|
ফলো করুন |
|
|---|---|
কোভিড-১৯ মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বের অর্থনীতিতে যে টানাপোড়েন চলছে সেটা ২০২৩ সালেও থাকবে। অর্থাৎ বিশ্ব অর্থনীতির যে চ্যালেঞ্জ সেটা ২০২৩ সালকেও বহন করতে হবে। বিশ্ব অর্থনীতির দৃশ্যপট এটার পক্ষে আসারও কোনো কারণ নেই। পুরো বিশ্বেই একটা উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজমান থাকবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এ অবস্থা থেকে উত্তরণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তবে খুব একটা সফল হবে বলে মনে হয় না। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সুদের হার বাড়াচ্ছে তাদের ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমে। শুধু তাই নয়, বিশ্বের সব সেন্ট্রাল ব্যাংকই তাদের পলিসি রেট বাড়াচ্ছে মানে সুদের হার বাড়াচ্ছে। এর অর্থ হচ্ছে, যেহেতু সুদের হার বাড়ছে সেহেতু মুদ্রার প্রবাহ কমবে। তার মানে মানুষের হাতে কম অর্থ প্রবাহিত হবে সেটা ঋণের মাধ্যমে হোক, বেতন মজুরি বা অন্য যে কোনো ভাবেই হোক। সুদের হার বাড়ানো হচ্ছে যাতে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে রাখা যায়। অর্থনীতির ভাষায় চাহিদা কমিয়ে রাখতে পারলে মূল্যস্ফীতি কম হবে। তবে সাপ্লাই চেইনের বিষয়টি এখানে জড়িত রয়েছে। কারণ কোভিডের কারণেই হোক বা যুদ্ধের কারণেই হোক সাপ্লাই চেইনের ধারাবাহিকতায় একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বলতে গেলে সাপ্লাই চেইন অনেকটা ভেঙে পড়ছে। লজিস্টিক যে কস্ট যেমন এক দেশ থেকে আরেক দেশে মালামাল আনা-নেওয়ার যে খরচ সেটা বেড়ে গেছে। জাহাজিকরণের খরচ বেড়ে গেছে। আর এসব কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে মূল্যস্ফীতি সেটা বজায় থাকবে। বিশ্ব ব্যাংক গ্লোবাল ইকোনমিক গ্রোথ ফোরকাস্ট কমিয়ে দিয়েছে। গত তিন দশক যে সুদিন ছিল সেটা হয়তো আর থাকবে না।
বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। কেননা কোভিড মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানিতে একটা প্রভাব পড়েছে। যেমন বাংলাদেশের প্রধান কাস্টমার হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এ দেশগুলোতে আমাদের যে কয়েকটা পণ্য যায় এর মধ্যে গার্মেন্ট পণ্যই প্রধান। এখন এ দেশগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা যদি নিম্নমুখী হয়ে যায় তাহলে ওদের চাহিদা কমে যাবে। যার ফলে আমাদের এই গার্মেন্ট পণ্য রপ্তানিতে একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। গত ২০২২ সালটি মোটামুটি ভালোই গেছে বলা যায়। এখন এই ২০২৩ সালের ব্যাপারটি দেখার বিষয়। কিন্তু গ্রোথ আমরা কতটা করতে পারি ১৪, ১৫, ১৬ বা ২০। গত বছরের তুলনায় ২০২৩-এ এ গ্রোথ রেট আমরা কতটা অর্জন করতে পারি সেটা হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ।
কারেন্সি মার্কেট টালমাটাল আছে। এটা ডিমান্ড সাপ্লাইয়ের ওপর নির্ভর করছে। পণ্য আমদানিতেও খরচ বাড়ছে, চাহিদা বাড়ছে। কোনো পণ্য হঠাৎ করে কম পাওয়া যেতে পারে। কম পাওয়ার ফলে ওই পণ্যের চাহিদা বেড়ে যাবে। আমরা যেসব উৎস থেকে পণ্য আমদানি করি সেখানে ওই পণ্যের দাম বাড়লে আমাদেরকেও বাড়তি দামেই পণ্য আমদানি করতে হবে। ভারতে এবার কিছু কিছু জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়েছে, সুতরাং সেগুলো আনতে গেলে আমাদের বেশি দাম দিয়েই আনতে হবে।
আরেকটি বিষয় আমাদের গুরুত্বের সঙ্গে ভাবা উচিত সেটা হবে অর্থ পাচার। আমাদের ইকোনমি থেকে প্রচুর অর্থ দেশের বাইরে পাচার হয়ে যাচ্ছে। আগেও হয়েছে, তবে গত ১ বছর থেকে টাকা পাচার বেশি গতি পেয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে টাকা পাচার কারা করছে। এসব টাকা পাচারকারীদের চিহ্নিত করতে গেলে দেখা যায়, যারা ব্যাংক থেকে প্রচুর সুবিধা নিয়েছে, যারা সরকারের আনুকূল্যে ব্যবসা পেয়েছে, যারা সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে কন্ট্রাক্ট পেয়েছে তারা। দেশে বিভিন্ন ধরনের লোকজন আছে যারা দুর্নীতির উৎস মুখগুলোকে ভালো করে তাদের পক্ষে ব্যবহার করতে পেরেছে, এরাই টাকা পাচার করছে। কারণ অর্থ যখন বেশি পরিমাণে তাদের হাতে যায় এবং অর্থ যখন তাদের কাছে সহজলভ্য হয়, তখন তারা টাকা পাচারের নানা পথ খুঁজতে থাকে। তারা দেশে টাকা না রেখে বিদেশে টাকা রাখাটা নিরাপদ স্বর্গ মনে করে। সেটা মালয়েশিয়া হোক সিঙ্গাপুর হোক দুবাই হোক কিংবা যুক্তরাজ্য যুক্তরাষ্ট্রই হোক। বিভিন্নভাবে অর্থ দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। আর এ অর্থ বাইরে যাওয়ার প্রবণতাটি কমেনি বরং বেড়েছে। আর এসব টাকা পাচারের কারণে দেশের ডলার মার্কেটে টালমাটাল অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। এখানে কোনো স্থিতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের যে দুটি সোর্স থেকে ডলার আসে এর একটা হচ্ছে পণ্য রপ্তানি, অপরটি হচ্ছে বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকদের পাঠানো বৈদেশিক রেমিটেন্স। এ দুই জায়গাতে বৈদেশিক মুদ্রা আসার প্রবাহ কমে নাই। কিন্তু সমস্যাটি হচ্ছে এসব বৈদেশিক মুদ্রা বৈধ পথে আসছে না। বিশেষ করে রেমিটেন্স। এগুলো অবৈধ পথে হুন্ডির মাধ্যমে আসছে। আর এগুলো যারা অর্থ পাচার করছে তাদের হাতেই বেশি পড়ছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রগুলো পাচার হয়ে যাচ্ছে। ফর্মাল সেক্টর বা বৈধ পথের চেয়ে তারা ২-৩ টাকা বেশি দিয়ে ডলার পাচার করছে। তারা শুধু দেশেই নয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও তাদের এ কার্যক্রম ছড়িয়ে রয়েছে। অবৈধ পথে হুন্ডির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আসার কারণে মাত্র ৬ মাসে ইউএস ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি মুদ্রা ২৫ পার্সেন্ট মূল্য হারিয়েছে। যেটা দেশের অর্থনীতির জন্য একটা দুঃসংবাদই বলা যায়।
এক্সচেঞ্জ রেটের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি হিসাব করলে বাংলাদেশি পণ্যের মূল্য ৫ পার্সেন্ট বাড়ার কথা। কিন্তু সেটা হয় নাই, কারণ আমাদের লোকাল মুদ্রা বেশি আছে। কিন্তু অর্থনৈতিক স্থিতি বজায় রাখার জন্য এক্সচেঞ্জ রেট হচ্ছে একটা বড় অনুঘটক। এক্সচেঞ্জ রেট যদি স্থিতিশীল না থাকে তাহলে অর্থনীতিতে এক ধরনের হাহাকার চলতেই থাকবে। আমরা যেসব উৎস থেকে পণ্য আমদানি করি হঠাৎ করে কোনো কারণে সেই পণ্যের সরবরাহ কমে যেতে পারে। যেমন ভারতে এবার কিছু কিছু জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়েছে, এখন বেড়ে যাওয় পণ্যগুলো ওইখান থেকে আনতে গেলে আমাদের বেশি আমদানি ব্যয় গুনতে হবে। সেটা আলাদা কথা। কিন্তু এক্সচেঞ্জ রেট যদি অনবরত আমাদের বিপক্ষে যেতে থাকে তাহলে সেটা আমাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। জাহাজের মাল এসে গেছে অথচ পণ্য খালাস হচ্ছে না ডলার সংকটের কারণে। এগুলো ভেবে দেখার বিষয়। ইকোনমিক গ্রোথ ওয়াইজ বাংলাদেশ ৭.৫ পার্সেন জিডিপি অর্জন করেছে। এবার ২০২৩ এ আশা করা ঠিক হবে না। আমরা যদি ৫ পার্সেন গ্রোথ রেট অর্জন করতে পারি সেটা যথেষ্ট হবে। তবে এ গ্রোথ রেট অর্জনের জন্য সরকারের কি ভূমিকা থাকতে পারে। একটা হচ্ছে আর্থিক খাতকে ঠিক রাখা। তবে আর্থিক খাতকে ঠিক রাখার দায়িত্ব শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের নয়। এক্ষেত্রে সরকারের সমর্থন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক সমর্থন ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক একা ব্যাংকিং সেক্টর এবং আর্থিক খাতকে ঠিক রাখতে পারবে না। ইসলামী ব্যাংক এবং ন্যাশনাল ব্যাংকের বিষয়টি আমরা কমবেশি অনেকেই জানি। এমন আরও অনেক ব্যাংক বা লিজিং কোম্পানি রয়েছে যেগুলো শক্ত হাতে দেখার দায়িত্ব হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের যথেষ্ট ক্ষমতা দেওয়া আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি মনে করে, কোনো ব্যাংকের বা লিজিং কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টরকে বাদ দিতে হবে-তারা সেটা করতে পারে। সে ক্ষমতা তাদেরকে দেওয়া আছে। তাদের ক্ষমতাবলে যে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ডিরেক্টরশিপ বাতিল করতে পারে। নতুন করে প্রশাসন বসাতে পারে। বোর্ড ভেঙে দিতে পারে। বলতে গেলে সবই করতে পারে। তবে এসব ক্ষেত্রে সরকার থেকে একটা রাজনৈতিক সমর্থনের প্রয়োজন রয়েছে।
গত বছরের শেষের দিকে একটা গুজব উঠে এবং ওই গুজবের কারণে অনেক গ্রাহক ব্যাংক থেকে তাদের আমানত তুলে নেয়। একটা সূত্র বলছে ৫০ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে। গুজবে ভয়ে মানুষ তাদের টাকা উঠিয়ে নিয়ে গেছে। বিষয়টি ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকের আস্থাহীনতার কারণেই ঘটেছে। ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়ে তারা ঘরে রাখছে বা যেখানে যেভাবে রাখার দরকার সেভাবে রাখছে। যার ফলে আইডল অর্থটি অন্য কেউ ব্যবহার করতে পারছে না। তারল্য সংকট দেখা দিচ্ছে। আর এ কারণে ব্যাংকগুলোতে ল্যান্ডিং প্রবাহ কমে যাচ্ছে এবং ল্যান্ডের রেট বেড়ে যাচ্ছে। যার ফলে কিছু ব্যাংক উচ্চহারে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিবে। বর্তমানে আন্তঃব্যাংক ইন্টারেস্ট রেট প্রায় ৯ পার্সেন্টের কাছাকাছি। যেটা গত ১০ বছরে ঘটে নাই। এখন ক্রমান্বয়ে যেটা ঘটছে সেটা হচ্ছে ব্যাংকের গ্রাহকদের নজরে যেসব ব্যাংকিং কোম্পানি দুর্বল সেগুলো থেকে জনগণ তাদের অর্থ সরিয়ে যেসব ব্যাংকিং কোম্পানিকে সবল মনে করে সেদিকে নিয়ে যায়। ফলে দুর্বল ব্যাংকগুলো খালি হয়ে যাচ্ছে। আগে আমানতের সুদ ৬ পার্সেন্ট ছিল এখন সেটা ৭-৮ পার্সেন্টে উঠে গেছে। যেগুলো লো গ্রেডের ব্যাংক তাদেরকে আমানতের সুদ আরও বাড়াতে হবে। আর যেগুলো ভালো গ্রেডের ব্যাংক তাদেরও আমানতের সুদের প্রতি নজর দিতে হবে। তাদেরও আমানতের সুদ কমপক্ষে ২ পার্সেন্ট বাড়িয়ে দিতে হবে। যেখানে মূল্যস্ফীতি ৯-৯.৫ সেখানে সুদের হার তার নিচে থাকতে পারে না। ব্যাংকের এ সংকটের মধ্যেও কর্পোরেট ল্যান্ডিং রেট ৯ পার্সেন্টে রয়েছে। এটা অনেকটা উঁচু রেট। ব্যাংক যখন আমানত নিবে তখন ল্যান্ডিং রেটও ওপরে যেতে হবে। আশা করি বাংলাদেশ ব্যাংক এগুলো রিভিউ করবে। আগে সুদের বিষয়টি মার্কেট ওয়াইজ ছিল। যারা স্টেক হোল্ডার তারা সরকারের সঙ্গে দরবার করে লোন ইন্টারেস্টের রেটকে সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনে। যেটা মোটেই কাম্য ছিল না। তা ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক এ ধরনের বিষয় মানবে কেন। বাইরের লোকেরা বাংলাদেশ ব্যাংককে ডিক্টেড করবে এটা তো আশা করা ঠিক নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি দুর্বলতা দেখায় তাহলে এর শেষ কোথায়। মানুষের আস্থার যায়গাটি হলো বাংলাদেশ ব্যাংক। সে আস্থার জায়গাটা যাতে নড়বড়ে হয়ে না যায় সেদিকে আমাদের নজর দিতে হবে।
রিজার্ভ বাড়াতে কোনো জাদু-মন্ত্র নেই। অর্থ পাচার কমলে রিজার্ভ বাড়বে। বিষয়টি হলো রেমিটেন্স বা ফরেন এক্সচেঞ্জ ফর্মাল সেক্টরের মাধ্যমে বা ব্যাংকিং সেক্টরের মাধ্যমে এলে হিসাবটা রিজার্ভে যোগ হবে। কিন্তু সেটা যদি হুন্ডি বা অন্য ইনফর্মাল সেক্টরের মাধ্যমে আসে তখন মানি ট্রানজেকশন হচ্ছে ঠিকই কিন্তু সেটা রিজার্ভে যোগ হচ্ছে না। আমাদের লোকেরা দেশের বাইরে গিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করে পাঠানো টাকা এভাবে অবৈধ পথে আসাটা কখনই কাম্য হতে পারে না। সুতরাং হুন্ডি এবং ইনফর্মাল যত সেক্টর আছে সেগুলো বন্ধ করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে চোরাই পথে মানি লন্ডারিং হলে এবং অর্থ পাচার হলে আমাদের রিজার্ভের জন্য হবে অশনি সংকেত।
অনুলিখন: মো. জাহিদ উদ্দিন
লেখক : অর্থনীতিবিদ, সাবেক অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
