দিয়াবাতেকে দলে কেন অন্তর্ভুক্ত করা হবে না, বাফুফেকে কারণ দর্শানোর নোটিশ
প্রকাশ: ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ১১:৪৫ এএম
ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
এ মুহূর্তে বাংলার মেসিখ্যাত হামজা দেওয়ান চৌধুরীকে পেয়ে ফুটবলজ্বরে গোটা দেশ। তলানিতে যাওয়া সালাউদ্দিনযুগের ফুটবল অবসান ঘটিয়ে গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। আমরা ক্রিকেট ভুলে ফুটবলে মেতে উঠেছি। আর সেটি শুরু হয়েছে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ইংল্যান্ড প্রবাসী হামজা দেওয়ান চৌধুরী বাংলাদেশে আশার পর থেকেই। কেবল হামজাই নন, প্রবাসী আরও কয়েকজন ফুটবলারকে আগামী সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে ম্যাচে খেলানোর প্রয়াস চালাচ্ছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)।
কানাডা প্রবাসী সামিত সোম, ইতালিয়ান সিরিডিতে খেলা ফাহামেদুল ইসলাম, ইংলিশ ক্লাব সান্ডারল্যান্ডে খেলা কিউবা মিচেলকে জাতীয় দলে ভেড়াতে ভালোই তোড়জোড় চালাচ্ছেন বাফুফের কর্মকর্তারা। সব মিলিয়ে এ মুহূর্তে দেশের ফুটবলে একটা জোয়ার শুরু হয়েছে। আর বাফুফে প্রবাসী ফুটবলার নিয়ে আসার উদ্যোগ গ্রহণ করায় ফুটবলপ্রেমীরাও যারপরনাই ভীষণ খুশি।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশি খেলোয়াড় হিসাবে অভিষেক হয়েছে হামজার। গত ২৫ মার্চ এএফসি বাছাইয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে হামজার অভিষেক হয়। তার আগমনে বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমী দশর্করা ভীষণ খুশি ও অভিভূত। যদিও সেই ম্যাচটি ড্র হয়েছে, কিন্তু হামজা দেওয়ান ছিলেন দর্শকদের চোখে সেই ম্যাচের সেরা খেলোয়াড়। ফুটবলপ্রেমীরাও হামজাকে দশে দশ মার্ক দিয়েছেন।
আবার সেই ম্যাচ ঘিরে দর্শকরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াও দেখিয়েছেন। এর মূল কারণ হলো—ভালো খেলেও ম্যাচটি ড্র করা, সেই সঙ্গে প্রস্তুতি ম্যাচে গোল পাওয়া ইতালি প্রবাসী ফাহামেদুলকে বিদায় করে দেওয়া। জানা যায়, কোচের দ্বিমুখী বক্তব্যে চলে ফাহামেদুল নাটক।
-680f158eabad5.jpg)
ফাহামেদুল অনেক প্রতিভাবান খেলোয়াড় হিসাবে উল্লেখ করেছেন কোচ কাবরেরা। সে দলের সঙ্গে এক সপ্তাহ অনুশীলন করেছে, এটা তার জন্য ভালো হয়েছে। জাতীয় দলে নেওয়ার জন্য তাকে আরও দেখতে হবে। আসলে সে এখনো তরুণ আর বয়স কম, বাকিদের সঙ্গে মানিয়ে নিতে তার আরও সময় লাগবে।— এটি ছিল কোচের বক্তব্য। অথচ সৌদি আরবে প্রস্তুতি ম্যাচে ফাহামেদুল গোল পাওয়ার পরও ওই বক্তব্য দিয়ে অজুহাত দেখিয়ে ভারতের বিপক্ষে রাখা হয়নি তাকে। শেষ পর্যন্ত স্প্যানিশ কোচ হাভিয়ের কাবরেরা তাকে ইতালিতে পাঠিয়ে দেন।
