‘অবহেলিত’ নারী ফুটবলে এবার নজর পড়বে তো বাফুফের?
প্রকাশ: ৩০ জুলাই ২০২৫, ০৩:৫৮ পিএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
শেষ অনেক বছর ধরেই বয়সভিত্তিক পর্যায়ে বেশ সফল বাংলাদেশের ফুটবল। পুরুষদের চেয়ে অবশ্য নারীদের সাফল্যটাই ছিল বেশি। তবে ২০২৫ সালে নারী ফুটবল দল যে উচ্চতায় নিয়ে গেছে নিজেদের, তা নারী ফুটবল অঙ্গনে বাংলাদেশের জন্য অভূতপূর্ব তো বটেই, পুরুষদের ফুটবলও এমন অর্জন ছুঁতে পারেনি বহু দিন ধরে।
নিজেদের ইতিহাসে প্রথম বারের মতো খেলছে এশিয়ান কাপ ফুটবলে। এশিয়ার ফুটবলের সর্বোচ্চ স্তরে বাংলাদেশ পুরুষ দলও চলতি শতাব্দীতে খেলেনি, সবশেষ খেলেছিল ১৯৮০ সালে। বিরলপ্রায় কাজটাই এ বছর করে দেখিয়েছে বাংলাদেশ নারী দল। এছাড়াও, সামনে এসেছে ২০২৭ বিশ্বকাপ ও ২০২৮ অলিম্পিকে অংশগ্রহণের সুযোগ।
এশিয়ান কাপ ফুটবলের প্রথম ৬টি দেশ কোয়ালিফাই করবে ২০২৭ সালের বিশ্বকাপে, এবং প্রথম ৮টি দেশ অংশ নিতে পারবে ২০২৮সালের অলিম্পিকে। এই শতাব্দিতে বাংলাদেশের ফুটবল এত সম্ভাবনাময় জায়গায় এর আগে কখনো পৌছাতে পারে নি।
বাংলাদেশের নারী ফুটবলের আন্তর্জাতিক যাত্রাটা শুরু হয়েছে এই দেড় দশক আগে, ২০১০ সালে। সে বিষয়টা মাথায় রাখলে দলের এ অর্জনকে আরও বড় বলেই মনে হয়। যদি খেলোয়াড়দের আর দেশে নারী ফুটবলের জন্য পরিবেশকে মাথায় রাখা হয়, তাহলে এ অর্জনের মাহাত্ম্য বেড়ে যায় বহুগুণে। অনেক অবহেলা, অনিয়ম, উপেক্ষা আর বৈষম্যের মাঝেও একের পর এক ইতিহাস গড়ে চলেছে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল।
বেশিরভাগ খেলাতেই বাংলাদেশ দৌড়টা বড়জোর আঞ্চলিক পরিসর পর্যন্তই। ফুটবলেরও নিয়তি এই ই ছিল। অন্তত ২০২৫ সালের আগ পর্যন্ত। ১৯৮০ সালে এশিয়ান কাপে খেলার পর থেকে পুরুষ দল আর এই আসরে খেলতে পারেনি। অন্ধের যষ্টি ছিল সাফ, সেখানেও সিনিয়র দল সাফল্য পায় না ২০০৩ সালের পর থেকে।
নারী দল শুরুটা করেছিল এখান থেকেই। সাফের বয়সভিত্তিক পর্যায়ে দলটা সাফল্য পেয়েছে একের পর এক। অ-২০ পর্যায়ে ৫ বারের সাফ চ্যাম্পিয়ন দলটা। সিনিয়র পর্যায়ে প্রথম সাফল্যটা আসে ২০২২ সালে। এরপর ধারণা করা হচ্ছিল এই বুঝি সর্বোচ্চ চূড়াটা ছুঁয়ে ফেলল দলটা। পুরুষদের দলই যেখানে এশিয়ান কাপে খেলতে পারে না ৪ দশকেরও বেশি সময় ধরে, নারী ফুটবল কীভাবে পারবে?
তবে সে ধারণাটাই এবার ভেঙে দিয়েছেন আফইদা খন্দকার, ঋতুপর্ণা চাকমারা। ২০২৪ সাফ জিতলেন মাঝপথে। এরপর এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে মিয়ানমার, বাহরাইন আর তুর্কমেনিস্তানকে হারিয়ে দল চলে গেছে মূল পর্বে, এশিয়ার সর্বোচ্চ স্তরে। এখানেই শেষ নয়, ১২ দলের এই আসরে ভালো করলে দলের সামনে থাকছে বিশ্বকাপ আর অলিম্পিকের মূলপর্বে খেলার হাতছানিও।
তবে এমন সাফল্য পেলেও নারী ফুটবলারদের ভাগ্যে নেই পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা। ফুটবল মূলত ক্লাব কেন্দ্রিক খেলা। সেই খেলায় পুরুষদের জন্য আছে পেশাদার লিগ, একটা সাজানো বর্ষপঞ্জিও আছে, অপ্রতুল হলেও ছেলেদের ফুটবলে ভালো অর্থলাভের উপায় আছে, মাঠ-হোটেল-চুক্তিও আছে।
তবে নারীরা সে ‘অপ্রতুল’ সুযোগটাই পাচ্ছেন কালেভদ্রে। ২০১১ সালে নারীদের লিগ মাঠে গড়ায়, এরপর থেকে ১৪ বছরে লিগ হয়েছে মোটে ৬টি। শেষ ৬ বছরে লিগ হয়েছে ৪টি।
আর লিগ হলেও যে নারী ফুটবলারদের বিশাল অর্থলাভের সুযোগ তৈরি হয়, বিষয়টা তাও নয়। বড় ক্লাবগুলো আগ্রহ দেখায় না, তাই খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিকও থাকে অত্যন্ত কম। যেখানে ছেলেরা বছরে ৪০-৫০ লাখ টাকা পান, মেয়েরা পান দুই-আড়াই লাখ।
সে কারণে নারী ফুটবলারদের রুটি-রুজির প্রধান উৎস বাফুফে থেকে দেওয়া বেতন। তবে সে বেতনও তো সময়মতো পান না ফুটবলাররা। এমনকি ম্যাচ ফি-ও বকেয়া পড়ে থাকে অনেক সময়ই। জাতীয় দলের পুরুষ সহকর্মীদের তুলনায় আমাদের নারী ফুটবলারদের সুযোগ সুবিধা ও ব্যবস্থায় রয়েছে বিস্তর ফারাক।
যে তৃণমূল থেকে নারী ফুটবলারদের বেড়ে ওঠা, সেই তৃণমূলও আছে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। ঋতুপর্ণা চাকমা, মনিকা চাকমাদের মতো দেশসেরা ফুটবলার উঠে এসেছেন যে স্কুল থেকে, সেই রাঙামাটির ঘাগড়া বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়েই সরঞ্জাম সঙ্কটের খবর গণমাধ্যমে এসেছিল মাসখানেক আগে।
সব মিলিয়ে নারী ফুটবলারদের জন্য পথটা মোটেও মসৃণ নয়। সে বন্ধুর পথ মাড়িয়েই দেশকে সফলতার মুখ দেখিয়েছেন তারা, গেয়েছেন নারীর ক্ষমতায়নের জয়গান।
এবার সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এশিয়ান কাপের চ্যালেঞ্জ। গ্রুপটা কঠিনই বটে। বর্তমান চ্যাম্পিয়ন চীন, ৩ বারের চ্যাম্পিয়ন উত্তর কোরিয়া আর উজবেকিস্তান। তবে এখান থেকেও কোয়ার্টার ফাইনালের রাস্তাটা অসম্ভব নয়। অন্তত কোচ পিটার বাটলারের ভাবনা এমনই।
তবে সেজন্যে কিছু পূর্বশর্ত বেধে দিয়েছেন কোচ বাটলার। তিনি পরিষ্কারভাবে বলটা ঠেলে দিয়েছেন বাফুফের কোর্টে। সেসব শর্ত অবশ্য বহু দিন থেকেই শোনা যাচ্ছে নারী ফুটবল অঙ্গনে।
বাটলারের কথা, ‘আমার পরিকল্পনা আছে। তবে সব কিছু নির্ভর করছে বাফুফের অর্থায়নের ওপর। কথা বলা সহজ। আমি বলতে পারি, আমি সৌদি আরবে খেলতে চাই অথবা অন্য কোথাও যেতে চাই। কিন্তু সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আমার হাতে নেই। আমি শুধু অনুরোধ করতে পারি, বাকিটা বাফুফের ব্যাপার। আমি পরিকল্পনা ও কৌশল দিয়ে থাকি, এরপর সব নির্ভর করে কর্তৃপক্ষের ওপর, যাদের অর্থের ব্যবস্থা করতে হবে। আশা করছি, আমরা কিছু প্রস্তুতি ম্যাচ ও প্রীতি ম্যাচ খেলতে পারব।’
বাটলারের পরিকল্পনার বাস্তবতা এবং যৌক্তিকতা রয়েছে। বাংলাদেশের সামনে এ এক অনন্য সুযোগ বৈশ্বিক পরিসরে নিজেদের ফুটবলকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় ভালো ফলাফল আনার অন্যতম পূর্বশর্ত আয়োজক দেশের অনরুপ কন্ডিশনে নিজেদের মানিয়ে নেয়া। সেক্ষেত্রে, দেশের বাহিরে অবশ্যই কন্ডিশন ক্যাম্প আয়োজন করা প্রয়োজন। এছাড়াও, নিজেদের ঝালিয়ে নিতে র্যাংকিং-এ অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থানে থাকা দলগুলির সাথে খেলার অভিজ্ঞতা নেয়ার বিকল্প নেই।
অন্যদিকে, প্রতিযোগিতার আগে দলের মূল খেলোয়াড়দের যেন বড় কোন চোট সৃষ্টি না হয় কিংবা চোট পেলেও তা যেন দ্রুত সারিয়ে তোলা যায় এসব নিয়ে বাফুফের ভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। আর সকল পরিকল্পপনার মূলে রয়েছে বাফুফের আগ্রহ এবং অর্থায়ন। এটি অনুধাবন করেই হয়ত বাটলার বল ঠেলে দিচ্ছেন বাফুফের কোর্টে।
এশিয়ান কাপে ভালো করলে বিশ্বকাপ ও অলিম্পিকের পথ খুলে যাবে। এশিয়ার বাকি দলগুলোর বিবেচনায় প্রথম ছয়ে থাকা বাংলাদেশের জন্য একটি কঠিন চ্যালেঞ্জই বটে, তবে সেরা আটে থেকে অলিম্পিকের টিকিট নেয়াটা চ্যালেঞ্জ হলেও সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া ঠিক হবে না। তবে, এই সম্ভাবনা বাস্তবে রূপ দিতে হলে এখনই বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, সঙ্গে রাখতে হবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাও।

