Logo
Logo
×

নগর-মহানগর

সাড়ে ৬ বছর পর কোচিং ‘বৈধ’ নীতিমালার গেজেট

শিক্ষকের পাশাপাশি এখন স্কুলেও কোচিং করতে হয় * নীতিমালার বিরুদ্ধে শিক্ষকদের একাধিক মামলা চলমান * কোচিং ব্যবস্থা মহামারীতে পরিণত হয়েছে -রাশেদা কে চৌধুরী

Icon

মুসতাক আহমদ

প্রকাশ: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সাড়ে ৬ বছর পর কোচিং ‘বৈধ’ নীতিমালার গেজেট

রমরমা কোচিং বাণিজ্য বন্ধে ২০১২ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি নীতিমালা তৈরি করে। পাকাপোক্ত করতে সাড়ে ৬ বছর পর সেই নীতিমালা কয়েকদিন আগে গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়েছে। এ নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। তারা মনে করছেন, এই নীতিমালার মাধ্যমে প্রকারান্তরে কোচিং বাণিজ্যকে বৈধতাই দেয়া হয়েছে।

অভিভাবকদের অভিযোগ, কোচিংয়ে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়েই তারা উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হন। এক রিট মামলার পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালতের নির্দেশে সরকার ওই নীতিমালা করতে বাধ্য হয়েছিল। যদিও সেই নীতিমালা কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করতে পারেনি। বরং এখনও শিক্ষকের পাশাপাশি স্কুল-কলেজেও শিক্ষার্থীদেরকে কোচিং করতে হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব বলেন, কোনো নীতিমালা গেজেট আকারে প্রকাশিত না হলে বিচারিক দৃষ্টিকোণ থেকে সেটি আইনি ভিত্তি পায় না। এ কারণে প্রয়োজনের নিরিখে এতদিন পর হলেও গেজেট প্রকাশের ব্যবস্থা হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা থাকায় এই অতিরিক্ত সচিব নাম প্রকাশ করেননি।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, জিয়াউল কবির দুলু নামে এক অভিভাবকের রিট মামলার পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পর ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধে নীতিমালা’ করা হয়। এটি ২০১২ সালের ২০ জুন জারি করা হয়। নীতিমালায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টিতে কোচিং হল- শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম চলাকালীন শিক্ষকের নির্ধারিত ক্লাসের বাইরে, পূর্বে অথবা পরে শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে বা বাইরে কোনো স্থানে পাঠদান করা। আর কোচিং বাণিজ্য হল মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে শিক্ষার্থী ভর্তির মাধ্যমে কোচিং কার্যক্রম পরিচালনা। চার পৃষ্ঠার নীতিমালায় বিভিন্ন উপধারাসহ মোট ১৪টি ধারা রয়েছে।

এতে বলা হয়, শিক্ষার্থীদের আগ্রহ থাকলে ও অভিভাবকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে স্কুলে ‘অতিরিক্ত ক্লাস’র ব্যবস্থা করা যাবে। এজন্য মেট্রোপলিটন ও বিভাগীয় এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রতি বিষয়ের জন্য গুনতে হবে ৩শ’ টাকা। জেলা শহরে ২৫০ টাকা এবং উপজেলা শহরে ১৫০ টাকা করে। এতে আরও বলা আছে, শিক্ষকরা নিজ বাসভবনে বা কোনো বাণিজ্যিক কোচিং সেন্টারে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত থাকতে পারবেন না। এমনকি তারা ক্লাসরুম বা অতিরিক্ত ক্লাসের বাইরে নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কোচিং বা প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না। তবে অন্য প্রতিষ্ঠানের অনধিক দশজনকে কোচিং করাতে পারবেন। শিক্ষকরা কোচিংয়ে উৎসাহিত করতে পারবেন না। এমনকি শিক্ষকের নামে কোচিং সেন্টারের প্রচারণা করা যাবে না। নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কোচিং করালে তার এমপিও বাতিলসহ অন্যান্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থার আওতায় আনা হবে।

অভিভাবকরা বলছেন, ওই নীতিমালার পর কোচিংবাণিজ্য আরও উৎসাহিত হয়। বিশেষ করে রাজধানীর বিভিন্ন স্কুল জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার আগে বাধ্যতামূলক কোচিংয়ে আয়োজন করে। বিগত জেএসসি পরীক্ষার আগে রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজ বাধ্যতামূলক কোচিংয়ের ব্যবস্থা করে। একইভাবে এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের জন্যও আয়োজন করে। কয়েকদিন আগে এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের ফরম পূরণের সময়ে আলাদাভাবে নগদে কোচিং ফি নেয়া হয়।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের (ক্যাম্পে) নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কোচিং ব্যবস্থা ভয়াবহ মহামারী ও ঘাতক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। শিক্ষার নামে ঢালাও বাণিজ্য হচ্ছে। এটা মাদকের মতোই আমাদের গ্রাস করছে। আমাদের বড় ব্যর্থতা হচ্ছে, ক্লাসরুমে পড়া হয় না- এটা মেনে নিয়েছি। তিনি আরও বলেন, তবু কোচিং নীতিমালা করাটাকে সরকারের সদিচ্ছা হিসেবে আমরা দেখতে পারি। কিন্তু এত গুরুত্বপূর্ণ জিনিস বাস্তবায়ন ও মনিটরিং না করাটা সদিচ্ছার পরিচায়ক নয়।

কোচিংবিরোধী মামলাকারী অভিভাবক জিয়াউল কবির দুলু বলেন, শিক্ষকদের কোচিং কতটা ভয়াবহ তা আলাদা করে দৃষ্টান্ত দিয়ে বলার অবকাশ রাখে না। কেননা, কোচিংয়ের ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত প্রজ্ঞাপনেই বলা আছে, একশ্রেণীর শিক্ষক বাণিজ্যিকভিত্তিতে কোচিং পরিচালনা করে আসছেন। এটি বর্তমানে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষকদের কাছে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা জিম্মি হয়ে পড়েছেন; যা পরিবারের ওপর বাড়তি আর্থিক চাপ সৃষ্টি করেছে এবং এ ব্যয় নির্বাহে অভিভাবকরা হিমশিম খাচ্ছেন। এছাড়া অনেক শিক্ষক শ্রেণীকক্ষে পাঠদানে মনোযোগী না হয়ে কোচিংয়ে বেশি সময় ব্যয় করছেন। এক্ষেত্রে দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

নীতিমালার এই দিকটির সত্যতা মেলে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় সমীক্ষায় (২০১৬)। তাতে বলা হয়েছে, শিক্ষার পেছনে একজন অভিভাবকের মোট আয়ের ৫ দশমিক ৪২ ভাগ ব্যয় হয়ে যায়। এর মধ্যে শহরে সর্বোচ্চ ৬ দশমিক ৩৩ এবং গ্রামে ৪ দশমিক ৯৩ শতাংশ। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, শিক্ষার পেছনে অভিভাবকের ব্যয়ের সবচেয়ে বড় খান কোচিং। ব্যয়ের ৩০ শতাংশ চলে যায় এই খাতে। শিক্ষার্থীর ব্যয়ের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খাত শিক্ষা উপকরণ খাতে যায় ১৮ শতাংশ। তৃতীয় সর্বোচ্চ খাত স্কুলের ভর্তি, সেশন ফি, পরীক্ষা ফি, যা ১৭ শতাংশ।

গণসাক্ষরতা অভিযানের (ক্যাম্পে) নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, বর্তমানে শিক্ষা ব্যয় আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। আমাদের সমীক্ষায় দেখতে পেয়েছি, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ৯০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট-টিউশন নিতে হচ্ছে। এই ব্যয় গরিব অভিভাবককে লেখাপড়ার প্রতি অনীহা তৈরি করছে। সবচেয়ে বড় আশঙ্কা হচ্ছে, প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক বলা হলেও তা নিখরচায় নয়।

অভিভাবকরা জানান, ২০১২ সালের ওই নীতিমালা জারির পর অসাধু শিক্ষকরা কয়েকদিন বিরত ছিলেন। এরপর ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে গড়ে তোলেন কোচিং বাণিজ্য। তারা নীতিমালা প্রতিপালন করেন না। এমনকি কোনো নিষেধাজ্ঞারও ধার ধারেন না। গত ২ ফেব্রুয়ারি এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয়। পরীক্ষা সামনে রেখে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২৭ জানুয়ারি থেকে কোচিং কার্যক্রম এক মাস বন্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু গত এক সপ্তাহে রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী, মতিঝিলের শাহজাহানপুর, আরামবাগ, আজিমপুর, ফার্মগেট এবং মিরপুরের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে দেখা গেছে, কোচিং কার্যক্রম যথারীতি চলছে। বাইরে পাহারা বসিয়ে ও দরজায় তালা লাগিয়ে কোচিং চালিয়ে যাওয়ার দৃশ্যও মিলেছে সিদ্ধেশ্বরীসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, কোচিংবাজ শিক্ষক বা তাদের দোসররা এর চেয়েও আগ্রাসী। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গত বছর রাজধানীর বেশকিছু স্কুলের শিক্ষকের কোচিংয়ে জড়িত থাকার ঘটনা অনুসন্ধান শেষে ব্যবস্থা নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠায়। সেটির আলোকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় রাজধানীর একটি সরকারি স্কুলের শিক্ষকের বিরুদ্ধে নোটিশ পাঠায়। ওই কারণ দর্শানোর নোটিশ পেয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধের নীতিমালা-২০১২ নিয়ে শিক্ষকরা হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। আগামীকাল ওই রিট মামলার রায়ের দিন ধার্য আছে।

জানা গেছে, শিক্ষকদের কোচিংয়ের ব্যাপারে কিছুদিন আগে রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজের কয়েক শিক্ষকের ব্যাপারেও প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদ একটি নোটিশ দেয়। সেটির বিরুদ্ধেও উচ্চ আদালতে আরেকটি রিট মামলা চলমান আছে।

কোচিং বাণিজ্য

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম