|
ফলো করুন |
|
|---|---|
কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) আমাদের জাতীয় কবি। নানা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি সবার কবি হয়ে উঠেছিলেন। তথাপি কষ্টের দহনে তার শিশুমন কখনো ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। আঠারো বছর বয়সে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সৈনিক হিসাবে যোগ দেন। যুদ্ধ শেষে ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন। কোনো সরকারি চাকরি গ্রহণ না করে সাহিত্যচর্চা করবেন সিদ্ধান্ত নেন। কলকতায় ফিরে ‘সাহিত্য সমিতি’র অফিসে ওঠেন। সমিতির সম্পাদক মুজফফর আহমদ লেখাসূত্রে পূর্বপরিচিত ছিলেন। সেখানে পরিচয় হয় পুস্তক ব্যবসায়ী আলী আকবর খানের সঙ্গে। একদিন তারই আমন্ত্রণে ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের মার্চে নজরুল কুমিল্লা আসার পথে ট্রেনে লিখেন ‘নীলপরী’ নামে শিশুতোষ কবিতা। এর আগে সমিতির অফিসে বসে আলী খানেরই তাগাদায় নজরুল লেখেন প্রথম শিশুতোষ কবিতা ‘লিচু চোর’। বলে রাখি, নজরুলের শিশু-কিশোর বয়সি মনোরাজ্যে তোমরা কেউ যদি হাজির হতে চাও, আনন্দ নিতে চাও, তাহলে পড়তে হবে তার ছড়া ও কবিতা। যেমন-নজরুলের ‘খুকী ও কাঠবেড়ালি’ কবিতাটি শিশু-কিশোর সবার প্রিয়। পেয়ারা গাছের ডালে চঞ্চল কাঠবেড়ালি লেজ উঁচিয়ে কুচুম মুচুম করে পেয়ারা খাচ্ছে আর সেই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে খুকী তাকে প্রশ্ন করছে। যে প্রশ্নগুলো তার শিশু মনের মতোই কৌতূহলী, সরল মনের। যেমন:
‘কাঠবেড়ালি! কাঠবেড়ালি! পেয়ারা তুমি খাও?/গুড়-মুড়ি খাও? দুধ-ভাত খাও? বাতাবি নেবু? লাউ?/বেড়াল-বাচ্চা? কুকুর-ছানা? তাও?
ডাইনি তুমি হোঁতকা পেটুক!/খাও একা পাও যেথায় যেটুক!/বাতাবি নেবু সকলগুলো!/একলা খেলে ডুবিয়ে নুলো!/তবে যে ভারী লেজ উঁচিয়ে পুটুস পুটুস চাও?/ছোঁচা তুমি! তোমার সঙ্গে আড়ি আমার! যাও!’
নজরুলের ‘লিচু-চোর’ নামের কবিতাটিও সবার প্রিয়। বলা হয়েছে, কুমিল্লা ও দৌলতপুরে অবস্থানকালে নজরুল একাধিক বিখ্যাত শিশুতোষ কবিতা লিখেছেন। যেমন-‘খাঁদু-দাদা’, ‘ঝিঙে ফুল’, ‘খোকার বুদ্ধি’, ‘খোকার গল্প বলা’, ‘মা’, ‘মুকুলের উদ্বোধন’, ‘লাল সালাম’ ইত্যাদি সব মজার মজার ছড়া ও কবিতা।
‘খোকার সাধ’ কবিতায় প্রতিটি শিশু-কিশোর মনের মাঝে বড় হওয়ার সাধ বপন করে। কবিতাটিতে শিশুর প্রশ্ন বড়দের মনেও স্বপ্ন জাগায়। আগামীর ভবিষ্যৎ সুন্দর হবে, এই আশাবাদী করে তোলে মা’কে। যেমনক্স
‘আমি হব সকাল বেলার পাখি/সবার আগে কুসুম-বাগে উঠব আমি ডাকি।
সুয্যিমামা জাগার আগে উঠব আমি জেগে-/‘হয়নি সকাল, ঘুমো এখন’-মা বলবেন রেগে।’
কিংবা
‘বলব আমি, ‘আলসে মেয়ে ঘুমিয়ে তুমি থাক,/হয়নি সকাল-তাই বলে কি সকাল হবে না’ক?
আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে?/তোমার ছেলে উঠলে গো মা রাত পোহাবে তবে!’
নজরুল আমাদের ‘সংকল্প’ করতে শিখিয়েছেন। ঘর ছেড়ে বের হয়ে এই পৃথিবীকে জয় করতে বলেছেন। স্কুলপড়ুয়া এমন কোনো ছেলেমেয়ে নেই, যারা জীবনে কোনো ভালো কাজের জন্য সংকল্পবদ্ধ না হয়। আর কী অবাক ব্যাপার, আজ থেকে শতবছর আগে নজরুল লিখেছেন, ‘বিশ্বজগৎ দেখবো আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে।’ বলা বাহুল্য, আজকের প্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের যুগে মোবাইল মানে পৃথিবী আমাদের হাতের মুঠোয়। কবি, শিল্পী, সাহিত্যিকরা এভাবে স্বপ্ন দেখায় বলেই আবিষ্কারকরা, ভ্রমণপিপাসু অনুসন্ধানীরা মহৎ আবিষ্কারগুলো প্রতিদিন করে চলেছেন। বলা যায়, নজরুল তার শিশুতোষ ছড়া ও কবিতায় রেখে গেছেন ভবিষ্যতের শিশু-কিশোরদের জন্য দিগ্বিজয়ের শপথ, উৎসাহ, উদ্দীপনা।
নজরুলের প্রথম ছাপার অক্ষরে শিশুতোষ গ্রন্থ ‘ঝিঙে ফুল’। এই বইয়ের ‘প্রভাতী’ কবিতাটিতে শিশু মনের রয়েছে সবচেয়ে প্রিয় অনুপ্রাস। আছে তাৎপর্য। যেমন-‘ভোর হলো দোর খোল/খুকুমনি উঠোরে/ওই ডাকে জুঁই শাখে/ফুলখুকি ছোটরে’ প্রকৃতিতে ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে জেগে ওঠার কথাটা কেবল জাগতিক নয়, কবি এই কথার মাধ্যমে সবসময় জেগে উঠার, জেগে থাকার বিষয়টি শিশু মনেই প্রবিষ্ট করিয়ে দিচ্ছেন। এই যে রঙের রঙিন জগৎ, ফুলের, প্রজাপতির, কাঠ-বেড়ালির, সুয্যিমামার, সকাল বেলার পাখির জীবন-এই সময় চিরদিন থাকে না। শিশু-কিশোর যারা, তাদের বয়স বাড়ে ঠিক, কিন্তু মনের বয়স বাড়তে দিতে না চাইলে নজরুলের শিশু-কিশোর উপযোগী ছড়া-কবিতা অনুশীলন নিত্যপ্রয়োজন। নজরুল বর্তমান প্রজন্মকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছেন এই স্বপ্ন চিরশিশু, চির-কিশোরের।
নির্ঝর আহমেদ প্লাবন
নজরুলের শিশু-সাহিত্য
কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) শিশুসাহিত্যে তোলপাড় সৃষ্টি করেছেন। তিনি মনের দিক থেকে শিশুর মতো সরল ছিলেন। শিশুদের সঙ্গে যখন তিনি মিশতেন, তখন সব যুক্তি এবং বুদ্ধিকে একপাশে রাখতেন। তাদের একজন হয়ে যেতেন। শিশুরা তাকে দেখলেই গল্প এবং কবিতা শোনার আবদার করত। বেড়াতে যাওয়ার আবদার থাকত। নজরুল কোনো শিশুকে কখনো নিরাশ করতেন না। কেউ ডাকত ‘ভাইজান’ কেউ ডাকত ‘পাগলা পথিক’। বড়রা কেউ কেউ তাকে ‘দুখু মিয়া’ নামেও ডাকত। সব ডাকেই তিনি সাড়া দিতেন।
শিশু হাসে, কাঁদে। কখনো বিজ্ঞতার ভাব ধরে। কখনো আবার হাবাগোবা হয়ে যায়। নিজ মনের বিরুদ্ধে শিশু কিছু করে না। এজন্যই হয়তো ‘শিশুরা সত্যদ্রষ্টা’। কোনো প্রলোভন তাদের নড়াতে পারে না। শৈশবের বাঁধাবন্ধনহীন নজরুলের স্বপ্ন-সাধ, আশা-আকাঙ্ক্ষা ফুটে উঠেছে তার শিশুতোষ কবিতায়। তরুণ নজরুল স্কুল ছেড়ে যুদ্ধে যোগ দিয়েছেন। তার কবিতাতেও শিশুর যুদ্ধে যোগদানের স্বপ্ন আছে-
মাগো! আমি যুদ্ধে যাব/নিষেধ কি মা আর মানি?
