Logo
Logo
×

২ যুগে যুগান্তর

ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতির পথরেখায়

Icon

তানভীর এ মিশুক 

প্রকাশ: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১০:১৫ এএম

ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতির পথরেখায়

বিশ্ব অর্থনীতির আকার কতটা এখন জানেন? একশ ট্রিলিয়ন ডলার। সেখানে বাংলাদেশের অংশ ৪১৬ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। মানে হলো, আধা ট্রিলিয়ন ডলারের মতো। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, পৃথিবীর মোট অর্থনীতির দুইশভাগের একভাগের মালিক আমরা। এসব তথ্য গ্লোবাল ম্যানেজমেন্ট কনসালটিং ফার্ম বোস্টন কনসালটিং গ্রুপের। মাস দুয়েক আগে তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে, ২০২১ সালের তথ্য নিয়ে করা হয়েছে এসব হিসাব।

এখানে চমৎকৃত হওয়ার মতো তথ্য হলো-২০০৮ সালেও বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার একশ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়নি, ৯১ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি ছিল। অথচ পরের ১৩ বছরে আমরা আমাদের আয় প্রায় পাঁচগুণ বৃদ্ধি করতে পেরেছি! চিন্তা করেছেন একবার উন্নতির গ্রাফটা?

এতশত তথ্যের জোগান দিতে না পারলেও, আমরা যারা আর্থিক খাত নিয়ে কাজ করি, ভেতর থেকে দেখেছিলাম বাংলাদেশের রূপান্তরের চিত্র। কিন্তু তখন খুব বেশি লোক তা আমলে নেননি। এখন বোস্টন কনসালটিং গ্রুপের মতো বিশ্বখ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলাতে কিন্তু সবাই মানছেন। বোস্টন কনসালটিং গ্রুপ তাদের প্রতিবেদনে বলছে, ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি হবে। আমার কিন্তু মনে হয়, যে গতিতে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, এক ট্রিলিয়ন ডলারের অঙ্কটা আমরা আরও অনেক আগেই পেরিয়ে যাব। আর ততদিনে বিশ্বের সেরা ৩০ অর্থনীতির একটি হবে আমাদের সোনার বাংলা, ডিজিটালাইজেশনের পরিক্রমা পেরিয়ে যা এখন ছুটছে স্মার্ট দেশ হওয়ার দিকে।

এসব কথা বলার শক্তি কোথায় পাচ্ছি সেটাই বলি। বিশ্বজুড়েই যখন নানা চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে অর্থনীতি এগোচ্ছে, তখনো আমাদের উন্নতির রেখা ঊর্ধ্বমুখী। আমাদের উন্নতির প্রধান শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের বিশাল কর্মক্ষম মানুষ। আর এসব মানুষের উন্নতির দিকে ধাবিত করছে আমাদের নতুন নতুন প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, স্থানীয় বাজার তৈরি ও আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে বাধা দূর করা। আমার বিবেচনায় লেনদেন করার ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা ছিল সেটাই ছিল আসলে উন্নতির জন্য অন্যতম প্রধান অন্তরায়।

প্রান্তিক লেনদেনের কথাই ধরুন না, মাত্র কয়েক বছর আগেও শহরে কাজ করা একজন দিনমজুর বা রিকশাচালক হয়তো সপ্তাহে একবার বাড়িতে টাকা পাঠাতেন। একটা দল থেকে পালা করে একজন করে বাকি সবার টাকা নিয়ে এলাকায় যেতেন। তাতে একদিকে যেমন তার সময় নষ্ট হতো, টাকা খরচ হতো আর লেনদেনটাও হতো অনেক বিলম্বিত। ফলে টাকার গতি থাকত অনেক কম। কিন্তু এখন বিকালে মজুরি পেয়েই শতশত কিলোমিটার দূরে বাড়িতে বাজারের জন্য টাকা পাঠিয়ে দিতে পারছে দিনমজুর। একজন রিকশাওয়ালাও তার এক বেলার আয় আরেক বেলার চাল-ডাল কেনার জন্য পরিবারকে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। ফলে লেনদেনের স্বাধীনতা পৌঁছে গেছে একেবারে প্রান্ত পর্যন্ত।

একইভাবে দূরদূরান্তের পণ্য কেনাও এখন নিমিষের ব্যাপার। আর তার লেনদেনটাও হচ্ছে মুহূর্তের ব্যবধানে। একই টাকা একই দিনে কয়েকবার লেনদেন হচ্ছে। অথচ মাত্র কয়েক বছর আগেও একটা লেনদেন হতেও সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। আর এখন একই টাকা দিনে কয়েকবার ব্যবহার হচ্ছে। ফলে সীমিত সম্পদেও বাড়তি উৎপাদনশীলতা দেখা যাচ্ছে। টাকার এই যে গতিশীলতা, সেটাই আমাদের এগিয়ে দিচ্ছে বহুগুণে।

যত সহজে গল্পটা বলে ফেলছি, কাজটা কিন্তু ততটা সহজ ছিল না। হাতের মোবাইল প্রযুক্তির মাধ্যমে টাকা লেনদেন করার জন্য সবচেয়ে আগে তো দরকার ছিল আর্থিক সামর্থ্যরে বিচারে প্রান্তসীমায় থাকা মানুষের অন্তর্ভুক্তির মধ্যে আনা। বলতে একটু কেমন যেন লাগছে, তারপরও বলতে হচ্ছে যে, নগদ-এর আগে আরও অনেক মোবাইল আর্থিক সেবা বাজারে এসেছে। কিন্তু ততদিনে যেভাবে গ্রাহক অ্যাকাউন্ট খোলা হচ্ছিল, তাতে আগ্রহী কোটি কোটি মানুষের পক্ষে অ্যাকাউন্ট খোলাই অসম্ভব এক কাজ; লেনদেন করা তো অনেক দূরের কথা।

পরিস্থিতিটা বদলে দিতে সবচেয়ে বড় কাজটাই করেছে নগদ। যে কোনো মোবাইল গ্রাহক চাহিবা মাত্রই তার মোবাইল ফোন থেকে পাঁচটা বাটন (*১৬৭#) চেপেই অ্যাকউন্ট খুলতে পারছেন। সব মিলে এক মিনিটেরও কম সময় লাগছে একটা অ্যাকাউন্ট খুলতে। এ একটা উদ্ভাবনই যেন সবকিছু বদলে দিয়েছে। নগদ-এর এখন প্রায় সোয়া সাত কোটি নিবন্ধিত গ্রাহক আছে। যার মধ্যে অর্ধেকের বেশি অ্যাকাউন্ট খুলেছে এ প্রক্রিয়ায়।

তবে এরও আগে আরও একটা বড় কাজ করেছে নগদ। সেটা হলো মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়পত্র স্ক্যান করে অ্যাকাউন্ট খোলার পদ্ধতি। এ প্রক্রিয়ায় গ্রাহক পরিচয় ইলেক্ট্রনিক্যালি সম্পন্ন করা হচ্ছে। অফিসিয়াল নাম হিসাবে এটি বলা হচ্ছে ই-কেওয়াইসি। ২০১৯ সালের নগদ-এর আনুষ্ঠানিক যাত্রার আগেই ই-কেওয়াইসি চালু করে নগদ। এটি যদি দাবি করি যে, এ ই-কেওয়াইসি-ই দেশের আর্থিক খাতের ডিজিটালাইজেশনকে এক ধাক্কায় বহুদূর এগিয়ে দিয়েছে। দেশের বড় বড় সব ব্যাংক, অন্যান্য সহযোগী মোবাইল আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানও এখন একই পদ্ধতিতে গ্রাহক নিবন্ধন করাচ্ছে। তাতে করে যেটা হচ্ছে, আট-দশ পাতার একটা ফরম পূরণ করে গ্রাহককে আর সপ্তাহখানেক অপেক্ষা করতে হচ্ছে না। তাৎক্ষণিকভাবে অ্যাকাউন্ট খুলে লেনদেন করতে পারছেন। এ প্রক্রিয়ায়ও লেনদেনকে তাৎক্ষণিকতায় নিয়ে এসেছে নগদ। অর্থ লেনদেনের এ গতি বহুমাত্রিক প্রভাব তৈরি করেছে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর।

শুরুতে যেটি বলছিলাম যে, বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে বোস্টন কনসালটিং গ্রুপের যে পূর্বানুমান তার আগেই এক ট্রিলিয়ন ডলারের কাতারে চলে যাবে বাংলাদেশ। শুধু কি এ দুটি উদ্ভাবনই আমাদের এগিয়ে দেবে? মোটেই না। লেনদেনের ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিকতা দেওয়ার ফলে এখন অন্যান্য সব সেবায় এর সরাসরি প্রভাব পড়বে। তাছাড়া একটা প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার ওপর ভর করে যেভাবে আরেকটি প্রযুক্তি এগিয়ে যায়, সেভাবেই নগদ-এর এ দুটি উদ্ভাবন বাংলাদেশে ডিজিটাল ব্যাংকের বাস্তবতা তৈরি করেছে। ক্ষুদ্র ঋণ বা অতিক্ষুদ্র ঋণ সবই এখন পাওয়া যাবে হাতের মোবাইলে। ডিজিটাল ব্যাংকই আমাদের সেই বাস্তবতায় নিয়ে যাবে। প্রান্তিক মানুষের হাতে সরকারের সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার কাজে তো ইতোমধ্যে আমরা উদাহরণ তৈরি করেছি।

নগদ যখন এলো, তারপর প্রথমেই যে কয়টা সেবা জনপ্রিয় করল, তার একটা হলো কোনোরকম খরচ ছাড়া পরিষেবাগুলোর বিল পরিশোধ করা। এখন দেখেন এর ফলাফল। এখন পরিষেবার বিল দিতে একজন মানুষকেও আর ব্যাংকে যেতে হয় না। ফলে বাঁচে খরচ, মূল্যবান সময়; এড়ানো যায় ঝক্কি। কেউ যদি শুধু এ একটা দিক নিয়েও গবেষণা করে, তাহলেও বের করতে পারবে এ একটা সেবার প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সুবিধা কতটা অর্থনীতির ওপর পড়ছে।

অর্থনীতি এগিয়ে যাওয়ার আরও একটি উল্লেখযোগ্য পদ্ধতি হলো-বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে যৌথ উদ্যোগ। বড় বড় অবকাঠামোর কথা না হয় বাদইদিলাম। শুধু প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতাও আমাদের কাজকে এমন একটা সম্ভাবনার জায়গায় নিয়ে এসেছে যে, বিশ্বের তাবৎ সব অর্থনীতিবিদেরও এখন বাংলাদেশের ওপর নজর রাখতে হচ্ছে। এ যেমন নগদকে নিয়ে লেখা হয়েছে ফিলিপ কটলারের বইতে। এসবই আমাদের যে পথরেখায় নিয়ে যায়, সেটাই আসলে এক ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি হওয়ার গন্তব্য। হ

লেখক : নগদ-এর প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক

নগদ যুগান্তর

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম