শেয়ারবাজারে দুর্বল কোম্পানির দাপট
বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
শেয়ারবাজারে দুর্বল কোম্পানি খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন। গত এক মাসে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ১১৫ টাকা থেকে বেড়ে ১৬৩ টাকায় উন্নীত হয়েছে। শতকরা হিসাবে আলোচ্য সময়ে শেয়ারটির দাম বেড়েছে ৪২ শতাংশ। যে কোনো বিবেচনায় তা অস্বাভাবিক। একই অবস্থা ওরিয়ন ইনফিউশন, সোনালী পেপার এবং সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের মতো কোম্পানির ক্ষেত্রে। লেনদেন ও দাম বৃদ্ধি দুই খাতেই এগিয়ে রয়েছে এসব কোম্পানি। অর্থাৎ শেয়ারবাজারে দুর্বল কোম্পানির দাপট চলছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৫ আগস্টের পর দেশের অর্থনীতির অন্যান্য খাতে ইতিবাচক পরিবর্তন এলেও ব্যতিক্রম শুধু শেয়ারবাজার। তাদের মতে, বাজারের এই অবস্থার পেছনে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নেতৃত্বের দুর্বলতা দায়ী। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আস্থার সংকট এখনো কাটেনি। এ অবস্থায় সোমবার যৌথভাবে সেমিনার করতে যাচ্ছে বিএসইসি এবং ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। সেমিনারে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত থাকবেন।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বাজারের মূল সমস্যা বিনিয়োগকারীদের আস্থা সংকট। দীর্ঘদিন থেকে এই সংকট চলে আসছে। এর সঙ্গে অর্থনৈতিক বিভিন্ন সংকট, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি এবং জাতীয় রাজনীতিসহ সবকিছু যোগ হয়েছে। ফলে সবার আগে আস্থার সংকট দূর করতে পদক্ষেপ নিতে হবে। এক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আস্থা নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ বিনিয়োগকারীদের এই নিশ্চয়তা দিতে হবে, কারসাজির মাধ্যমে কেউ তার টাকা হাতিয়ে নিলে বিচার হবে। পাশাপাশি ভালো শেয়ারের সরবরাহ বাড়াতে হবে। তবে কাজটি খুব সহজ নয়।
শেয়ারবাজারে কোম্পানির লেনদেন ও শেয়ারের দাম ওঠানামা পর্যালোচনা করেছে যুগান্তর। সেখানে দেখা গেছে, গত সপ্তাহে যেসব কোম্পানির শেয়ারের দাম বেশি বেড়েছে সব দুর্বল কোম্পানি। শীর্ষ দশে থাকা ৩টিই জেড ক্যাটাগরির কোম্পানি। অর্থাৎ দীর্ঘদিন এসব কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের কোনো ধরনের লভ্যাংশ দেয়নি। এমনকি বার্ষিক সাধারণ সভাও করে না। এর মধ্যে রয়েছে-শ্যামপুর সুগার, বিডি ফাইন্যান্স এবং মেট্রো স্পিনিং। এছাড়াও রয়েছে-এনভয় টেক্সটাইল, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, টেকনো ড্র্যাগ, ক্রাউন সিমেন্ট, এশিয়াটিক ল্যাব, মিডল্যান্ড ব্যাংক এবং সামিট অ্যালায়েন্স পোর্টের মতো কোম্পানি।
গত সপ্তাহে ৫ কার্যদিবসে ডিএসইতে ৫ হাজার ৭৪৮ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। প্রতিদিনের গড় লেনদেন ছিল ১১ হাজার ৪৯৬ টাকা। আগের সপ্তাহে ৩ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছিল। প্রতিদিনের গড় লেনদেন ছিল ৭০১ কোটি টাকা। এ হিসাবে আলোচ্য সপ্তাহে লেনদেন কমেছে ২ হাজার ২৪৩ কোটি টাকা। প্রতিদিনের গড় লেনদেন কমেছে ৪৪৮ কোটি টাকা। ডিএসইর মূল্যসূচক ৭৩ পয়েন্ট কমে ৫ হাজার ৪৪৯ পয়েন্টে নেমে এসেছে।
