কলম্বোতে লিটনের দৃষ্টিই বলে দিচ্ছে ‘যাত্রা থেমে আছে’— সংগৃহীত ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ছোট্ট পরিসংখ্যান দেখে শুরু করি—টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর বাংলাদেশ খেলেছে ১৫৪ ম্যাচ। হেরেছে ১১২টি। জয় ২৩টিতে আর ড্র ১৯টি। পরাজয়ের হার ৭৩ শতাংশ। এতটুকু জানার পর কারো হয়তো জ্যোতিষ হতে হবে না এটা বলতে যে, দুই যুগ পেরিয়ে টাইগাররা এখন কোথায়! তাও যদি শঙ্কা থাকে, তা মিটে যেতে পারে কলম্বো টেস্ট দেখলেই।
কলম্বোতে শ্রীলংকার বিপক্ষে যখন বাংলাদেশ ধুঁকছিল, তখন দেশে মহাসমারোহে চলছে টেস্ট স্ট্যাটাসের রজতজয়ন্তী। তার দুদিন পরই বেরিয়ে এলো ‘আসল’ রূপ। বয়সের ভারে যেন নুয়ে পড়া এক পঁচিশ বছরের বৃদ্ধ! যার মেদটাই বেড়েছে, শরীরটা কংকালসার। এ যেন টাইগারদের টেস্ট ইতিহাসের আখ্যান।
আত্ম-বিশ্লেষণের অভিব্যক্তির শেষটা যে ‘ইয়া নফসি, ইয়া নফসি।’ না পারার পেছনে যথেষ্ট কারণও আছে। কিন্তু তাই বলে এমন অন্তসারশূন্য হবে কেন? একই ভুল, একই সমস্যা বারবার কেন?
নাজমুল হোসেন শান্ত ব্রিগেড প্রসেসে আছেন, চেষ্টা করেছিলেন—তবে পারেননি। ব্যর্থ হওয়ার পর এমন স্বীকারোক্তি এসেছে বহুবার। কখনো কর্তাব্যক্তিদের দিকে আঙুল তোলা হচ্ছে, কখনো দায় গিয়ে পড়ছে মাঠ কিংবা পিচের দিকে। কখনো আবার অকপটে স্বীকার করে নেওয়া হচ্ছে, ‘আমরা আসলে পারি নাই!’
না করেও উপায় কি! আত্ম-বিশ্লেষণের অভিব্যক্তির শেষটা যে ‘ইয়া নফসি, ইয়া নফসি।’ না পারার পেছনে যথেষ্ট কারণও আছে। কিন্তু তাই বলে এমন অন্তসারশূন্য হবে কেন? একই ভুল, একই সমস্যা বারবার কেন?

শ্রীলংকায় যেহেতু টাইগাররা ইনিংস ও ৭৮ রানে হেরেছে, তাহলে আরেকটা পরিসংখ্যান দেখি— এই বৃত্ত সেই ২০০০ সালে শুরু, এখনো চলছে। বাংলাদেশ তাদের ইতিহাসের প্রথম টেস্টটি হেরেছিল ৯ উইকেটের অনেকটা সম্মানজনক ব্যবধানে। পরে যদিও অনেকবারই ইনিংস ব্যবধানের হার দেখা গেছে, তাই বলে ২৫ বছর পর এসেও দেখতে হবে ইনিংস ব্যবধানে হার? হার আসতেই পারে, কিন্তু লড়াইটাও তো লড়তে হবে। তা কই। এতদিন পর এগোলো কোথায়, এ-তো রীতিমত উলটো যাত্রা!
আরও আছে, সেদিন ভারতের বিপক্ষে চার দিনেই হেরেছিল বাংলাদেশ, আজও পঞ্চম দিনে এগিয়ে নিতে পারেনি ম্যাচ। যার ফলে হারটা বেশ দৃষ্টিকটুই বটে। এবার হিসেব-নিকেশের খেরোখাতা নিয়ে বসি—২০০০ সালে ১০ দলের মধ্যে দশ নম্বর দল হিসেবে টেস্ট খেলছিল বাংলাদেশ। এখন ১২ দলের মধ্যে নবম। অঙ্ক কষে বলতে পারবেন, কতদূর এগোলো বাংলাদেশ? নাকি সেই জায়গাতেই পড়ে আছে? একটু এদিক সেদিক হতে পারে, সুযোগ-সুবিধায় বদল আসলেও টেস্ট ক্রিকেটে সেখানেই পড়ে বাংলাদেশ।
এই প্রশ্ন তোলার সঙ্গে আরেকটা পরিসংখ্যান দেখি—টাইগাররা এখন পর্যন্ত যত টেস্ট হেরেছে তার বেশিরভাগ ম্যাচে নূন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বীতাই করতে পারেনি। ১১২ হারের প্রায় অর্ধেক হেরেছে ইনিংস ব্যবধানে। ৪৭ বার প্রতিপক্ষের এক ইনিংসের রান দুই ইনিংস মিলিয়েও শোধ দিতে পারেনি বাংলাদেশের ব্যাটাররা। আরও আছে। এই হারগুলোর মধ্যে ১০ উইকেট ব্যবধানের হার আছে ৬টি। দুশ রানের বেশি ব্যবধানে হারও কম নয়।

এবার খেরোখাতায় কাটাকুটি করুন—এতদিনে টেস্টে কোথায় দাড়িয়ে বাংলাদেশ!
নানা অসঙ্গতি আছে অবশ্য। অবহেলা আছে, বোর্ড কর্তাদের গাফিলতি আছে, রয়েছে অনুশীলনের সুযোগ-সুবিধা, বেতন কাঠামো নিয়েও আলোচনা হয় প্রায়ই। বিসিবি সেটি ঠিক করার পথেও আছে। করছে। তবে মূল সমস্যা আসলে কোথায়? এই ফল-পরিসংখ্যান, এমন হারের ব্যাখা কি?
কয়েকটি কারণ খুঁজে ফেরা যায়—খেলোয়াড়দের মানসিকতা, টেস্ট খেলতে অনাগ্রহ, বিসিবি পরিচালকদের আখের গোছানো সিদ্ধান্ত এবং ঘরোয়া ক্রিকেটে অপরিপক্কতা। টেস্ট ক্রিকেটে দুই যুগ পেরোনো বাংলাদেশকে এসবই পেছনে টানছে। বাজে আম্পায়ারিং, খেলোয়াড় বাছাই, ঘরোয়া ক্রিকেটে সুদৃষ্টির অভাব, আঞ্চলিক ক্রিকেটে অনিহা এবং বোর্ডের একচেটিয়া স্বভাব। দায় দেওয়ার অনেক জায়গা আছে। তবে সবচেয়ে বড় দায়টা যে খেলোয়াড়দেরই!
শান্ত-মিরাজরা চেষ্টা করেন, অবকাঠামো নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, বেতন-ম্যাচ ফি বাড়ানোর আবেদন করেন—কিন্তু নিজেকে গোছাতে ততটা যেন মনোযোগী হন না। একই ভুল বারবার করেন। ব্যর্থ হলে একটা উপায় অবশ্য এখানে আছে। দোষ চাপানো যায়। লিটন চাপিয়েছেন, তাইজুল ইসলাম চাপিয়েছেন, শান্ত দুষেছেন। হয়তো আরও অনেকে চাপাবেন।

এই চাপাচাপিতে চিড়েচ্যাপ্টা হচ্ছে বাংলাদেশ ক্রিকেট, এ নিয়ে কেউ যেন মাথা ঘামান না। শান্তদের দায় দেওয়া স্বভাব আর হার রুখতে চাওয়ার বাসনাই টেস্টের এ অবস্থার জন্য দায়ী। যারা হারা রুখতে চায় তারা জিতবে কিভাবে!
টেস্টে ২৫ বছর পূর্তিও যেন আটকে আছে এখানেই। সাহসিকতা, মানসিকতা এবং লড়াকু মনোভাব কোনোটির অভাব থাকলে পিছিয়ে যেতেই হবে। গল টেস্টের পর কলম্বোতে যেমনটা বুঝিয়ে দিল শান্ত ব্রিগেড, তারা এখনো টেস্টে শিক্ষানবিস! শিখছেন! ২৫ বছর ধরে ছাত্ররা এখনো শেখার জন্যই টেস্ট খেলেন, জেতার জন্য নয়!