রাত্তিরে রোজ ঘুমের ঘোরে/ডাকে পোল্যান্ড জার্মানি।
রাইফেলকে ভয় করে কে/বগলদাবা এয়ারগান,
এক গুলিতে উড়িয়ে দিতে/পারি কত মিয়ার কান।
নজরুল শিশু সাহিত্যে তাই জাগরণের দিকটি প্রাধান্য পেয়েছে। কবি যেমন করে দেখেছেন, শিশুরাও কবির চোখ দিয়ে নিজের, জাতির এবং সমাজের ভবিষ্যৎ দেখে পুলকিত। হাস্যরসের অন্তরালেও কবি মূলত সেই কথাই বলেছেন। ‘হোঁদল-কুঁৎকুঁতের বিজ্ঞাপন’ কবিতায় প্রচণ্ড ভণিতা এবং হাস্যরসের মধ্যে হঠাৎ করে তিনি ব্রিটিশবিরোধী চেতনা নিয়ে এলেন। যিনি ব্রিটিশ মানসে ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ হাওয়া বইয়ে দিয়েছিলেন। বীর বাদলকে এক ওসিলায় শিশুদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। উদাহরণ টানা যাক-
বীর বাদল সে দেশের তরে প্রাণ দিতে ভাই যে শিখে,/আন্বে যে সাত-সাগর-পারের বন্দিনী দেশ-লক্ষ্মীকে!
কেউ যদি ভাই হয় তোমাদের এমনিতরো মর্দ ফের,/হো হো! তাকে পাঠিয়ে দেব বাচ্চা হোঁদল্ কুঁৎকুঁতের!
কাজী নজরুল ইসলামের এমন অনেক কবিতা আছে যেগুলো কিশোর, তরুণ, যুবা, শিশু সবার সমমানের পছন্দের। সবাই মনে করে কবিতাটি বোধহয় তার জন্য, তার বয়সের লোকদের জন্য লেখা হয়েছে। সবাই সমভাবে নির্যাস গ্রহণ করতে পারে। বিষের বাঁশি, জিঞ্জির, নতুন চাঁদ, শেষ সওগাত এমনকি চক্রবাক কাব্যেও এমন কবিতা আছে। অগ্রন্থিত কবিতাগুলোতে এ জাতীয় লেখা পাওয়া যায়। নজরুল তাতেও স্বতন্ত্র। নজরুলের শিশুতোষ গ্রন্থগুলোর মধ্যে ঝিঙেফুল (১৯২৬), সাত ভাই চম্পা (১৯২৭), পুতুলের বিয়ে (১৯৩৩), মক্তব সাহিত্য (১৯৩৫), সঞ্চয়ন (১৯৫৫), পিলে পটকা পুতুলের বিয়ে (১৯৬১), ঘুম জাগানো পাখি (১৯৬৪), ঘুম-পাড়ানী মাসি-পিসী (১৯৬৫), জাগো সুন্দর চির কিশোর (১৯৯১) প্রভৃতি। নজরুল সৃষ্ট শিশুসাহিত্যের পরিমাণ কম নয়। কিন্তু সমালোচকরা সেদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করছেন না। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের শিশুসমাজ।
নজরুলের সমকালে বা পূর্বে শিশুসাহিত্যিকরা সমাজের অন্যায়-অত্যাচারের প্রতি ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে লিখেছেন। সুকুমার রায় সমাজের অসংগতিগুলো তুলে ধরেছেন। একই কাজ সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত করেছেন। তিনি অন্যদের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন সাম্যবাদের বিষয়টি তুলে ধরে। উপেন্দ্রকিশোরও সেই কাজ করেছেন। রবীন্দ্রনাথও বাদ যাননি। কিন্তু নজরুলের সঙ্গে তাদের বড় পার্থক্য হলো নজরুল ব্যঙ্গ বিদ্রুপের পর সমাজ গঠনের পথ দেখিয়েছেন; অন্যরা তা করতে পারেননি। সমগ্র শিশুকে একত্রিত করে এক বৃন্তে নিয়ে আসার মধ্যেই নজরুলের শিশুসাহিত্যের সফলতা।