এদিকে যেসব কোম্পানির শেয়ার বেশি লেনদেন হয়েছে সেগুলোও দুর্বল। এর মধ্যে রয়েছে-খান ব্রাদার্স পিপিওভেন ব্যাগ ইন্ডাস্ট্রিজ, সামিট পোর্ট অ্যালায়েন্স লিমিটেড, রবি আজিয়াটা, এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিস, টেকনো ড্র্যাগ, ওরিয়ন ইনফিউশন, সোনালী পেপার, লাভেলো আইসক্রিম, সীপার্ল হোটেল এবং ইনফরমেশন সার্ভিস নেটওয়ার্ক। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শেয়ারবাজারে অন্যতম একটি সমালোচিত খাত ব্লক মার্কেট। এখানে গ্যাম্বলারদের (কারসাজিতে জড়িত) নিয়ন্ত্রণ বেশি। কোন কোম্পানির শেয়ারে কারসাজি হবে, ব্লক মার্কেট থেকে প্রাথমিক একটি ধারণা পাওয়া যায়। কারণ গত ১০ বছরে এখানেই বেশি কারসাজি হয়েছে। কিন্তু গত এক মাসের হিসাব বলছে, এখানেও দুর্বল কোম্পানির আধিপত্য। এর মধ্যে রয়েছে-খান ব্রাদার্স পিপিওভেন ব্যাগ ইন্ডাস্ট্রিজ, ব্র্যাক ব্যাংক, এশিয়াটিক ল্যাব, ফাইনফুডস, প্রিমিয়ার ব্যাংক, ওরিয়ন ইনফিউশন, প্যারামাউন্ট টেক্সটাইল, সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স, মারিকো বাংলাদেশ এবং রবি আজিয়াটা লিমিটেড। বাজার পরিস্থিতি সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলেছে যুগান্তর। সব পক্ষের সম্মিলিত কথা হলো অদক্ষ নেতৃত্ব এই বাজারকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৫ আগস্টের পর আর্থিক খাতের সব জায়গায় সংস্কার এসেছে। কিন্তু এখনো সংস্কারের ছোঁয়া লাগেনি শেয়ারবাজারে। তাদের মতে, এ খাতে সংস্কারে ৪টি বিষয় জরুরি। এগুলো হলো-সদিচ্ছা, জ্ঞান, চাপমুক্ত থাকা এবং গুণগতমানের নেতৃত্ব। কিন্তু বর্তমান কমিশনের সদিচ্ছা থাকলেও শেয়ারবাজারের মতো টেকনিক্যাল খাতের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা নেই। সরকার ও প্রভাবশালীদের পক্ষ থেকে বড় ধরনের চাপ নেই। কিন্তু নেতৃত্বের দুর্বলতা বিশাল আছে।
সরকার গঠিত শ্বেতপত্র কমিটির রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে-গত ১৫ বছরে শেয়ারবাজার থেকে এক লাখ কোটি টাকা আত্মসাৎ হয়েছে। জালিয়াতি, কারসাজি এবং ভুয়া কোম্পানি তালিকাভুক্তির মাধ্যমে নেওয়া হয়েছে এ টাকা। এক্ষেত্রে আর্থিক খাতের প্রভাবশালী উদ্যোক্তা গোষ্ঠী, ইস্যু ম্যানেজার, নিরীক্ষক ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কারসাজির চক্র গড়ে উঠে। বিএসইসি এ ব্যাপারে তাদের দায়িত্ব পালন এবং বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। অর্থনীতির অবস্থা মূল্যায়নে গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। তবে এখনো ওই অবস্থার খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, ৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হলে পরপর কয়েকদিন ইতিবাচক হয় বাজার। তবে তা ধরে রাখা যায়নি। এ সময়ে বিএসইসিতে পরিবর্তন আসে। একজন চেয়ারম্যানকে নিয়োগ দিয়ে পরেরদিন আবার পরিবর্তন করা হয়। পরবর্তী সময়ে বর্তমান কমিশন নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা একেবারেই অনভিজ্ঞ। বাজারের ব্যাপারে তাদের কোনো ধারণা নেই। নতুন উদ্ভাবন তো দূরের কথা, অনেক পরিভাষাই তারা বোঝেন না। এছাড়াও নতুন কমিশনের বেশ কিছু সিদ্ধান্ত ছিল বিতর্কিত।
