তানভির-মোস্তাফিজ ম্যাজিকে রুদ্ধশ্বাস জয়, সিরিজে টিকে রইল বাংলাদেশ

ক্রীড়া প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২৫, ১১:০১ পিএম

ফলো করুন |
|
---|---|
বাউন্ডারি লাইন পেরিয়েই জানিথ লিয়ানাগে তীব্র আক্রোশে হেলমেট আর গ্লাভস ছুঁড়ে ফেললেন মাটিতে। কারণ তিনি জেনে গেছেন, আগের বলের ছক্কাটার মূল্য এখন শূন্য, তার লড়াকু ৭৮ রানের ইনিংসটার মূল্যও তাই। মোস্তাফিজুর রহমান পুরো ম্যাচে ছিলেন উইকেটশূন্য, ম্যাচের শেষ অঙ্কে এসে খাতাটা খুললেন মহামূল্য এক কাটারে। ম্যাচের সব অনিশ্চয়তাও মুছে গেছে ওই বলেই।
তার পর তানজিম সাকিব, কিংবা তার আগের তানভির ইসলামের দারুণ স্পেল… সবকিছুর মিশেলে বাংলাদেশের হাতে ধরা দিল অমূল্য এক জয়। কতটা অমূল্য? ৭ মাস আর ৭ ম্যাচ পর একটা জয় যেমন অমূল্য হয় দলের কাছে। ১৬ রানের এই এক রুদ্ধশ্বাস জয় সিরিজে টিকে থাকার টনিকও পাইয়ে দিয়েছে বাংলাদেশকে। সিরিজে এখন ১-১ সমতা। তিন ম্যাচের লড়াইয়ের ফয়সালা তাই কলম্বোতেই হয়ে গেল না। পাল্লেকেলে সফর পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে দুই দলকেই।
প্রেমাদাসার উইকেটে ২৪০ রান তাড়া করাটা কতটা কঠিন, সেটা বাংলাদেশের চেয়ে ভালো আর কে জানে? পুঁজিটা ২৪৮ রানের, আধুনিক ক্রিকেটের বিচারে তা কম হলেও দ্বিতীয় ওয়ানডেতে মুহূর্তের জন্যও কম মনে হয়নি অধিনায়ক মেহেদী হাসান মিরাজের। ম্যাচশেষে তা বলেও গেলেন তিনি।
তবে সময়ে অসময়ে লঙ্কানরা চোখরাঙানি কম দেয়নি। তিনে নামা কুশল মেন্ডিস যেভাবে খেলছিলেন, সেটা তো টি-টোয়েন্টির বিচারেও কম ভালো নয়। ৩১ বলে করে বসলেন ৫৬! ওপাশে নিশান মাদুশকার যোগ্য সাহচর্য পেলেন। শ্রীলঙ্কা রান তাড়া করতে নেমে চোখের পলকে তুলে ফেলল ৭৫, তাও দশম ওভার শেষ হওয়ার আগেই! এমন পরিস্থিতি দুশ্চিন্তার বৈকি!
আগের দুই ওভারে ২২ রান দিয়ে গিয়েছিলেন। তানভির ইসলাম তার খেল দেখানো শুরু করলেন এরপর। প্রথমে মাদুশকা, এরপরের ওভারে ডেঞ্জারম্যান মেন্ডিসকে দেখালেন সাজঘরের পথ।
শ্রীলঙ্কার টুঁটিটা এরপরই চেপে ধরলেন অধিনায়ক মিরাজ। না, বোলিং দিয়ে নয়, অধিনায়কত্ব দিয়ে। উইকেটে স্পিন ধরছে, বিষয়টা যেই না বুঝলেন, আক্রমণে নিয়ে এলেন নিজেকে, সঙ্গে রাখলেন শামীম হোসেন পাটোয়ারীকে, যার বোলিংয়ের কারিশমাটা এতদিন অনাবিষ্কৃতই থেকে গিয়েছিল। দুজন মিলে ১৪ থেকে ২৫, এই ১১ ওভারে দিলেন মোটে ৩৭ রান। শ্রীলঙ্কার চাপটা বাড়ছিল ক্রমেই। উপরি পাওনা হিসেবে আগের ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান চারিথ আসালঙ্কার উইকেটটাও তুলে নিলেন শামীম। কাজটা ধীরে ধীরে সহজ হয়ে আসছিল বাংলাদেশের।
দুজন নিজেদের স্পেলের শেষ কয়েক ওভারে রান দিচ্ছিলেন বেশ। নিজেকে সরালেন। আনলেন তানভিরকে। সে সিদ্ধান্তটাও কাজে লেগে গেল। প্রথম ওভারেই তানভির পকেটে পুরলেন আরেক বিপদ কামিন্দু মেন্ডিসের উইকেট। একটু পর ভেল্লালাগেও হলেন তার শিকার।
এরপরই প্রতিরোধটা গড়েন লিয়ানাগে। ওপাশে শুরুতে ওয়ানিন্দু হাসরাঙ্গা আর মহেশ থিকসানাকে ফিরতে দেখলেন। দল তখনও জয় থেকে ৭৮ রানের দূরত্বে।
লিয়ানাগে এই প্রতিরোধের জন্য অবশ্য ধন্যবাদ দিতে পারেন জাকের আলীকে। মোস্তাফিজের বলে তার ক্যাচটা যদি নিতে পারতেন জাকের, তাহলে তার ইনিংস শেষ হয়ে যেত ৭৮ রানে; কে জানে হয়তো ম্যাচটাও শেষ হয়ে যেতে পারত আরও ঘণ্টাখানেক আগেই!
সেটা হয়নি বলেই নখ কামড়াতে হয়েছে ম্যাচের ৪৮ ওভার পর্যন্ত। দুশ্মন্থ চামিরাকে সঙ্গে নিয়ে একটু একটু করে ব্যবধানটা কমাচ্ছিলেন। ৪৮তম ওভারের প্রথম বলে যখন ছক্কাটা হাঁকিয়েই আগের ওভারে এক রান দিয়ে যাওয়া মোস্তাফিজকে, তখন মনে হচ্ছিল এই বুঝি শেষ!
এই স্পেলের আগে পুরো ম্যাচে বেদম পিটুনি খাওয়া মোস্তাফিজ তার খেল দেখালেন পরের বলে। মিড উইকেট আর লং অনকে ওপরে রেখেছিলেন, শর্ট লেন্থ থেকে একটা কাটার করলেন লিয়ানাগেকে। সে ফাঁদেই পা গলিয়ে দিলেন লঙ্কান ব্যাটার। অ্যাঙ্গেল করে বেরিয়ে যেতে থাকা বলটা খেলতে চাইলেন লেগসাইডে, আর তাতেই টপ এজড হয়ে ফিরতি ক্যাচ গেল মোস্তাফিজের কাছে। বাংলাদেশের জয়টা নিশ্চিত হয়ে গেছে ওই মুহূর্তেই।
শ্রীলংকান ইনিংসে শুরুর আঘাতটা তানজিম সাকিব হেনেছিলেন। শেষটাও হানলেন তিনিই। দুশ্মন্থ চামিরাকে বোল্ড করে নিশ্চিত করলেন ১৬ রানের রুদ্ধশ্বাস জয়টা।
এর আগে টস জিতে ব্যাট করতে নামা বাংলাদেশের ইনিংসটা রীতিমতো রকেটে চড়ে বসেছিল। শুরুতে তানজিদ আর এরপর শান্তর বিদায়ের পরও দল সমান গতিতে রান তুলছিল পারভেজ হোসেন ইমনের ব্যাটে চড়ে। ৬৯ বলে ৬৭ রানের ইনিংসে তিনি হাঁকিয়েছেন ৬টা চার আর ৩টা ছক্কা।
তার বিদায়ের পর হাল ধরলেন তাওহীদ হৃদয়। তিনি এক পাশ আগলে রাখলেও অন্য পাশে বাংলাদেশ উইকেট খোয়াচ্ছিল নিয়মিত বিরতিতে। মিরাজ, শামীম কিংবা জাকেরদের বিদায়ের পরও ২৭০ কেই সম্ভাব্য স্কোর মনে হচ্ছিল, কারণ উইকেটে তাওহীদ আছেন।
৫১ রানের ইনিংসে দুটো চার মেরেছেন কেবল। রানিং বিটুইন দ্য উইকেটকেই শক্তির জায়গা বানিয়ে খেলেছেন পুরো ইনিংসে। শেষমেশ সেটাই যেন কাল হয়ে দাঁড়াল তার জন্য। একটা বাড়তি রান নিতে গিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হলো। রান আউট হয়ে ফিরলেন হৃদয়। সম্ভাব্য রানের সংখ্যাটা তখন নেমে এল অনেকখানি। সে ওভারে হাসান মাহমুদ আর পরের ওভারে তানভির যখন বিদায় নিলেন, তখন তো ২২০কেও মনে হচ্ছিল দূর আকাশের তারা!
সেখান থেকে দলের রান আড়াইশো ছুঁয়ে গেল প্রায়, সেটা শেষ উইকেটে ৩০ রানের জুটিতে ভর করে। পুরো জুটিতে মোস্তাফিজের অবদান ছিল ৭ বল, রান করেছেন শূন্য। যা করেছেন তাও কম কিছু নয়। সেটাই যে তানজিম সাকিবকে ২১ বলে ৩৩ রানের দারুণ ক্যামিও খেলার সুযোগ করে দিল! তাতে ২৫ বল বাকি রেখে যখন বাংলাদেশ অলআউট হলো, তখন দলের স্কোরবোর্ডে উঠে গেছে বেশ স্বাস্থ্যকর রান। কষ্টেসৃষ্টে হলেও তানভির, শামীম, মোস্তাফিজদের ম্যাজিকে ভর করে সে রানটা শেষমেশ ডিফেন্ডই করল বাংলাদেশ। সিরিজটা তাই জিইয়ে রাখা গেল অন্তত আরও ২ দিন। ফয়সালাটা তবে পাল্লেকেলেতেই হবে।