বিশেষ রচনা: তোমাদের জন্য
কাজী নজরুল ইসলামের শিশুসাহিত্য
লোকমান হোসেন জীবন
প্রকাশ: ৩০ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) সাহিত্য রচনার মাধ্যমে ছোট-বড় সবার মন জয় করেছিলেন। তিনি শিশুমনের ভাবনাগুলো সাহিত্যে সহজ ভাষায় ফুটিয়ে তোলেন। তার লেখা শিশুসাহিত্য আনন্দদানের সঙ্গে সঙ্গে শিশুদের সুন্দর মনন গঠনে ভূমিকা রেখেছে। শিশুর কল্পজগৎ, প্রকৃতি, জানার আগ্রহ, ইচ্ছা, মান-অভিমান, শিক্ষামূলক, হাস্যরস ইত্যাদি বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে নজরুলের শিশুসাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে।
নজরুল শিশুদের জন্য গান, কবিতা ও নাটিকা লিখেছেন। এ বিষয়ে তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ-ঝিঙেফুল, পুতুলের বিয়ে, জাগো সুন্দর চির কিশোর প্রভৃতি। এ ছাড়া তার লেখা সঞ্চায়ন, শেষ সওগাত, ঝড়, মক্তব সাহিত্য প্রভৃতি গ্রন্থে ছড়িয়ে আছে বেশকিছু শিশুদের উপযোগী সাহিত্য। ঝিঙেফুল কবিতাগ্রন্থের সব কবিতাই সফল ও কালজয়ী শিশুসাহিত্য হিসাবে প্রসিদ্ধ। এ গ্রন্থের উল্লেখযোগ্য কবিতা- ‘ঝিঙেফুল’, ‘লিচুচোর’, ‘খুকী ও কাঠবেড়ালি’, ‘প্রভাতি’, ‘সংকল্প’, ‘মা’, ‘হোঁদল কুৎকুতের বিজ্ঞাপন’ ইত্যাদি।
শিশুদের জন্য লেখা সাহিত্যের জগতে ‘ঝিঙেফুল’ কবিতায় নজরুলের সৌন্দর্যবোধের অপূর্ব ছবি ফুটে ওঠে। বাড়ির আঙিনায় বেড়ে ওঠা অতিসাধারণ এক সবজি লতায় ফোটা ফুলকে কবি কাব্যিক মহিমায় রাঙিয়ে তোলে। শিশুমনে দোলায়িত ভাষা ও ছন্দে কবি লিখেছেন-
ঝিঙে ফুল! ঝিঙে ফুল!
সবুজ পাতার দেশে ফিরোজিয়া ফিঙে-কুল
ঝিঙে ফুল।
‘লিচুচোর’ নজরুলের লেখা সরল ও সুন্দর একটি কবিতা। শিক্ষামূলক কবিতা হিসাবে এ কবিতাটি ছোট-বড় সবার কাছে বেশ জনপ্রিয়। ‘খুকী ও কাঠবেড়ালি’ কবিতাটি শিশুমনে দোল দিয়ে যায়। শিশুদের কল্পজগৎ আলোড়িত করে এ কবিতায় ফুটে ওঠা সরল গল্পে। একটি পেয়ারার লোভে খুকী নানাভাবে কাঠবেড়ালির সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করে-
কাঠবেড়ালি! কাঠবেড়ালি! পেয়ারা তুমি খাও?
গুড়-মুড়ি খাও? দুধ-ভাত খাও? বাতাবি নেবু? লাউ?
বেড়াল-বাচ্চা? কুকুর-ছানা? তাও?
নজরুলের লেখা শিশুসাহিত্যের মধ্যে ‘প্রভাতি’ শিশুমনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছে। এ কবিতার বিষয়, ভাষা, ছন্দ শিশুদের হৃদয়ে আনন্দ ও সুন্দরের অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। এ কবিতাটি শিশুদের জন্য রচিত জাগরণী কবিতা। ভোরে ঘুম থেকে শুধু জেগে ওঠাই এ কবিতার প্রতিপাদ্য বিষয় নয়। জীবনে আলোর প্রয়োজন। তাই অলসতা ভেঙে জীবনে অফুরন্ত আলো আনার আহ্বান জানানো হয়েছে শিশুদের। ‘প্রভাতি’ কবিতায় কবি লিখেছেন-
ভোর হলো দোর খোলো
খুকুমণি ওঠ রে!
ঐ ডাকে জুঁই-শাখে
ফুল-খুকি ছোটরে!
‘সংকল্প’ কবিতায় প্রকৃতির রহস্য ভেদ করা এবং বিশ্বকে জানার অদম্য ইচ্ছা প্রকাশ পেয়েছে। এ কবিতায় কবি পৃথিবীকে আপন হাতের মুঠোয় পুরে দেখতে চেয়েছেন। শিশুদের স্বপ্ন দেখিয়েছেন উন্নত আগামীর। এ কবিতার সাফল্য এই যে, শিশুদের কবি যে স্বপ্ন দেখিয়েছেন এবং যে কল্প জগতে বিচরণ করিয়েছেন তা আজ বাস্তব। স্মার্ট ফোনের সাহায্যে আমরা এখন আপন হাতের মুঠোতে বিশ্বজগৎ দেখছি। এ বিষয়ে কবি লিখেছেন-
পাতাল ফেড়ে নামব নীচে,
ওঠব আবার আকাশ ফুঁড়ে
বিশ্ব-জগৎ দেখব আমি
আপন হাতের মুঠোয় পুরে।
ঝিঙেফুল কবিতাগ্রন্থ ছাড়াও নজরুলের লেখা শিশুসাহিত্যের ভান্ডার বেশ সমৃদ্ধ। ছোটদের জন্য তার লেখা গানের সংখ্যাও কম নয়। প্রজাপতির রঙিন ডানায় শিশুদের যে আকর্ষণ তা শিশুর চোখে দেখে নিয়েছেন কবি। মনের মাধুরি মিশিয়ে লিখেছেন-
প্রজাপতি প্রজাপতি
কোথায় পেলে ভাই এমন রঙ্গীন পাখা
টুকটুকে লাল নীল ঝিলিমিলি আঁকাবাঁকা ॥
পুতুলের বিয়ে গ্রন্থে রয়েছে ছোটদের জন্য লেখা বেশকিছু নাটিকা। উল্লেখযোগ্য নাটিকা-‘পুতুলের বিয়ে’, ‘নবার নামতা পাঠ’, ‘জুজুবুড়ীর ভয়’, ‘কে কি হবি বল’, ‘সাত ভাই চম্পা’ প্রভৃতি। এ ছাড়া তার লেখা ‘পণ্ডিত মশায়ের ব্যাঘ্র শিকার’, ‘সত্যরক্ষা’, ‘জাগো সুন্দর চির কিশোর’ ইত্যাদি নাটিকা শিশুদের সুন্দর মনোজগৎ গঠনে বেশ সহায়ক। মূলত সমগ্র শিশুকে এক বৃন্তে এনে প্রস্ফুটিত করাই ছিল কাজী নজরুল ইসলামের শিশুসাহিত্যের মূল সফলতা।
