু করে।

কংগ্রেসের মতো অন্য কোনো জাতীয় ভিত্তিক রাজনৈতিক দলও জনগণের মননের এ পরিবর্তনের পাঠ নিতে পারেনি এবং এর ফলে আঞ্চলিক দলগুলোর প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে যার ফল আমরা সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনে লক্ষ করছি।

ভারতের অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জের মধ্যে ছিল ব্যাপক দারিদ্র্য নিরসন করা এবং এর জন্য প্রয়োজন ছিল সনাতন কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির উপর থেকে সামগ্রিক নির্ভরতা কমিয়ে শিল্পায়নের মাধ্যমে দেশকে শিল্পসমৃদ্ধ করে তোলা। এক্ষেত্রেও ভারত স্নায়ুযুদ্ধকে সার্থকভাবে ম্যানিপুলেট করতে সক্ষম হয়। উদাহরণ স্বরূপ : আমরা লক্ষ্য করেছি, পঞ্চাশের দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন ভারতকে পুঁজিবাদী বলয়ে যোগদানের বিনিময়ে জাতিসংঘে বৃহৎ পঞ্চশক্তির একটি হওয়ার প্রস্তাব দেয় তখন জওহরলাল নেহরু তা প্রত্যাখ্যান করেন। নেহরুর এই নীতি পরবর্তীতে দেশে ব্যাপক সমালোচিত হলেও এটির সুফল ভারত ষোল আনাই ঘরে তুলতে সক্ষম হয়। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় ভারতের স্টিল ইন্ডাস্ট্রির উত্থানের কথা। স্টিল ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলার জন্য স্নায়ুযুদ্ধের প্রথমপর্বে ফ্রান্সের ব্যয়বহুল ও কঠিন শর্তের পরিবর্তে ভারত ‘নিরপেক্ষ নীতি নেওয়ার পুরস্কার হিসাবে’ সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে অত্যন্ত সহজ শর্তে ঋণসহ কারিগরি ও প্রযুক্তিগত সহায়তা লাভ করে। ভারতের পারমাণবিক শক্তি হয়ে ওঠার ক্ষেত্রেও এই নীতি সুফল বয়ে আনে। স্বাধীনতার পরবর্তী তিন দশক ভারত এভাবে প্রধানত কংগ্রেসের নেতৃত্বে একটি শিল্পসমৃদ্ধ ভারত নির্মাণে অনেকটা এগিয়ে যায়। দারিদ্র্য থেকে উত্তোরণের তীব্র আকাঙ্ক্ষা এবং স্নায়ুযুদ্ধের জুজু এ দশকগুলোতে ভারতের জনগণকে সর্বভারতীয় কোনো রাজনৈতিক দলের অধীনে ঐক্যবদ্ধ থাকতে প্রেরণা জোগায়। এ সময়গুলোতে ভারতের জনগণের মধ্যে আঞ্চলিক স্বার্থের চেয়ে জাতীয় স্বার্থই প্রাধান্য পেয়েছে। কিন্তু নব্বইয়ের দশকে স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটলে বৈদেশিক ক্ষেত্রে জুজুর ভয় অনেকটা কমে আসে। এ সময়ের মধ্যে ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণির ব্যাপক বিকাশ ঘটে। শিল্পায়নের বিকাশের ফলে নব্য ধনিক শ্রেণির উত্থান ঘটে। সমাজে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান ক্রমশ ব্যাপক হতে থাকে। শিক্ষা-দীক্ষার প্রসারও প্রযুক্তির কল্যাণে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যেরও বিকাশ ঘটে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে সম্পদের সুসম বণ্টনের বিষয়টি মানুষের সামনে চলে আসে। এর ফলে মানুষ ক্রমেই দীর্ঘদিনের একদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি আনুগত্যের পরিবর্তে অন্যান্য বিষয়গুলোর দিকে নজর দেয়ার ফুরসত পায়। উন্নয়নের হাত ধরে বিকশিত হওয়া ব্যাপক দুর্নীতির বিরুদ্ধেও মানুষ কথা বলার সাহস সঞ্চয় করে। এরই ধারাবাহিকতায় ফেডারেল শাসনব্যবস্থায় প্রদেশগুলোতে উন্নয়নের অসম বিকাশের বিষয়টিও ক্রমে ক্রমে প্রতিভাত হতে থাকে। আঞ্চলিক দলগুলো এ বিষয়গুলো জনগণের সামনে নিয়ে আসে। কংগ্রেস বা বিজেপি কিংবা অন্যান্য জাতীয়ভিত্তিক দলগুলো আঞ্চলিক প্রশ্নগুলোর সদুত্তর দিতে সক্ষম হয়নি।

