বিবর্ণ পৃথিবী সুন্দর আগামীর অপেক্ষায়
কাজী হায়াৎ
প্রকাশ: ০৪ মে ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
১৯৬৫ সাল। আমি উচ্চমাধ্যমিক প্রথমবর্ষের ছাত্র। তখন ছিল এপ্রিল মাস। বাড়িতে বসে খবর পেলাম আমাদের গ্রামের দক্ষিণ পাড়ায় একই বাড়িতে তিনজন কলেরা হয়ে মারা গেছে। মুরব্বিদের শাসনে বাড়ি থেকে দক্ষিণ দিকে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। পরের দিন আমাদের পাড়ায় মারা গেল দু’জন। এবার বন্ধ হয়ে গেল বাড়ির বাইরে যাওয়া। তখন ইলেকট্রিসিটি ছিল না। সারা রাত ঘরে জ্বালিয়ে রাখা হতো হারিকেনের আলো। রাতে নিস্তব্ধ হয়ে যেত সারা গ্রাম। দিন রাত মিলিয়ে ভয়াবহ অবস্থা। হঠাৎ শুনতে পেলাম, পাশের বাড়ির চাচাতো ভাই কামরুল শেষ রাতে কলেরায় আক্রান্ত হয়েছে। কামরুল ছিল আমার খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এ কথা শুনে যেতে চাইলাম ওদের বাড়িতে। মা-বাবা ভাই-বোন সবার বাধায় যেতে পারলাম না। বিকাল তিনটার দিকে ওদের বাড়ির দিক থেকে কান্নাকাটির শব্দ শুনে বুঝলাম কামরুল মারা গেছে। মরে যাওয়ার পরও প্রচণ্ড বাধায় তাকে শেষবারের মতো দেখতে পারলাম না। তার মৃত্যু এবং দেখতে যেতে না পারা আজও আমার কাছে অনেক কষ্টদায়ক ঘটনা।
বহু বছর পরে এমনি গত ১৭ এপ্রিল মারা গেলেন আমার সিনেমার একজন কাছের মানুষ মহিউদ্দিন ফারুক। অনেক গুণী ব্যক্তি ছিলেন তিনি। চারুকলা থেকে পাশ করা শিল্পী, অনেক বর্ণাঢ্য জীবন ছিল তার। বিটিভির শিল্প নির্দেশক হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু। মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত ছিলেন স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়ার বিভাগীয় প্রধান। তিনি অসংখ্য সিনেমার শিল্প নির্দেশক হিসেবে কাজ করেছেন। স্বীকৃতি স্বরূপ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ পেয়েছিলেন অসংখ্য পুরস্কার। তার সবচেয়ে বড় কাজ পরিচালক সমিতির সামনে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে ‘উত্তাপ’ নামক স্মৃতিস্তম্ভ। শরৎচন্দ্রের বিখ্যাত উপন্যাস ‘বিরাজ বৌ’ অবলম্বনে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা সিনেমা পরিচালনা করেছিলেন তিনি। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির কার্যনির্বাহী সদস্য, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের জুরি বোর্ডের সদস্য ছিলেন অনেকবার। এত কিছু বলার অর্থ, স্বাভাবিক সময়ে মৃত্যু হলে হয়তো তার মৃতদেহ নেয়া হতো আমাদের জাতীয় শহীদ মিনারে। সমাজের সব শ্রেণির মানুষ তাকে জানাত শেষ শ্রদ্ধা। আমি ঘরে থেকে টেলিফোনে খবর পেলাম ফারুক ভাই হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে। প্রথমে স্তম্ভিত হলাম, নিজের অজান্তে দু’চোখ ভরে গেল পানিতে। মনে পড়ল তার সঙ্গে স্মৃতিবিজড়িত অনেক কথা। ২০০৪ সালে নিউইয়র্ক শহরে গিয়ে হোটেলের এক রুমে ছিলাম দু’জন। সে সময়ে অনেক গল্প হয়েছে। চলচ্চিত্র সম্পর্কে শুনেছি তার কাছে অনেক পুরনো কথা। ‘কোভিড-১৯’র কারণে ফারুক ভাইকে শেষবারের মতো দেখতে পারলাম না এ নিয়ে কষ্ট হচ্ছে।
করোনাভাইরাস কতদিন পৃথিবীতে থাকবে জানি না। ১৯৬৫ সালের কলেরা ছিল সিজনাল মহামারী, কিন্তু এ কেমন? এর শেষ কোথায়? করোনা আক্রান্ত মাকে জঙ্গলে ফেলে গেছে সন্তানরা, আমেরিকার মতো উন্নত দেশে স্বামীর লাশ নিয়ে দু’দিন বসেছিল স্ত্রী, কবর দেয়ার জায়গা নেই বলে। সারা পৃথিবীতে আর্থিক ক্ষতি কতটুকু হয়েছে জানি না, তবে আরও কিছুদিন এ ভাইরাস থাকলে পৃথিবীতে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হবে, এ কথা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি। ইতোমধ্যে মানুষের অধিকাংশ বিনোদনের ক্ষেত্র বন্ধ হয়ে গেছে। মানুষ বিনোদন বঞ্চিত হলে সমাজের অনেক কিছু অস্বাভাবিক হয়ে যাবে। কমে যাবে মানুষের আবেগ অনুভূতি। বিকৃত হবে মানুষের মনন। আর এ বিকৃত মনন সংগঠিত করবে অনেক অপরাধ।
সমাজ বিজ্ঞানীদের এখনই চিন্তা করা উচিত প্রচলিত ধারার বিনোদন প্রধানত বিভিন্ন ধরনের খেলা, সিনেমা, নাটক, অপেরার জায়গায় অন্য কীভাবে মানুষের বিনোদনের অভ্যাস করা যায়। যখন পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষকে করোনাভাইরাস প্রতি মুহূর্তে তার মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, তখনই যদি শোনা যায় মা ও মেয়েকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে! যখন ইস্কাটনের রাস্তায় রাত ১২টায় ঘুম ভাঙে ক্ষুধার্ত মানুষের চিৎকারে, তখন যদি শুনি ত্রাণসামগ্রী আত্মসাৎ করেছে কোনো জনপ্রতিনিধি, তখন হৃদয়ে বড় রক্তক্ষরণ হয়। করোনা শুধু অর্থনীতিকে ধ্বংস করবে না, ধ্বংস করবে মানুষের মানবিকতা।
এ মুহূর্তে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য প্রয়োজন আমাদের আইনশৃঙ্খলার বাহিনীর কঠোরতা এবং সততা। সবাইকে মনে রাখতে হবে, আমাদের সম্পদ সীমিত। আমরা কোনো শিক্ষিত এবং উন্নত জাতি নই। সবাইকে ভাবতে হবে অন্যের ক্ষুধার সামগ্রী আত্মসাৎ করা অমার্জনীয় অপরাধ। এমন সময় যারা তা করছে আমি বলব তারা নিশ্চয়ই বিবেকহীন, বিকৃতি রুচিসম্পন্ন মানুষ।
একজন সুস্থ মানুষ সব সময় সামনের দিনের কথা চিন্তা করে। কিন্তু অধিকাংশ জীবনই তো থেমে গেছে। নেই কাজ, খাবার নেই ঘরে, সর্বত্রই হাহাকার। কবে কোথায় কীভাবে এর শেষ হবে কেউ জানে না। পৃথিবীর সব দেশেই চলছে এ মহাবিপর্যয় থেকে মানুষকে রক্ষা করার প্রচেষ্টা। এ প্রচেষ্টা আমার দেশেও আছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর এ বিষয়ে রয়েছে সুতীক্ষè পর্যবেক্ষণ, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আসছে অনেক প্রণোদনা। সুচারুরূপে প্রধানমন্ত্রীর এ কর্মযোগ্য সমাধা করতে পারলে হয়তো অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাবে আমাদের দেশ। কিন্তু বেশিদিন যদি করোনাভাইরাসের আগ্রাসন এভাবে চলতে থাকে, তাহলে দারুণ মানবিক বিপর্যয় হওয়ার সম্ভাবনা আছে। খাবারের মতোই অভাব হতে পারে বিনোদনেরও। বর্তমানে আমাদের দেশের সব বিনোদন ক্ষেত্রগুলো বন্ধ। বন্ধ হয়ে গেছে খেলার মাঠ, সিনেমা হল, সার্কাস, নাটক, পালাগান, যাত্রার পালা। সারা দেশে এ ক্ষেত্রের লাখ লাখ বিনোদনকর্মী এখন বেকার। খেলার মাঠ খেলোয়াড়ের জন্য হয়তো খুলে দেয়া সম্ভব হবে, কিন্তু সিনেমা? সিনেমা মানুষের জন্য অনেক বড় একটি বিনোদন মাধ্যম। সিনেমা মানুষের আবেগকে শানিত করে। বেশ কয়েক বছর পূর্ব থেকেই আমাদের সিনেমায় চলছে প্রচণ্ড খরা। এখন করোনাভাইরাসের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে সিনেমা হলসহ এ শিল্পের সব কাজ। নির্মাণ, বিতরণ, প্রক্ষেপণ থেকে শুরু করে সিনেমার সব ক্রিয়া কর্মই এখন বন্ধ। বেকার হয়ে গেছে শিল্পী, নির্মাতা, কলাকুশলী। আবার কখন সিনেমার ক্যামেরা চলবে, সিনেমা হলগুলোর দরজা খুলবে, কেউ তা জানে না। সিনেমা, যাত্রা, সার্কাস, নাটক, যাত্রাপালা এক্ষেত্রগুলোতে যেসব মানুষ কাজ করত তাদের কথা আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বিবেচনায় হয়তো আসবে আমাদের ধারণা।
সর্বশেষে বলতে চাই, ১৯৬৫ সালে কলেরার মহামারীতে ঘরে আটকে ছিলাম, আজও আটকে আছি ঘরে। এক চিমটি লবণ, এক মুঠো গুড় কলেরাকে শেষ করেছিল পৃথিবী থেকে। ঘরে বসে শুধুই ভাবি কবে আবার মানব সভ্যতা আবিষ্কার করবে এ এক চিমটি লবণ আর গুড়ের মতো মহাওষুধ। যা দিয়ে বাঁচবে পৃথিবীর মানুষ। বাঁচবে সভ্যতা, পৃথিবীর থেকে দূরীভূত হবে করোনাভাইরাসের আতংক। শুধু দুঃখ নয়, জীবনে করতে চাই আনন্দ।
আমরা আর দেখতে চাই না আজকের এ বিবর্ণ পৃথিবী।
লেখক : চিত্রপরিচালক