এ নিয়ে বেশ কয়েক দিন আলোচনা-সমালোচনা হলেও সেই সময় ভবিষ্যতে তাকে নেওয়া হবে কিনা, সে রকম কোনো প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায়নি কোচের কাছ থেকে। তবে এ সমালোচনা দীর্ঘদিন চলার পর গত ২৩ এপ্রিল বাফুফে জাতীয় দলের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভাশেষে মিডিয়া কমিটির চেয়ারম্যান আমিরুল ইসলাম বাবু বলেন, ‘ফাহামেদুলকে নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা বলেছি তাকে দলে নিতে। কোচ যদি মনে করেন কোনো খেলোয়াড়কে নেওয়া যেতে পারে, সেখানে ফেডারেশন হস্তক্ষেপ করবে না।
ফাহামেদুল দলে ডাক পাচ্ছেন, তা আগভাগেই জানালেন মিডিয়া কমিটির চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, ‘ফাহামেদুল জাতীয় দলের ক্যাম্পে যোগ দেবে। কোচকে বলেছি, তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। আমরা কিছু চাপিয়ে দিইনি। ৩১ মে জানা যাবে কোন কোন খেলোয়াড়কে ডাকা হবে।
এদিকে বাফুফেতে ফুটবল নিয়ে নাটক শেষ হয়নি। ফাহামেদুলকে দলে অন্তর্ভুক্তি করা না করার সমালোচনায় জাতীয় দলের অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়ার ভারত ম্যাচে একাদশে না রাখার বিষয়টি চাপা পড়ে যায়। সেই সঙ্গে চাপা পড়ে যায় ঈসা ফয়সালকে দলে না রাখা নিয়েও।
এ মুহূর্তে জামাল ভূঁইয়া দেশসেরা ডিফেন্ডার। তার বিকল্প তিনিই; কোচের প্রতিহিংসামূলক আচরণ আর অগোছালো পরিকল্পনাবিহীন একাদশ ভারত ম্যাচে নামানোই দলের বাইরে ছিলেন জামাল ভূঁইয়া। তার ফলও পেয়েছে বাংলাদেশ। অথচ কোন অদৃশ্য ভূত চেপে বসে কোচের ওপর, যার কারণে তাকে বাদ দিয়ে একাদশ সাজানো হয়েছিল তা ফুটবলপ্রেমীরা বুঝতে সক্ষম। বিষয়টি পরিষ্কার—বাফুফেতে এখনো দোসরদের আধিপত্যের প্রভাব কাজ করছে। তা না হলে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচের ফল ভিন্ন হতে পারত। আর সেই সঙ্গে আগামী ১০ জুন সিঙ্গাপুরের ম্যাচেও জামাল ভূঁইয়া যে উপেক্ষিত থাকবেন তা একরকম পরিষ্কার।
অথচ আমাদের জাতীয় দলের মূল যে সমস্যা তা নিয়ে আমরা কেউ-ই মাথা ঘামাচ্ছি না। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে আমরা খুব ভালো খেলেছি। কিন্তু ম্যাচটি ড্র হয়েছে। ম্যাচে পরিষ্কার চিত্র ফুটে উঠেছে—আমাদের একজন ফিনিশারের অভাব। এ ম্যাচ দেখার পর ঠিক মনে করিয়ে দেয়— নব্বই দশকের ঢাকা লিগের কথা। পুরো দাপিয়ে খেলছে মোহামেডান, আর ম্যাচ জিতছে আবাহনী। সার্বক্ষণিক আবাহনীর গোলপোস্টে মোহামেডানের হাতে বল, কিন্তু দিনশেষে জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ছে আবাহনী।
বাফুফের ফুটবলকর্তারা কি গত ১৫ বছরে তলানিতে যাওয়া ফুটবলে একজন স্ট্রাইকার আসলামকে পেয়েছেন, যে মোহামেডানের জালে টুপ করে বল ঢুকিয়ে দিতেন? একজন সুযোগসন্ধানী নকীবকে পেয়েছেন, যে আবাহনীর ডিফেন্সের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতেন?
