ক্রীড়াঙ্গনে দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশের উদ্যোগ
২০১০-২৫ সাল পর্যন্ত সব দুর্নীতির খতিয়ান তুলে ধরা হবে
মোজাম্মেল হক চঞ্চল
প্রকাশ: ২০ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
দেশের ক্রীড়াঙ্গনে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে হওয়া দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে ক্রীড়াঙ্গনে হওয়া দুর্নীতিরও তদন্ত করা হবে। শ্বেতপত্রে ২০১০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত সব দুর্নীতির খতিয়ান তুলে ধরা হবে। ফুটবলসংশ্লিষ্ট প্রভাবশালী এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, প্রত্যেকটি ক্রীড়া ফেডারেশনে একটি ছায়া কমিটি করা হচ্ছে। অনেকটা ছায়া মন্ত্রিসভার মতো। ছায়া কমিটির কাজ হবে সংশ্লিষ্ট ফেডারেশনের কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করে একটি রিপোর্ট তৈরি করা। দেশের প্রত্যেকটি ক্রীড়া ফেডারেশনসহ সরকারের ক্রীড়া সংস্থাগুলোকে শ্বেতপত্রের আওতায় আনা হবে। বিশেষ করে বিসিবি ও বাফুফের প্রতি আমাদের নজরদারি থাকবে বেশি। বিশ্বকাপ ক্রিকেট আয়োজন, স্টেডিয়াম সংস্কার ও নির্মাণ খাতে অনিয়মসহ অন্যান্য ব্যাপারেও কাজ করছে ছায়া কমিটি।
তিনি যোগ করেন, ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। কোথাও কোনো সাফল্য নেই। চারদিকে শুধু ব্যর্থতা আর লুটপাট। পতিত সরকারের অনুসারী ক্রীড়া সংগঠকরা নিজেদের মধ্যে কোন্দল করেই খেলাধুলার বারোটা বাজিয়েছেন। বাফুফেতে ছিল কোন্দল, ঝগড়া। আগামীতে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে আমরা ক্রীড়াঙ্গনের সব দুর্নীতি ও লুটপাটের বিচার করব। কাউকেই রেহাই দেওয়া হবে না। বাংলাদেশ ক্রীড়া সংগঠক পরিষদের প্রভাবশালী নেতা আবদুল্লাহ আল ফুয়াদ রেদোয়ান বলেন, এ সরকারের সময়ে বিসিবির নির্বাচনসহ জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ, যুব অধিদপ্তরসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এগুলোও আমলে এনে তদন্তের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কাজ করা হবে।
এদিকে, যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের চেয়ারম্যান হিসাবে আসীন হয়ে কয়েকজন কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করেছিলেন। যাদের মধ্যে অন্যতম এনএসসি চেয়ারম্যানের একান্ত সচিব রশিদুজ্জামান সেরনিয়াবাত। সেই চেয়ারে অস্থায়ী ভিত্তিতে বসানো হয় চেয়ারম্যানের আস্থাভাজন মো. সাইফুল ইসলামকে। এক বছরের কম সময়ের মধ্যে চেয়ারম্যানের একান্ত সচিবের নামেও ক্রীড়াঙ্গনে ভেসে বেড়াচ্ছে অনেক অভিযোগ। বিশেষ করে ফেডারেশনের কমিটি গঠনে আর্থিক লেনদেন, বিদেশ ভ্রমণ-সবই তার নিয়ন্ত্রণে বলে অভিযোগ ক্রীড়াসংশ্লিষ্টদের। যদিও অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সাইফুল ইসলাম। তার কথা, ‘আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠতেই পারে। তবে তার কোনো ভিত্তি নেই। এর বেশি আমি কিছু বলতে চাই না।’
যদিও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়ে আসিফ মাহমুদ বলেছিলেন, ‘শুধু ফেডারেশনের চেয়ারে রদবদল নয়, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের অবশ্যই বিচার করব। যা হবে তদন্তের মাধ্যমে।’ কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের কর্মীদের পুনর্বাসন করা হয়েছে ক্রীড়াঙ্গনে। শুধু তাই নয়, সংস্কার ছাড়াই এখন ক্রীড়াঙ্গনে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে বলছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। অথচ সংস্কারের জন্য সার্চ কমিটি করেছে। সেই কমিটির পর আরেক কমিটি হয়েছে। এরপরও হচ্ছে না সংস্কার। বিচার দূরে থাক, তদন্তই হয়নি কোনো দুর্নীতির। কাবাডি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক এসএম নেওয়াজ সোহাগের বিরুদ্ধে গত পাঁচ বছরে আওয়ামী লীগের নেতাদের ছত্রছায়ায় কাবাডি ফেডারেশনে তার প্রতিষ্ঠান অ্যাডটাচ লিমিটেডের কার্যক্রম ও লেনদেন এবং সাধারণ সম্পাদক পদে আসীন হতে অনৈতিক লেনদেনের অভিযোগ ছিল। এসব নিয়ে মিডিয়ায় বিস্তর খবর আসায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল ক্রীড়া পরিষদ। কিন্তু অদৃশ্য ইশারায় সেই তদন্ত পরে বাতিল করে দেয় দেশের ক্রীড়াঙ্গনের সর্বোচ্চ সংস্থাটি।
কোটি কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগে চাকরিচ্যুত হয়েছেন যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টার সাবেক এপিএস মোয়াজ্জেম হোসেন। কিন্তু আজও সেই তদন্ত রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেনি। দেশের দুই বড় ফেডারেশন ফুটবল ও ক্রিকেটে অনিয়ম ও দুর্নীতি এখন ওপেন সিক্রেট।
বাফুফের সাবেক সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের ১৬ বছরে ফুটবলে অনেক আর্থিক অনিয়ম হয়েছে। গত বছর ৫ আগস্টের পর দেশের ক্রীড়াঙ্গন সংস্কারের জন্য সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু পুরোপুরি সংস্কারের আগেই সার্চ কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। জেলা, বিভাগ ও ক্রীড়া ফেডারেশনে অ্যাডহক কমিটি গঠন এবং গঠনতন্ত্র সংস্কারের জন্য গঠিত সার্চ কমিটি তেমন কোনো কাজ করার সুযোগ পায়নি। সংস্কারের জন্য বিভিন্ন ফেডারেশনের অ্যাডহক কমিটির যেসব তালিকা সার্চ কমিটি জমা দিত, তা ক্রীড়া পরিষদে গিয়ে আমূল পালটে যেত। এ প্রসঙ্গে সার্চ কমিটির চেয়ারম্যান জোবায়েদুর রহমান রানা বলেন, ‘যে উদ্দেশ্যে সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছিল, আমরা তার ৯০ ভাগ কাজ গুছিয়ে এনেছিলাম। ক্রীড়া ফেডারেশনগুলোর গঠনতন্ত্র সংস্কারের কাজটি প্রায় শেষ পর্যায়ে ছিল। কিন্তু আমাদের কাজ করতে দেওয়া হয়নি।’ বর্তমান সরকারের মেয়াদের শেষ সময়ে এসে নড়েচড়ে বসেছেন জাতীয়তাবাদী দল সমর্থক ক্রীড়া সংগঠকরা। ফ্যাসিস্ট আমলের দুর্নীতির সঙ্গে বর্তমান আমলেরও দুর্নীতির ফিরিস্তি তুলে ধরে শ্বেতপত্র প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শ্বেতপত্রে ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে), বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডসহ (বিসিবি) বিভিন্ন ক্রীড়া ফেডারেশনের দুর্নীতির চিত্র এতে স্থান পাবে।
১/১১-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের দুর্নীতি নিয়ে তদন্ত করা হয়েছিল। সাবেক যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী ফজলুর রহমান পটলসহ প্রশাসনের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির সুস্পষ্ট প্রমাণ পেয়েছিল তদন্ত কমিটি। ওই সময়ে ১১১ কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগে মামলাও হয়েছিল। সাবেক ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী ফজলুর রহমান পটল পৌনে ২ বছর জেলে ছিলেন। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সাবেক পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) নুরুল হক প্রধানও দুর্নীতির অভিযোগে চাকরিচ্যুত হন। ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ক্রীড়া প্রশাসনে বড় ধরনের দুর্নীতি ও লুটপাট না হলেও বিভিন্ন ক্রীড়া ফেডারেশনে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে বিসিবি ও বাফুফের বিরুদ্ধে অভিযোগটি বেশ শক্ত।