নব্বইয়ের দশকেও মানুষ পরিবর্তন চেয়েছিল। বিজেপি জনগণের এ আকাঙ্ক্ষার কথা মাথায় নিয়ে হিন্দুত্ববাদী চেতনাকে সামনে রেখে ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসে এবং কোয়ালিশন রাজনীতির সূত্রপাত করে। কিন্তু ব্যাপক দুর্নীতির বিষয়টি সমাধান করতে পারেনি। এজন্য আমরা দেখেছি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়ে রাজনীতিতে একেবারেই আনকোরা একজন আমলা অরবিন্দ কেজরিওয়াল দিল্লির মেয়র হয়ে বসলেন। এমন কি তিনি রাতারাতি আম আদমি পার্টিও গঠন করে ফেললেন। এ আম আদমি পার্টির উত্থান এবং কংগ্রেস ও বিজেপির সঙ্গে টেক্কা দিয়ে সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনে পাঞ্জাবে ১১৭টি আসনের মধ্যে ৯২টি আসন লাভের মাধ্যমে আম আদমি পার্টি ক্ষমতাসীন বিজেপি’র প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে।

কংগ্রেস আদর্শগতভাবে সেক্যুলার রাজনীতির ধারক। এর বিপরীতে নব্বই দশকের মাঝে বিজেপি হিন্দু জাতীয়তাবাদী স্লোগান নিয়ে আবির্ভূত হয়। অপরদিকে আম আদমি পার্টি এ দুই দলের আদর্শগত অবস্থানের বিপরীতে জনগণের বাস্তব সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে।

ভারতীয় উপমহাদেশের অপর গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র পাকিস্তানের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা ইতিহাসের যে কোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে শোচনীয়। এ রাষ্ট্রটি জন্মলগ্ন থেকেই সামরিক ব্যুরোক্রেসির প্রভাবে গণতন্ত্রকে বিকশিত করতে পারেনি। এজন্য বলা হয়ে থাকে ‘প্রতিটি দেশেরই একটি সামরিক বাহিনী রয়েছে কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর রয়েছে একটি দেশ!’ এ দেশটি এখনো সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। এদেশের রাজনীতির মূল উপকরণ ইসলাম ও ভারত-ভীতি বা ভারত-বিদ্বেষ। এসব কারণে এ দেশটি শুধু পারমাণবিক বোমা নির্মাণের কৃতিত্ব ব্যতীত অর্থনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রে প্রায় সব সূচকে ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে।

দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ আর শাসকশক্তির পরিবারতান্ত্রিক শাসন ও ভুল রাষ্ট্রীয় নীতির কারণে শ্রীলংকা আজ দেউলিয়া রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। মালদ্বীপ পরিবেশ বিপর্যয়ের শিকার। এটি এখন পানির উপর কোনো রকম মাথা উঁচু করে ভেসে আছে। কোভিড-১৯ পরবর্তী বৈশ্বিক বিপর্যয়ের প্রত্যক্ষ শিকারে পরিণত হয়েছে মালদ্বীপ। এখানে বর্তমানে খাদ্য ও জ্বালানির সংকট তীব্র রূপ ধারণ করেছে। নেপালে রাজনৈতিক অস্থিরতা যেন কাটছেই না। ১৯৯০ সালে গণতন্ত্রে উত্তোরণের পর থেকে দীর্ঘ তিন দশকে কোনো সরকারই পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি। ২০০৬ সালে নেপালে মাওবাদী বিদ্রোহ ঘটে এবং ২০০৮ সালে রাজতন্ত্র উচ্ছেদ হয়। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে তো চলছেই। ভুটানে গণতন্ত্র কেবল হাঁটতে শুরু করেছে। এ দেশটিতে সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রচলিত। ভুটানের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য এই যে এর অর্থনীতি পরিমাপ করা হয় ‘সুখ’ দ্বারা, সম্পদের প্রাচুর্য বা উৎপাদন ক্ষমতা দ্বারা নয়। এ দেশটির প্রধান সমস্যা জাতিগত। এখানে বিভিন্ন সময় বিপুল সংখ্যক বহিরাগত নেপালি ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর প্রবেশ ঘটে যাদের ভুটান সরকার নাগরিক হিসাবে মেনে নেয়নি। ভুটান কর্তৃপক্ষ এর দক্ষিণাংশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য খুবই শংকিত। এজন্য সরকার বিভিন্ন সময় শক্ত অবস্থান নেওয়ায় ভুটানের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক তৃতীয়াংশই শরণার্থীতে পরিণত হয়েছে।

সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি, দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় প্রতিটি দেশই মূলত রাজনৈতিক সমস্যায় ভারাক্রান্ত। এ রাষ্ট্রগুলো ব্রিটিশ শাসনের অধীনে থাকার সময় যে ঔপনিবেশিক শোষণের শিকার হয় সেখান থেকে বেরিয়ে এসে বিগত প্রায় সত্তর বছরেও একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ও স্থিতিশীল শাসনব্যবস্থায় নিজেদের উন্নীত করতে পারেনি। ব্রিটিশের ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ নীতি ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন জাতির মধ্যে যে ক্ষতের সৃষ্টি করেছে সেই ক্ষত সারিয়ে প্রকৃত গণতন্ত্রের দিকে যাত্রা করার জন্য আরও কত সময় অপেক্ষা করতে হয়ে তা-ই দেখার বিষয়।

লেখক : সভাপতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

যুগান্তর প্রতিষ্ঠা

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম