Logo
Logo
×

২ যুগে যুগান্তর

বাংলাদেশের কৃষিবিপ্লব বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা

Icon

মোহম্মদ শামস্-উল ইসলাম 

প্রকাশ: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১০:২১ এএম

বাংলাদেশের কৃষিবিপ্লব বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা

আবহমান বাংলার প্রধান চালিকা শক্তি কৃষি হাজার বছর ধরে রাজনীতি, অর্থনীতি, সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল। নবাব-রাজা-জমিদার-তালুকদার প্রমুখ শাসকরা কৃষকের পরিশ্রমের মূল্য খুব বেশি দেয়নি কিন্তু এরা কৃষকদের পেশাগত কর্মকাণ্ডের পথে বিশেষ কোনো বাধা সৃষ্টি করেনি। কারণ, কৃষিই যখন আয়ের প্রধান উৎস তখন কৃষিব্যবস্থা ঠিকঠাকমতো না চললে খাজনা আদায় সহজ হবে না-এ বিষয়টি শাসকদের চিন্তার মূলে ছিলই। বাঙালি কৃষক তাদের এই নিটোল জীবনে প্রথম ধাক্কাটা খায় ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশদের কাছে স্বাধীনতা হারিয়ে। ধাক্কাটা এত তীব্র ও অন্তর্ঘাতি ছিল যে মাত্র দেড়যুগের মাথায় কৃষিপ্রধান বাংলাদেশ ধনে-প্রাণে প্রায় নিঃস্ব হয়ে যায় ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির শোষণের কারণে। তার প্রমাণ ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ (বাংলা ১১৭৬, ইংরেজি ১৭৭০ সাল)। এই দুর্ভিক্ষে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার এক তৃতীয়াংশ লোক মারা যায় অনাহারে এবং দুর্ভিক্ষজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে। অথচ সেই বছর পূর্বের যে কোনো বছরের চেয়ে বেশি খাজনা আদায় করে কোম্পানির গোমস্তারা।

অত্যাচার সহ্য করতে করতে ভারতীয়রা ঘুরে দাঁড়ায়। তীব্র আন্দোলনের মুখে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের চাহিদামতো ভারত ভাগ করে দিয়ে যায়। বর্তমান বাংলাদেশ যুক্ত থাকে পাকিস্তানের সঙ্গে। পরবর্তী চব্বিশ বছরের পাকিস্তানের বৈষম্যনীতির কারণে বাঙালি পুনরায় স্বাধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের জন্য আন্দোলন শুরু করে। গোড়া থেকেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ক্রমে তিনি বাঙালির প্রাণের মানুষ হিসাবে নিজেকে প্রমাণ করতে সক্ষম হন এবং নেতৃত্বের পুরোভাগে চলে আসেন। লাহোরে ৬-দফা পেশ করার পর বাঙালি ক্রমে ক্রমে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি আরও আস্থাশীল হয়ে ওঠে এবং শেষ পর্যন্ত তারা বঙ্গবন্ধুর ডাকে স্বাধীনতার একদফা আন্দোলন শুরু করে এবং নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালি একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা অর্জন করে। কিন্তু বাঙালির সেই প্রাণপুরুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখনো পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি মুক্তি পেয়ে ১০ জানুয়ারি ফিরে আসেন তিনি। ১২ জানুয়ারি তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তখন তার একমাত্র কাজ ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটাকে পুনর্নির্মাণ করা। প্রায় সব ক্ষেত্রেই ক্ষতি সাধিত হয়েছিল, যার একটি তীব্র নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল কৃষিক্ষেত্রে। তখন বাংলাদেশের শতকরা ৮৫ ভাগ লোক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে যুক্ত ছিল এবং এখনো এ দেশের অর্থনীতি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। বঙ্গবন্ধু দেশগঠনের যেসব পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন সেখানে কৃষিকেই তিনি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে অগ্রসর হতে শুরু করলেন।

যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভায় সর্বকনিষ্ঠ মন্ত্রী যিনি কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন, তিনি চব্বিশ বছরের রাজনৈতিক আন্দোলন কালেও যেখানে সুযোগ পেয়েছেন সেখানেই তিনি কৃষকের সমস্যার কথা সর্বাগ্রে বলেছেন। সুতরাং দেশগঠনের ক্ষেত্রে তিনি কৃষিবিপ্লবের পন্থাই অনুসরণ করলেন।

যুগ যুগ ধরে খাদ্য ঘাটতির এ এলাকায় বঙ্গবন্ধু দেশ গঠনের কাজ শুরু করেছিলেন ৪০ লাখ টন (মতান্তরে ৩০ লাখ টন) খাদ্য ঘাটতি নিয়ে। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে খাদ্যে মোট চাহিদা ছিল প্রায় ৪৫ লাখ টন। খাদ্য মজুদ ছিল মাত্র ৪ লাখ টন। সুতরাং কৃষি বিপ্লব সফলভাবে করতে না পারলে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না-বঙ্গবন্ধু এই বিষয়টি খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। ‘কৃষক বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে’-এ স্লোগানকে তিনি আত্মস্থ করেছিলেন এবং সেই লক্ষ্যেই তিনি কৃষিখাতকে তার দেশ গঠনের কর্মপ্রণালিতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন। পরিসংখ্যান বলে যে, ২২ লাখ কৃষক পরিবারকে তার সরকার সার্বিকভাবে পুনর্বাসন করেছিল। স্বল্পমূল্যে এবং ক্ষেত্রে বিশেষে বিনামূল্যে কৃষি উপকরণ সরবরাহ করে কৃষককে নতুন করে কর্মোদ্যোগী করে তোলেন বঙ্গবন্ধু। শুধু তাই নয়, ২৫ বিঘা পর্যন্ত খাজনা মওকুফ, পাকিস্তান সরকারের করা ১০ লাখ সার্টিফিকেট মামলা প্রত্যাহার, পরিবার প্রতি ১০০ বিঘা পর্যন্ত সিলিং নির্ধারণ, কম দামে ৪০ হাজার লো-লিফট পাওয়ার পাম্প, প্রায় ২ হাজার ৯০০ গভীর ও ৩ হাজার অগভীর নলকূপ বসানো, উচ্চফলনশীল ধানবীজ, পাটবীজ, গমবীজ এবং সার, কীটনাশক ইত্যাদি সরবরাহের পাশাপাশি কৃষিঋণ বিতরণ, হালের বলদ ও গাভী বিতরণ করার ফলে বাংলাদেশের কৃষি খাত পুনরায় গতি ফিরে পায়। কৃষকের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ, উৎপাদিত পণ্য গুদামজাত করার জন্য খাদ্য গুদাম নির্মাণ ইত্যাদি বহুমুখী প্রণোদনার ফলে ১৯৭৪-৭৫ সালে আবাদি জমির পরিমাণ ১৯৬৮-৬৯ সালের তুলনায় এক তৃতীয়াংশ বৃদ্ধি পায়। ’৭৫-এর ট্রাজেডির পর বাংলাদেশে যে বিপুল পরিমাণ খাদ্য উৎপাদিত হয় সেটা ছিল বঙ্গবন্ধুর সময়োপযোগী পদক্ষেপের কারণে।

’৭৫ পরবর্তী দুই দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ অনেকটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে থাকে। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে যে কৃষি বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন কিছু সময় সেই রেশ ধরেই চলতে থাকে বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশের মৌলিক চেতনার পরিপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল সরকারগুলো সেই ধারাবাহিকতা খুব বেশিদিন ধরে রাখতে পারে না। এ সময়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্র বাংলাদেশের স্বাধীনতার মৌলিক চেতনার ভিত্তিমূলে কতটা আঘাত করা যায় এবং একটি সাম্প্রদায়িক বাতাবরণ তৈরি করে স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশের আবহ তৈরি করা যায়, মূলত সেই কর্মেই বেশি মনোযোগী ছিল। কৃষিসহ বহু মূল চালিকা শক্তির উন্নয়ন হতে পারেনি, কোনো কোনো ক্ষেত্র পশ্চাদগামী হয়েছে। ’৭৫ পরবর্তী সরকারগুলো প্রায় দুই দশক সময় যে কৃষির মতো দেশের প্রাণসঞ্চারী ক্ষেত্রে মনোযোগ দেয়নি তার মোটাদাগের প্রমাণ হলো উত্তরবঙ্গের মঙ্গা, বিদ্যুতের অভাবে সেচ প্রকল্প প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া, সময়মতো পর্যাপ্ত পরিমাণে সার-বীজ-কীটনাশকের সরবরাহ নিশ্চিত না থাকা।

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে না এলে এবং ফিরে এসে বাংলাদেশের রাজনীতির মূলপ্রবাহে যুক্ত হয়ে সংগ্রাম না করলে আজকের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা কোনোক্রমেই সম্ভব হতো না-সে কথা একরকম হলফ করে বলা যায়। অথচ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা মাত্র চৌদ্দ বছরে বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছেন, শতভাগ বিদ্যুৎ নিশ্চিত করে গভীর-অগভীর পাম্প সচল রেখে সেচ ব্যবস্থা প্রভূত উন্নতি সাধন করেছেন, কৃষিপদ্ধতির আধুনিকায়ন করে কৃষিকাজ সহজ ও যুগোপযোগী করে তুলেছেন, সার-বীজ-কীটনাশক নিয়ে কোনো হা-হুতাশ নেই মানুষের, বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিয়ে কৃষিখাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বঙ্গবন্ধুর সেই কৃষিবিপ্লব সফল করে তুলেছেন। কৃষিখাতে সরকারের ভর্তুকির কিছু পরিসংখ্যান দেওয়া যাক-আইএসএস অব বিডি-এর তথ্য মোতাবেক ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে তখন দেশে খাদ্য ঘাটতি ছিল ৪০ লাখ মেট্রিক টন। বঙ্গবন্ধু কন্যা কৃষি খাতের স্থবিরতা কাটিয়ে ওঠার জন্য প্রথমেই যে কাজটি করেন তা হলো-কৃষিখাতে বাজেট বৃদ্ধি করা। ওই বছরের বাজেটে শুধু কৃষি গবেষণার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় ১২ কোটি টাকা এবং পরের বছরের বাজেটে থোক বরাদ্দ পায় ১০০ কোটি টাকা। এ টাকা ব্যয় করা হয় কৃষি ও কৃষি সংক্রান্ত আইসিটি খাতে। এ মেয়াদে সরকারের কৃষিখাতে বিভিন্ন প্রণোদনার ফল হয় চমকপ্রদ। পরিসংখ্যান বলছে, ২০০১ সালে দেশে খাদ্য উদ্বৃত্ত ছিল ৪০ লাখ টন। কিন্তু ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের কৃষিখাতে আবারও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করে। ২০০২ সালেই খাদ্য উৎপাদন পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় কমে যাওয়া তার প্রমাণ। ২০০২ সালে খাদ্য উৎপাদন কম হয় ৭ লাখ টন। এই কমে যাওয়াটা অব্যাহত থাকে এবং ২০০৯ সালে যখন পুনরায় আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে তখন খাদ্য ঘাটতি ছিল ২৬ লাখ মেট্রিক টন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত আওয়ামী লীগ সরকারের গৃহীত বহুমুখী কৃষি কর্মপরিকল্পনার ফলে আবার কৃষিখাত কৃষিবিপ্লবের দিকে অগ্রসর হয়। কৃষিপ্রণোদনা, সার-বীজ-কীটনাশকসহ কৃষির সব ক্ষেত্রে ভর্তুকির পরিমাণ বৃদ্ধি ও কৃষির আধুনিকীকরণ ইত্যাদি পদক্ষেপের কারণে খাদ্য ঘাটতি নিরসন হতে থাকে এবং জনসংখ্যার বিপরীতে খাদ্যের চাহিদা বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেলেও ২০১৩ সালেই বাংলাদেশ শুধু যে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার গৌরব অর্জন করল তাই নয়, খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশে পরিণত হতেও সক্ষম হয়েছে। ২০০৯ সালে দেশে খাদ্য উৎপাদন ছিল প্রায় ৩ কোটি ৪০ হাজার টন, ২০২২ সালের হিসাবমতে বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদন করছে সাড়ে ৪ কোটি টনেরও বেশি। এসব পরিসংখ্যান থেকে এ কথা পরিষ্কারভাবে উপলব্ধি করা যায়, সরকার একদিকে যেমন আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপান্তরে সফলতা দেখিয়েছে, একইসঙ্গে মানুষের মৌলিক চাহিদার প্রধান উপকরণ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ থাকার ক্ষেত্রেও সমান মনোযোগী রয়েছে।

২০১৯ সাল থেকে পৃথিবী এক অপ্রত্যাশিত সংকটের মধ্যে পড়েছে। বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশের পক্ষে এ রকম একটি সংকট মোকাবেলা করা কতটা কঠিন ছিল-সেটা অর্থনৈতিক চিন্তকমাত্রেই উপলব্ধি করতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশ পৃথিবীর কাছে একটি বিস্ময়কর দেশ হিসাবে পরিচিত হয়ে উঠেছে। এর কারণ-কোভিড-১৯ মতো সংকটে যেখানে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে সেখানে বাংলাদেশ এ সংকট মোকাবিলা করে এখনো প্রায় স্বাভাবিকভাবেই টিকে আছে। এ কথা হলফ করে বলা যায়-বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার মতো সুচিন্তক রাষ্ট্রনায়ক বাংলাদেশের ক্ষমতায় না থাকলে টিকে থাকা তো দূরের কথা, কোভিডের ধাক্কায় আমাদের কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে হতো, তা মনে করলে আঁতকে উঠতে হয়।

এ সাফল্যের পেছনে রয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মতো তার কন্যারও মানুষের প্রতি অকৃত্রিম দরদ এবং কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশের প্রাণভোমরা কৃষি ও কৃষকের প্রতি গভীর অভিনিবেশ এবং সুচিন্তিত কর্মপরিকল্পনা। বঙ্গবন্ধু দেশ গঠনের কাজে এগিয়ে আসার জন্য দেশের যুব সমাজের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন, শুধু চাকরির পিছনে না ছুটে ক্ষেত-খামারে কলে-কারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধি করার জন্য নিজ নিজ এলাকায় থেকে দেশগঠনে অবদান রেখে নিজেদেরকে স্বনির্ভর হতে বলেছিলেন, তার কন্যা শেখ হাসিনা কোভিড-১৯-এর অতিমারি এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী সৃষ্ট সংকট মোকাবিলায় খাদ্য উৎপাদন প্রয়োজনীয় মাত্রায় রাখার জন্য দেশের মানুষের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানালেন-সবাই যেন এ সংকট মোকাবিলায় তৎপর হয়। বললেন, এক ইঞ্চি জমিও যেন খালি পড়ে না থাকে, যে যতটুকু পারে কিছু না কিছু যেন উৎপাদন করে নিজের চাহিদা পূরণের চেষ্টা করেন। একজন রাষ্ট্রনায়ক কতটা দূরদর্শী হলে কৃষিভিত্তিক জীবন ব্যবস্থার প্রতি এতটা মনোযোগী হতে পারেন- সেটা এ দেশের আপামর জনগণের ভেবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে এবং তার এ আহ্বানে সবার সাড়া দেওয়া নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুধু যে দেশের কৃষিখাতেই মনোযোগ রেখেছেন তা নয়, তিনি বিশ্ব শান্তির জন্যও সমান মনোযোগী। তিনি য্দ্ধু চান না, কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বৈরিতা প্রত্যাশা করেন না। তিনি কৃষি গবেষণার ক্ষেত্র বিস্তৃত করতে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের রাষ্ট্রনায়কদের একযোগে কাজ করার জন্য আহ্বান জানান। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) এশীয়-প্যাসিফিক অঞ্চলের ৩৬তম আঞ্চলিক সম্মেলনে তিনি আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে তিনটি খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। তার প্রস্তাবনার এ তিনটি সুপারিশই ছিল কৃষিভিত্তিক। খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও)-এর বৈশ্বিক খাদ্য উৎপাদন পরিস্থিতি সংক্রান্ত প্রতিবেদনে শীর্ষ খাদ্য উৎপাদনকারী ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। শুধু তাই বিশ্বে বাংলাদেশের স্থান ধান উৎপাদনে ৩য়, মাছ উৎপাদনে ৩য়, ইলিশ উৎপাদনে ১ম, মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে ৩য়, পাট উৎপাদনে ২য়, পাট রপ্তানিতে ১ম, সবজি উৎপাদনে ৩য়, আলু উৎপাদনে ৬ষ্ঠ, চা উৎপাদনে ৯ম, ছাগল উৎপাদনে ৪র্থ, আম উৎপাদনে ৮ম, কাঁঠাল উৎপাদনে ২য়, পেয়ারা উৎপাদনে ৮ম, সার্বিক ফল উৎপাদনে ১০ম, গবাদি পশু উৎপাদনে ১২তম স্থান অধিকার করে ঈর্ষণীয় অবস্থায় রয়েছে।

কোভিড-১৯ এবং ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে পৃথিবীর বহুদেশ যখন অত্যন্ত নাজুক পর্যায়ে পড়ে পথ হাতড়ে বেড়াচ্ছে উত্তরণের পথ খুঁজতে, সেখানে বাংলাদেশ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এগিয়ে চলছে তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে। বঙ্গবন্ধু তার ৩ বছর ৭ মাস ৩ দিন স্থায়ী শাসনব্যবস্থায় বাংলাদেশের উন্নয়নের যে পথ দেখিয়ে গিয়েছিলেন, তার সুযোগ্য কন্যা সেই পথেই অগ্রসর হয়ে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ গঠন করে বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করেছেন। রবীন্দ্রনাথ বাঙালির কৃষ্টি ও মননের উৎকর্ষ সাধনের যেমন সব কালেই প্রাসঙ্গিক তেমনি বঙ্গবন্ধুও বাঙালির জীবনমানের উন্নয়নে সাফল্য অর্জনে সব কালেই প্রাসঙ্গিক থাকবেন-তার কন্যা শেখ হাসিনা অক্লান্ত পরিশ্রম করে অনন্য এক বাংলাদেশ বিনির্মাণ করে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর প্রয়াস তৈরির মাধ্যমে আমাদের সেই পথই দেখিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন, যার ফলে ব্রিটিশ গবেষকদের মতে বিশ্বের বৃহৎ অর্থনীতিতে বর্তমানে ৩৪তম স্থানে অবস্থিত বাংলাদেশ ২০৩৭ সালে হয়ে উঠবে ২০তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ, যার জিডিপির আকার হবে ১.৬২ ট্রিলিয়ন ডলার।

লেখক : অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড-এর সাবেক এমডি ও সিইও এবং বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক

কৃষি যুগান্তর

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম