|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আমাদের মেঘনা নদীর জেলে সফিক মাঝি অনেক দিন ইলিশ খেতে পায় না। তার পোলাপান শাকসবজি, ভাজি-ভর্তা দিয়ে ভাত খায়। অনেক সময় পান্তাপানি খায়। দেনার দায়ে জর্জরিত। সে ইলিশ খাওয়ার একটা বুদ্ধি বের করল। বুদ্ধি বের করলে তো আর হবে না। অপেক্ষা করতে হবে, তাই অপেক্ষা করতে থাকল। নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করে। আল্লাহকে বলে-‘আল্লাহ! নৌকা বোইররা (ভর্তি) মাছ দ্যান! আল্লাহ জাল বোইররা ইলিশ দ্যান! আল্লাহ এমোন পরিমাণ মাছ দ্যান, য্যান্ দেনা মুক্ত অইতাম পারি। আল্লাহ এমন পরিমাণ মাছ দেন, য্যান পোলাইন-ছালাইনগোরে (ছেলে-মেয়েদের) বড় ইলিশ খাওয়াইতাম পারি’। মোনাজাত করে, কিন্তু নৌকা ভরে না, জালও ভরে না, ইলিশ ওঠে। দুই, এক হালি তাও ছোট। দাম বেশি, তাই কোনো রকম খরচের টাকা ওঠে। মাছ পায় না, পায় না, একদিন জোহরের নামাজের আগে বড় এক ইলিশ পেয়ে গেল সফিক মাঝি। প্রায় ৪-৫ কেজি। এ মাছ পেয়েই সে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে চিৎকার করে উঠল। এটা শুনে এবং দেখে নদীর মধ্যে সব জেলে চিৎকার করে জানতে চাইল, ‘কি হইলো সফিক মাঝি, কি হইলো! তোমার কপাল কি খোললো, নাকি কপাল পোড়লো!’
সফিক মাঝি কইলো-‘এট্টা ’রাজা ইলিশ’ পাইছি’।
সফিক মাছ পেয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, এ মাছ সে বিক্রি করবে না। এ মাছ সে সন্তানদের খাওয়াবে। সে মাছটি নৌকার গোলুইয়ের মধ্যে ককসিটের বাক্সে বরফ দিয়ে লুকিয়ে রাখল। আরও কয়েকটি ছোট ছোট ইলিশ মাছ পেল। সেগুলো বিক্রির সিদ্ধান্ত নিল।
এদিকে সফির বড় ইলিশ পাওয়ার খবর বাতাসের মতো ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ল। সে জাল তুলে ঘাটের দিকে নৌকা ছাড়ল। ঘাটে গিয়ে দেখে শত শত ক্যামেরা, সাংবাদিক, ইউটিউবার, কন্টেন্ট ক্রিয়েটর। সবাই জানতে চাইল, সফিক মাঝি আপনি নাকি ৪-৫ কেজি ওজনের এক ইলিশ পেয়েছেন।
সফিক মাঝি বলেন-‘কে কইছে, আমি কোনো ইলিশ পাইনো, য্যা পাইছি, এই। দ্যাহেন কি পাইছি’। সফিক মাঝি তিন ছেলে, এক ভাতিজা নিয়ে নদীতে যায়। সে নিজের ছেলে রাশেদকে খুচরা ছোট মাছগুলো নিয়ে আড়তে বিক্রি করতে পাঠায়। আর ক্যামেরাওয়ালাদের বলেন, ‘আপনারা যান। কোনো ইলিশ নাই’। মিডিয়া কর্মীরা মুখ বেজার করে সরে এলো।
আর ছেলেকে বলল-সে যেন আসার পথে সবার জন্য মুড়ি কিনে আনে। ছেলে মাছ বিক্রি করতে যায়।
এমন সময় সফিক মাঝির দালাল আসে। রফিক দালাল। দালাল মানে আড়তদার। দালাল বলেন, ‘কিগো সফিক মাঝি, আমনে বলে বড় ইলিশ পাইছেন, ফেসবুক গাড়ি গেছে। কই মাছ, দেহি’।
সফিক মাঝি বলে, ‘মিয়া মাছ এককান পাইছি, তয় হেইয়ান বেইচতামনো, আঁর পোলাপান এই বছর ইলিশ মাছ খায়নো, মনেরে বুজদি হালাইছি। বেইচতামনো’।
দালাল বলে, ‘ভালা কোইচসোত, বেচতিনো, তয় দেইকতামতো পারি, নাকি হেও দেহাতিনো’।
সফিক মাঝি বলে, ‘আমনে কোইলে না দেহাই পারুমনি, কিন্তুক দেহাইতাম চাইনো, মাছ দেইখলে স্বাদ কমি যায়, আমনেতো জানেন যে, আমি দেহাইননা মাছ বাড়িত নেই না’।
দালাল বলে, ‘ হেতো জানি, তয় আমারে না দেহাছ, ভালা কতা, এই বেডাগোরেতো দেহাবি, বড় বড় চ্যানেলের সাংবাদিক আইছে’।
রফিক দালাল লাফ দিয়ে সফিকের নৌকায় ওঠে। মাছঘাটে নৌকা নোঙর করা। তারপরও নৌকা দুলে ওঠে। সফিকের ছেলে তখনো মাছ বেচে আসেনি। সফিকের বাড়ি মাঝের চর। কয়েক ভাঙার পরে চরের খাস জমিতে ঘর করে বসত করে। সফিক মাঝি দালালকে লক্ষ করে বলেন, ‘এই সাংবাদিকগোরে মাছ দেহাইলে আমগো কি লাভ। নদীত কি মাছ বাড়বো। বাহিনী আর সাংবাদিকরাইতো আমগোরে শ্যাষ করছে। নদীত মাছ নাই, কয় ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ, অবৈধজাল কারখানায় উৎপাদন করে, হেনে বন্ধ করোনের নাম নাই, জাইল্যাগো জাল পুড়িদি, আমগোরে ফতুর করে। গুরখা বাহিনী, জাইল্যাগো বিষমারে’।
দালাল একটু কঠিন সুরে কথা বলেন, ‘সফিক মাঝি! তুমিতো জানো নদীতে মাছ নাই, ঢাকার মোকাম আক্ করি রোইছে। য্যা পাডাই সব জাটকা। এহোন এটট্টা বড় মাছ পাইছো, হেইডা না বেচলে দেনা শোধ দিবা কেমনে!
আমিতো পুনজি খাডাইছি দুইডা পোইসার আসায়, নাকি!’
দালাল নদীর চারদিক তাকিয়ে দাড়িতে হাত বুলায়। সফিক মাঝির কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে-এইবার মাছটা দেহি। পরে সিদ্ধান্ত লমু, ব্যাচপা কি, ব্যাচপা না’। কথা বলে সফিকের উত্তর আশা না করে দালাল গলুইয়ের মধ্যে নামে। ককসিটের বাক্সটা বের করে। মাছটা দেখে একটু জোরেই বলে, ‘আলহামদুলিল্লাহ! ওরে সফিক মাঝি, তুই কোন দান বাজাইছোত। এই মাছের দাম কতো ওটপো জানোছ!’
সফিক মাঝি দালালকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আমনে জানেন না, আমার জবান এক’।
দালাল বাক্সটা ঢেকে গলুইয়ের তল থেকে উঠে আসে। কানে কানে সফিক মাঝিকে আবার বলে, ‘হোন! মন দিয়া হোন, জবান মাঝে মাঝে বাঙতে অয়। হোন-মাছটা বেইচচালা, ভালা দাম পাবি, এই ‘রাজা ইলিশ’ আমার দালালি জীবনে দেহিনো, আমি ঢাকায় কতা কই, তরে ভালা দাম পাওয়াইয়া দিমু, চিন্তা করিসসা’।
সফিক মাঝি তখনো খুট দিয়ে বসে থাকে, বলে-‘আমি যে নিয়াত করছি হ্যার কি অইবো! আমার পোলাপাইন’!
দালাল বলে- ‘হোন, নিজেরে কতা দিছোস, মাইনসেরেতো আর দেসনো’।
সফিক মাঝি বলে-‘আমগো কি কোনো সাদ আল্লাদ নাই, সাদ আল্লাদ সব আমনেগো’!।
দালাল ক্ষেপে যায়। বলে, ‘সফিক মাঝি! তুই জিদ ধরি বোই থাকবি, আমার কতার কোনো দাম নাই, তুই আমারে বেইজ্জতি করবি! এ তোর বিপদে আপদে, আল্লার ইচ্ছায় সাহায্য সহযোগিতা কে করে’!
সফিক মাঝি- ‘আমনে যে’।
দালাল-‘তাইলে, যে পেলাইনের কতা কছ, হেই পোলাইনরর অসুখেরসুম কে ওষুধ কিনি দেয়, কে পথ্য কিনি দেয়, আইজ এট্টা মাছ পাইছোত, কিছু লাভের মুখ দেহুম, তুমি মিয়া জিদ ধরি বোই আছো। এই তোমার প্রতিদান?’
সফিক- ‘না মিয়া, পোলাইনরে কতো দিন ইলিশ মাছ খাওয়াইতাম পারি না, আমি ম্যাগনা নদীর মাঝি, দিন-রাইত নদীত পরি থা’ই, দেনায় দেনায় জজ্জরিত, পোলাইন হুদা ভাত খায়। আল্লার কাছে কানতে কানতে আল্লায় এই মাছটা দিছে। এই ‘রাজা ইলিশ’, ‘রাজা ইলিশ’ খালি টিয়া আলারাই খাইবো, আমগো পোলাইনের খাওনের কোনো অধিকার নাই’!
দালাল- ‘না, নাই। এইডাই দুইনন্নার নিয়ম। আমনের পোলাইন খাইবো বরোজোর জাটকা, দুইননা পালটাইছে, কিন্তুক নিয়মনীতি পালটায় নাই। সব থিকা বড় কথা, কিসমত। কিসমত অইলো বড় কথা। এই মাছ কার পাতে আছে, আমরা কেউ কোইতাম পারি না। তয় এইডুক কোইতাম পারি, তোমার পোলাইনের কপালে নাই’।
ক্ষুব্ধ সফিক নিজেই নিজেকে বলে, ‘হেই কিসমতে বাগরা দেয় আমনেগো মতো কিছু দালাল। সবসুম লাভ আর লোভে পরি, সফিক মাজিগোরে বঞ্চিত করেন’। দম নেয়।
দালাল বলেন, ‘দাদন নেওনের কালে খবর আছিল না। তোর কোন বাপেরা তর বিপদেরসুম আউগগাই আইছে। এহোন বড় বড় কতা কছ!’
সফিক মাঝি দালালের কাছে জানতে চায়, ‘তয় কিয়ারুম!
দালাল আস্তে আস্তে বলে, ‘মাছটা ঘাডে উডা। দ্যাখ কতো দাম, কতো ওডে। দাম মনমতো না অইলে, ঢাকার মোকামে লইয়া যামু। হেনে আরও বেশি পামু। তোরে আমু ঠগামু না। আমিও তোর দুখ-দরদ বুঝি’।
সফিক অনেকক্ষণ চিন্তা করে, তারপরে বলে, ‘লন, আমনের কতা মানি নিলাম। তয় আমার এট্টা শর্ত আছে। টিবিআলাগোরে আমি মাছ দেহামু, কিন্তুক হের লাইগগা জনপ্রতি ৫০০টিহা দিতো অইবো। ভিডিও করলেও ৫০০ টিয়া। লাইভে গেলেও ৫০০ টিয়া। হেইডা আমনে জানাই দেন। নাইলে আমি বাক্সাততেন মাছ উডামু না। হ্যার লগে এইডাও কইয়া দেন, বিয়াল চাইট্টারসুম এই মাছে ডাক অটফো। লাইভে হেইডাও জানি কইয়া দেয়। এইডাই আমার শর্ত’।
রফিক দালাল মাছঘাটে উঠে তার হ্যান্ড মাইকটি বের করে সব সাংবাদিক, ক্যামেরাপার্সন, কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘সফিক মাঝি মাছ বিক্রি করব না, তবে শর্ত দিছে। এই ‘রাজা ইলিশ’ দেখতে, ভিডিও করতে এবং লাইভ করতে জনপ্রতি ৫০০ টাকা করি দিতো হইবো। যারা যারা এ শর্তে রাজি আছেন, তারা ৫০০ টাকা করে জমা দি ‘রেজিস্ট্রেশন করেন। আমার সরকার আপনেগো নাম লিখব। আর টাকা নিব।
অনেক্ষণ ধরে মিডিয়ার লোকদের মধ্যে গুজুর, গুজুর ফুছুর, ফুছুর শব্দ, খুস, খুস, ফুস চলতে থাকে। তারা বলল, ঠিক আছে। সবাই রেজিস্ট্রেশন করতে শুরু করল। রেজিস্ট্রেশনের বাইরে কেউ রইল না। ভোলার সব মিডিয়াপার্সন, কন্টেন্ট ক্রিয়েটর চলে এলো তুলাতুলি মাছঘাটে। প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে ‘রাজা ইলিশে’র সুটিং হলো। এবার সাক্ষাৎকার। সফিক মাঝি তার জীবনের সব সুখ-দুখের কথা বললেন। কিছুটা শুদ্ধভাবে কথা বলার চেষ্টা করল। এ ‘রাজা ইলিশ’টি সে কেন বিক্রি করতে চায় নি। অবশেষে বিক্রি করতে কেন রাজি হয়েছেন। তাও বললেন। বললেন, ‘আমি দেনায় জজ্জরিত। মেঘনা নদীত আগের মতো মাছ নেই। জেলেরা মাছ ধরা ছাড়া আর কিছু শেখেনো। তাই মহাজন আর এনজিওর কাছে ঋণ লোই, জাল, নৌকা বানাই। কিন্তু মাছ যা পাই, তাই বেচে এনজিওর কিস্তি পরিশোধ করি, নিজেদের জন্য কিছু অবশিষ্ট থাকে না।’
সফিক মাঝি ক্যামেরার সামনে আরও বলেন, ‘এ ইলিশের নিলাম উঠবে, বিকাল চারটায়, যারা অংশ নেবেন, তারা আসতে পারেন’।
বিকাল চারটা বাজতে তুলাতুলি বাজারে গাড়ি আর মোটরসাইকেলের ভীর লেগে যায়। স্পিডবোটে নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর থেকে লোক এসেছে মেঘনা পাড়ি দিয়ে। বরিশাল থেকেও এসেছে। এত মানুষ দেখে রফিক দালালতো দিশেহারা। রফিক আবার মাইকিং করে জানিয়ে দিলেন, ‘এখন চার কেজি ৭৫০গ্রামের একটি ‘রাজা ইলিশে’র নিলাম হবে। আপনারা যারা নিলামে অংশগ্রহণ করবেন, তারা রেজিস্ট্রেশন করুন, রেজিস্ট্রেশন ফি আড়াইশ টাকা। জাস্ট চারটার সময় নিলাম শুরু হবে। পোনে ৫কেজি ওজনের রাজা ইলিশ।
আড়তদারের বাক্সের ওপর ককসিটের বরফের ওপর রাজা ইলিশটি রাখা। নিলাম শুরু হলো, প্রথম ডাক শুরু হলো ৫০ হাজার টাকা। ৫০ হাজার, ৬০ হাজার, ৭০ হাজার, ১ লাখ উঠে গেলো অবশেষে এক লাখ ৭৫ হাজার টাকায় ইলিশটি কিনলেন নোয়াখালীর এক ব্যবসায়ী। তিনি সাংবাদিকদের কাছে বললেন, ‘আমি আপনাদের ভিডিও দেখেছি। সেখান থেকে সবকিছু জেনেছি। আমি এই ইলিশ মাছটি কিনলাম এবং সফিক মাঝির সন্তানদের উপহার দিলাম।
সফিক মাঝি ইলিশটি নিতে চাইলেন না। তারপরও তিনি সফিক মাঝিকে বুঝিয়ে, গায়ে হাতে মুখে হাতবুলিয়ে স্পিডবোটে উঠে ভুম করে চলে গেলেন।
গল্প এখানে শেষ নয়। রাজা ইলিশটি সফিক মাঝির নৌকায় তুলে দেওয়ার পর হিসাব-নিকাশের পালা। রফিক দালালের সরকার হিসাব-নিকাশ করে দেখলেন, মাছ বিক্রি ও রেজিস্ট্রেশনে মিলিয়ে প্রায় দুই লাখ টাকার ওপরে উঠেছে। সে দাদনের সব টাকা কেটে রেখে সফিক মাঝিকে ২৫ হাজার টাকা ধরিয়ে দেয়। দালাল রফিক বলে, ‘তোর সঙ্গে সব লেনদেন শ্যাষ। এই ল ২৫হাজার টিয়া। এহোন তুই দেড় লাখ টিহায় ইলিশটি বেচতে পারোছ। আমি ঢাকার মহাজনের লগে কথা কোই। বেচলে ক, নগদ টিয়া পাবি।
এ কথা শোনার পরে সফিক মাঝি চিন্তায় পড়ে গেল কি করবে! সে ভাবে আর নৌকার দিকে এগোয়।