সেই সময় স্ট্রাইকার নকীবকে বলা হতো— সুযোগসন্ধানী ফুটবলার। মোহামেডানের হয়ে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতেন তিনি। কিন্তু আজ তা নেই। গত ১৫ বছরেও আমরা একজন সুযোগসন্ধানী নকীব পাইনি কিংবা একজন আসলাম। পাইনি গোলমেকার সাব্বির, গাউস, মামুন জোয়ার্দার, আলফাজদের মতো কাউকে। তাদের খেলা এখনো চোখের কণায় ভাসে। আর ডিফেন্ডার মোনেম মুন্নার মতো ফুটবলার পাওয়ার কথা তো দূরের...।
না আমি বলছি না যে, আমরা সে রকম ফুটবলার পাব না বা পাইনি— একজন সাব্বিরকে তো আমরা অবশ্যই পেয়েছি। আজকের ডিজিটাল যুগে যদি সাব্বির খেলতেন, তবে তিনিও ইউরোপের লিগে খেলতেন।
যাই হোক, এ মুহূর্তে আমরা সাব্বিরকে (হামজা) পেলেও কিন্তু একজন সুযোগসন্ধানী নকীব কিংবা আসলামকে কি পেয়েছি? ভারত ম্যাচে রক্ষা পেলেও সিঙ্গাপুর ম্যাচে এই সুযোগসন্ধানীর অভাবে আমাদের কপাল পুড়েও যেতে পারে, তা কি একবারও বাফুফের ফুটবলবোদ্ধারা ভেবেছেন? এমন ঘটনা যদি ঘটে যায়, তবে বুক চাপড়ালেও পরে আর সেই সমস্যার সমাধান করা যাবে না।
এদিকে প্রবাসী যাদের নিয়ে আমরা দলের শক্তি বৃদ্ধির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, তাদের কাউকে দেখছি না একজন সুযোগসন্ধানী নকীব আছেন কিংবা একজন আসলাম। অথচ আমরা হাত বাড়ালেই পেতে পারি একজন সুযোগসন্ধানী নকীব।
দীর্ঘদিন ঢাকা লিগে খেলছেন মালির ফুটবলার সুলেমান দিয়াবাতে। যে কিনা এর আগে ফেডারেশন কাপের ফাইনালে আবাহনীর মতো দলের বিপক্ষে একাই করেছেন ৪ গোল। আর বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে নতুন এক অবিশ্বাস্য রেকর্ড নিজের করে নিয়েছেন এ ফুটবলার। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে এক ক্লাবের হয়ে ১০০ গোলের রেকর্ড একমাত্র সুলেমান দিয়াবাতের। মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে ২০১৯ সালে যোগ দেন সুলেমান দিয়াবাতে। তিনি এখন পর্যন্ত মোহামেডানের হয়ে ১২১ ম্যাচে ১০৭ গোল করেছেন।
যদি আমি ভুল কিছু না বলি, তবে দেশি-বিদেশি ফুটবলারদের মধ্যে সুলেমান দিয়াবাতেই একমাত্র ফুটবলার, যিনি এক ক্লাবের হয়ে ১০০ গোলের মাইলফলক ছুঁয়েছেন। তাকে অনায়াসে বলা যায় মোহামেডানের জীবন্ত কিংবদন্তি। অথচ আমরা চাইলেই তাকে নাগরিকত্ব দিয়ে জাতীয় দলে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি।
আমাদের দলের প্রধান যে ঘাটতি, সেই ফিনিশারের সমস্যার সমাধান হতে পারে সুলেমান দিয়াবাতে। আমাদের দেশের হয়ে খেলতে তার আগ্রহ রয়েছে। এর আগে গণমাধ্যমের এক সাক্ষাৎকারে সেই আগ্রহের কথা জানিয়েছেন এ ফুটবলার। তিনি চাইলেও তো আমাদের দেশের হয়ে খেলতে পারেন না, সে জন্য বাফুফেকে এগিয়ে আসতে হবে। আমার মনে হয় না, তাকে নাগরিকত্ব দিলে তিনি দেশ বিক্রি করে চলে যাবেন। আর তাই যদি হতো, তাহলে ১৯৯৭ সালে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত আইসিসি ট্রফি জয়ের পর ক্রিকেটে বিশ্বকাপে খেলার ছাড়পত্র পায় কোচ গর্ডন গ্রিনিজের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল।
কোচের ভূমিকায় সাফল্য অর্জনে সেই সময় গর্ডন গ্রিনিজ একটা সবুজ পাসপোর্ট পেয়েছিলেন। সেই পাসপোর্ট ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ তুলে দিয়েছিল তার হাতে—আইসিসি ট্রফি জিতে বিশ্বকাপে খেলার ছাড়পত্র পাওয়ার আনন্দে। টেস্ট মর্যাদার সুযোগ তৈরি হওয়ার আনন্দে। পরে ২০০৪ সালের দিকে আবারও বাংলাদেশে এসে গ্রিনিজ নবায়নও করেছিলেন সেই সবুজ পাসপোর্ট। গ্রিনিজ কি বাংলাদেশটাকে বিক্রি করে দিয়ে গেছেন?
আসলে তা নয়, বরং আমাদের জাতীয় স্বার্থে সুলেমান দিয়াবাতেকে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। একবার ভেবে দেখুন— আমরা একজন স্ট্রাইকারের অভাবেই ভারতের ম্যাচটি জিততে পারিনি। আর ভারত থেকেও শক্তিশালী দল সিঙ্গাপুর। ফিফা র্যাংকিংয়েও এগিয়ে, সিঙ্গাপুর ১৬১ নম্বরে আছে। বাংলাদেশ আছে ১৮৩-তে। তাই আমরা যদি ভালো একজন ফিনিশারকে ছাড়াই আবার ভারতের মতো সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে মাঠে নামি, তবে তা হবে জেনেশুনে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। আফসোসে পুড়তে হবে ফুটবলপ্রেমীদের। তাই দ্বিধাদ্বন্দ্ব, তুচ্ছতাচ্ছিল্য আর হিংসাত্মক রাজনীতি পরিহার করে দলমতের ঊর্ধ্বে থেকে আমরা সুলেমান দিয়াবাতেকে দলে অন্তর্ভুক্ত করে নির্ভার থাকতে পারি। তাকে দলে অন্তর্ভুক্ত করতে বেশি সময়ও লাগবে না। কারণ একবার ভেবে দেখুন— এ মুহূর্তে সুলেমান দিয়াবাতে দেশসেরা স্ট্রাইকার।
এ ছাড়া আমরা যেসব প্রবাসীকে দলে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য তোড়জোড় করছি, তা অল্পসময়ে সবাইকে পাওয়া সম্ভব নয়; বিশেষ করে সামিত সোম। তাকে পেতে গেলে আগে ফিফার অনুমোদন প্রয়োজন। আমার মনে হয় না, সেই অনুমোদন এত অল্পসময়ের মধ্যে আমরা পেয়ে যাব। সে ক্ষেত্রে আমাদের ফাহামেদুল কিংবা কিউবা মিচেলকে নিয়ে মাঠে নামতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো— সবাই হামজা দেওয়ানের মতো স্কিলসমৃদ্ধ গুড় পারফরমার নয় যে, দলে যোগ দিলেন, আর দ্রুতই মানিয়ে নিলেন। সে ক্ষেত্রে সুলেমান দিয়াবাতেকে দলে অন্তর্ভুক্ত করলে এ সমস্যা থাকবে না। কারণ এ স্ট্রাইকার বাংলাদেশের প্রত্যেক খেলোয়াড়কে চেনে এবং জানে—ঢাকা লিগে সবার সঙ্গে খেলছেন। সবার সঙ্গে খেলায় তার সমন্বয়ের কোনো ঘাটতি থাকার কথা নয়—এমনকি কোচকেও বলে দিতে হবে না— তোমার কাজ কী?
তাই সুলেমান দিয়াবাতেকে জাতীয় দলে কেন অন্তর্ভুক্ত করা হবে না, বাফুফের কাছে কারণ দর্শানোর নোটিশ— আমরা সুলেমান দিয়াবাতেকে ফিনিশার হিসাবে জাতীয় দলে দেখতে চাই। আমরা নির্ভার থাকতে চাই— কে আসবে কে আসবে না, কাকে পাব আর কাকে পাব না; তার ওপর নির্ভর করে বসে না থেকে ঘরে থাকা দেশসেরা স্ট্রাইকারকে দলে অন্তর্ভুক্ত করে নির্ভার থাকতে চাই। তাই দেশের স্বার্থে সুলেমান দিয়াবাতেকে জাতীয় ফুটবল দলে অন্তর্ভুক্ত করা যায় কিনা তা কর্মকর্তাদের দ্রুতই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত এবং ফুটবলপ্রেমীদের জানানো উচিত।

