Logo
Logo
×

খেলা

সোনালি অতীত ধূসর বর্তমান

কোথায় হারিয়ে গেলো সেই ক্লাবগুলো

Icon

মোজাম্মেল হক চঞ্চল

প্রকাশ: ১১ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সোনালি অতীত ধূসর বর্তমান

চলচ্চিত্র অভিনেতা ও সাবেক ফুটবলার দেওয়ান নজরুল ওরফে কাবিলা কৌতুক করে বলে থাকেন, ‘দেশে যখন মানুষ ছিল সাড়ে সাত কোটি, তখন গ্যালারি থাকত পূর্ণ। এখন দেশে ২০ কোটি মানুষ অথচ দেশের অধিকাংশ স্টেডিয়ামের গ্যালারি থাকে শূন্য।’ সত্যিই তাই।

মাঠ কমে যাওয়া, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব, ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসে আসক্তি খেলাধুলা থেকে শিশু-কিশোরদের দূরে সরিয়ে নিচ্ছে। গ্রাম থেকে শুরু করে শহর-নগর অধিকাংশ জায়গাতেই এখন খেলার মাঠের তীব্র সংকট। যৎসামান্য যেগুলো রয়েছে সেগুলোও বেহাত হওয়ার দশা। কোথাও রিকশার গ্যারেজ, কোথাও রাজনৈতিক দলের অফিস করে খেলার সুযোগ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অধিকাংশ স্কুলে মাঠ দূরে থাক, ইনডোর খেলাধুলারও সুযোগ পায় না ছাত্রছাত্রীরা।

সামাজিক অবক্ষয়, আর্থিক সংকট ও রাজনৈতিক কারণে হারিয়ে যাচ্ছে ক্লাবগুলো। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, সারা দেশে পাঁচ হাজার ক্রীড়া ক্লাব বন্ধ হয়ে গেছে। জেলা পর্যায়ে খেলাধুলা নিয়মিত না হওয়ায় ক্লাবগুলো বন্ধ হয়ে যায়। খেলোয়াড়রাও খেলা ছেড়ে বেছে নিয়েছেন অন্য পেশা। কেউ হয়েছেন মুদি দোকানদার, কেউ ভ্যানচালক।

আবাহনী ও মোহামেডানের মতো ঐতিহ্যবাহী দলগুলোও জৌলুস হারিয়েছে। ‘ঐতিহ্য’ শব্দটি এখন কাগজে-কলমে রয়ে গেছে। এই ক্লাবগুলোকে টেক্কা দিয়ে উঠে এসেছে কিংস, ফর্টিজ, লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জ, শাইনপুকুর, গুলশান ইয়ুথ ক্লাব। একসময় ঢাকার মাঠ কাঁপাত ওয়ান্ডারার্স, দিলকুশা, ইস্ট এন্ড ক্লাব, আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের মতো দলগুলো। জায়ান্ট কিলার সেই ক্লাবগুলো এখন সাইনবোর্ডসর্বস্ব হয়ে টিকে রয়েছে। প্রিমিয়ার লিগ, প্রথম বিভাগ লিগে তারা নেই। দ্বিতীয় বা তৃতীয় বিভাগে কোনোভাবে টিকে আছে।

মতিঝিল ক্লাবপাড়ার দলগুলোর হারিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ ছিল জুয়ায় আসক্তি। একটা সময় ছিল, যখন সূর্য ডোবার অপেক্ষায় থাকত ক্লাবপাড়ার জুয়াড়িরা। সূর্য ডুবলেই শুরু হতো রমরমা জুয়ার আসর। বছরছয়েক আগে সূর্য ডোবার অপেক্ষায় থাকতেন না কেউ। রাত-দিন ২৪ ঘণ্টাই চলত জুয়া। একেকটি ক্লাব হয়ে উঠেছিল ক্যাসিনো হাউজ। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে বন্ধ হয় ক্লাবপাড়ার জুয়া। কী চলত না সেখানে! হাউজি থেকে শুরু করে ওয়ানটেন, রকমারি তাসের জুয়াসহ অসামাজিক কার্যকলাপের কথাও শোনা যেত। ক্লাবগুলোয় খেলাধুলার পরিবেশ ছিল না। জুয়া ছিল মুখ্য। খেলাধুলা চালিয়ে টাকা খরচের চেয়ে জুয়ার আসর বসিয়ে টাকা আয় করাই লক্ষ্য ছিল। বিপরীত চিত্রও ছিল। টাকার অভাবে আবার হারিয়ে গেছে নামিদামি অনেক ক্লাবও।

একই দশা অফিসপাড়ার ক্লাবগুলোরও। বিজেএমসি, পিডব্লুডি, ওয়াপদা, সাধারণ বীমা, রেলওয়ে, কাস্টমস, পোস্ট অফিস, চলন্তিকা ও বিআরটিসির মতো ক্লাবগুলো হারিয়ে গেছে। ১৯৬৮ সালে বিজেএমসি লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। তখন অবশ্য তাদের নাম ছিল ইপিআইডিসি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের নাম পরিবর্তন হয়। নাম ধারণ করে বিআইডিসি। ১৯৭৩ সালে দলটি চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। সেবার রানার্সআপ হয়েছিল তিনটি দল-মোহামেডান, আবাহনী এবং ওয়ান্ডারার্স ক্লাব। ১৯৭৯ সালে আবারও লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বিজেএমসি নাম ধারণ করে। ১৯৭৫ ও ১৯৮০ সালে রানার্সআপ হওয়া দলটিতে মালা, টুলু, জাকারিয়া পিন্টু, শেখ মো. আসলাম ও কায়সার হামিদরা খেলেছেন। তারপর হারিয়ে গেল আলোচিত সেই ক্লাব।

ওয়াপদার সঙ্গে এখন কোনো ফুটবলের সম্পর্ক নেই। জৌলুস হারিয়েছে সাধারণ বীমা, পিডব্লুডি। সাধারণ বীমা হকিতে নামটি টিকিয়ে রেখেছে। পাড়ার ক্লাবের মধ্যে ইস্ট এন্ড ক্লাবের অনেক সুনাম ছিল। পাড়ার ব্যবসায়ীরা স্থানীয় তরুণদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ক্লাবটি। এখন একটি নামসর্বস্ব ক্লাবে পরিণত হয়েছে ইস্ট এন্ড ক্লাব। আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের ইতিহাসও কম গৌরবের ছিল না। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া একঝাঁক উচ্ছল-উজ্জ্বল তরুণ মিলে গড়ে তুলেছিলেন ক্লাবটি। লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়ে বেশ সাড়া জাগিয়েছিল আজাদ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত আজাদের কার্যক্রম ছিল। তারপর কোথায় যেন হারিয়ে গেল দলটি। এককালের দাপুটে ক্লাব আজাদ আজ স্রেফ সাইনবোর্ডসর্বস্ব। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সিএন্ডবি ঠিকাদার ও প্রকৌশলীদের অনুদানে গড়ে উঠেছিল পিডব্লুডি ক্লাবটি। মূলত প্রকৌশলীদের খুশি রাখতে ও তাদের সঙ্গে সখ্য গড়ার জন্য ঠিকাদাররা অঢেল টাকা দিতেন। কিন্তু সামর্থ্য অনুযায়ী পিডব্লুডি ফল পায়নি। প্রকৌশলীরাও নিজেদের নাম কামাতে বড় বড় ক্লাবের সঙ্গে জড়িয়ে যান। ফলে কালের গর্ভে হারিয়ে যায় পিডব্লুডির ঐতিহ্য। জাতীয় দলের সাবেক তারকা ফুটবলার হাসানুজ্জামান খান বাবলুর কথা, ‘একটা সময় পাড়া-মহল্লায় অলিগলিতে ক্লাব ছিল। ক্লাবকে কেন্দ্র করে খেলাধুলার পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। এখন খেলাধুলাই নেই। ক্লাবগুলো তাদের অস্তিত্ব হারিয়েছে।’

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম