Logo
Logo
×

নগর-মহানগর

গাজীপুরে ত্রুটিপূর্ণ গড় মূল্য

জমির রেজিস্ট্রেশন ফি বেড়ে যাওয়ায় দুর্ভোগ

সরকারের রাজস্ব আয় হ্রাস

Icon

গাজীপুর প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১৫ মার্চ ২০২০, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

গাজীপুরে মৌজাভিত্তিক ত্রুটিপূর্ণ গড় মূল্য তালিকায় জমির রেজিস্ট্রেশন ফি ধার্য করার ফলে কম মূল্যে কেনা জমির ক্রেতারা অধিক রেজিস্ট্রেশন ফি দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে ক্রেতারা ত্রুটিপূর্ণ গড় মূল্যের কবলে পড়ে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ কারণে বর্তমানে গাজীপুরে জমি রেজিস্ট্রেশনের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। ফলে এ খাতে সরকারের রাজস্ব আয়ও কমে গেছে।

গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, মৌজাপ্রতি ত্রুটিপূর্ণ গড় মূল্যের কারণে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এতে সিটির অভ্যন্তরে বাসাবাড়ি, দোকানপাট, মার্কেট অথবা ফ্যাক্টরি নির্মাণে যারা আগ্রহী তাদের আগ্রহ ভাটা পড়েছে। নির্মাণ ব্যয়ও বহুলাংশে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কাজেই জমির ত্রুটিপূর্ণ গড় মূল্য কীভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা যায় তা দ্রুত নির্ধারণ করা উচিত বলে জানান মেয়র জাহাঙ্গীর আলম।

গাজীপুর জেলা রেজিস্ট্রার অফিস সূত্র জানায়, জমি বেচাকেনার মূল্যের ওপর রেজিস্ট্রেশন ফি ধার্য করা হয় মৌজাভিত্তিক। এজন্য জেলা রেজিস্ট্রারকে সভাপতি, সংশ্লিষ্ট উপজেলার সাব-রেজিস্ট্রার ও জেলার অপর একজন সাব-রেজিস্ট্রারকে সদস্য করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। প্রতিবছর নির্দিষ্ট মৌজার সর্বোচ্চ ও সর্বনিু মূল্যে বিক্রি হয়েছে সে দুটির সঙ্গে যে জমি বিক্রি হবে সে জমির মূল্য অর্থাৎ ওই তিনটি জমির গড় মূল্য বের করে গড় মূল্যের ওপর রেজিস্ট্রেশন ফি ধার্য করা হয়। প্রতি বছর গঠিত কমিটি সভা করে সে বছরের জন্য রেজিস্ট্রেশন ফি ধার্য করে। প্রতি বছর প্রতিটি মৌজার জন্য এভাবে ফি ধার্য করা হয়।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, এ নিয়মের ফলেই দেখা দেয় বৈষম্য ও জটিলতা। সংশ্লিষ্ট মৌজার রাস্তার পাশের অথবা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা জমির প্রতি শতাংশের মূল্য গড়ে ১০ লাখ টাকা অথচ দূরবর্তী স্থানের জমির প্রতি শতাংশের মূল্য গড়ে ২ লাখ টাকা। একজন ক্রেতা যে জমি কিনেছেন তিন লাখ টাকা শতাংশ হারে- শুল্ক প্রদান করেন ৫ লাখ টাকা। অতিরিক্ত ২ লাখ টাকার ফি তাকে পরিশোধ করতে হচ্ছে।

জমির ক্রেতারা জানান, তারা বহু কষ্টে টাকা জোগাড় করে তবেই জমি কিনতে যান। বিক্রেতাদের সঙ্গে বহু দেন-দরবার করে যতদূর সম্ভব কম দাম দিয়ে তারা জমি কেনেন। তবে বিড়ম্বনা দেখা দেয় জমি রেজিস্ট্রেশন করতে গিয়ে। তাদের দিতে হয় চড়া রেজিস্ট্রেশন ফি- যা তাদের সাধ্যের বাইরে। এতে তারা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। আর রেজিস্ট্রেশন ফি চড়া থাকার কারণে ক্রেতারা জমি কিনতে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েছেন। ফলে বর্তমানে এলাকায় জমি বেচাকেনা অনেকাংশে কমে গেছে। এতে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে। এমনকি জরুরি প্রয়োজনে কেউ অর্ধেক দামে জমি বেচতে চাইলেও ক্রেতা খুঁজে পাচ্ছেন না। এ কারণে দলিল সম্পাদনের সংখ্যাও অনেক কমে গেছে।

গাজীপুর সাবরেজিস্ট্রি অফিসের দলিল গ্রহীতা ইদ্রিস আলী জানান, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের দেশীপাড়া মৌজায় ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ জমি তিনি কেনেন ৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকা দিয়ে। কিন্তু ওই জমি রেজিস্ট্রেশন করতে গিয়ে ত্রুটিপূর্ণ গড় মূল্যের কারণে তাকে দেখাতে হয়েছে ২৩ লাখ ২০ হাজার টাকা। ফলে তাকে প্রায় তিনগুণ বেশি ফি দিতে হয়েছে।

জেলা রেজিস্ট্রি অফিস সূত্র জানায়, গড় মূল্যে বাস্তবায়নের পূর্বে ২০০৯ সালে গাজীপুর সদর সাবরেজিস্ট্রি অফিসে যেখানে দলিল সম্পাদন হয়েছিল প্রায় ৩০ হাজার, সেখানে গড় মূল্য বাস্তবায়নের পর ২০১১ সালে দলিল রেজিস্ট্রেশনের সংখ্যা হয়েছে ২৪ হাজার ৭২৯টি। একইভাবে গাজীপুর ২য় যুগ্ম, টঙ্গী ও জেলার অন্যান্য ৭টি সাবরেজিস্ট্রি অফিসে দলিল রেজিস্ট্রি সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।

নগরীর ঝাজর এলাকার সাইফুল ইসলাম দুই লাখ ২০ হাজার টাকা শতাংশ দরে ১২ শতাংশ জমি বিক্রি করলেও ত্রুটিপূর্ণ গড় মূল্যের কারণে তাকে প্রতি শতাংশ জমি বিক্রয় মূল্য দেখাতে হয়েছে ৬ লাখ টাকা। অপরদিকে ধীরাশ্রম মৌজার গিয়াস উদ্দীন তার জমি বিক্রি করেন দেড় লাখ টাকা শতাংশ অথচ রেজিস্ট্রেশন করার সময় শতাংশপ্রতি বিক্রি দেখাতে হয়েছে সাড়ে চার লাখ টাকা। এতে বিক্রয় কর ছাড়াও বর্ধিত টাকার আয়করও তাদের দিতে হচ্ছে।

একজন শিল্প উদ্যোক্তা কলমেশ্বর মৌজায় তার ফ্যাক্টরি নির্মাণের জন্য ৬ বিঘা জমি কেনেন ৬ কোটি টাকায় এবং ৬ কোটি টাকার ওপর তিনি রেজিস্ট্রেশন খরচ দেন। আবার একই মৌজার ১৪ বিঘা জমি অপর একজন শিল্প উদ্যোক্তা তিন কোটি টাকা বিঘা দরে কেনেন। একই মৌজার জমি হওয়া সত্ত্বেও ত্রুটিপূর্ণ গড় মূল্যের কারণে একজনকে বিঘাপ্রতি ১ কোটি টাকার রেজিস্ট্রেশন ফি দিতে হলেও অপরজনকে বিঘাপ্রতি ৩ কোটি টাকার রেজিস্ট্রেশন ফি দিতে হয়েছে।

২০১৯-২০ সালের জন্য বলবৎ ওই গড় মূল্য তালিকাতে দেখা যায়, শহরের জয়দেবপুর মৌজায় চালা/আবাদি চালা/কৃষি চালার জন্য প্রতি শতাংশ জমির গড় মূল্য ১০ লাখ ৯৬ হাজার ৬০২ টাকা, ভিটি/বাড়ি/চান্দিনা শতাংশপ্রতি গড়মূল্য ১৫ লাখ ৭১ হাজার ৬২৯ টাকা, টেক/ঘুনি/টাটী/আবাদি টেক শতাংশপ্রতি ১৩ লাখ ৬৩ হাজার ৯০১ টাকা, সাইল ৬ লাখ ৮৩ হাজার ৯০১ টাকা, বাইদ ৩ লাখ ১৪ হাজার ৭৬২ টাকা, নাল ১০ লাখ ১৮ হাজার ১৬৪ টাকা, ডোবা ৯০ হাজার ৭৯৯ টাকা, বোরো-৪ লাখ ৬০ হাজার ৫৬ টাকা, আমন ৯ লাখ ৪ হাজার ৬৬৪ টাকা, কৃষিআউশ/আউশ-১ লাখ ৫১ হাজার ৫১২ টাকা, খামা ৬ লাখ ৯০ হাজার ৮১০ টাকা, বাগান ৫ লাখ ৮৩ হাজার ৩৪২ টাকা, পুকুর/বর্ষা/জলাকরা- ৮ লাখ ৩৮ হাজার ৮১ টাকা ও লায়েক/পতিত জমি শতাংশপ্রতি ৭ লাখ ৫০ হাজার ৭৪৬ টাকা ধার্য করা হয়েছে, যা বাস্তবের সঙ্গে কোনো মিল নেই।

গাজীপুর সদর সাবরেজিস্ট্রি অফিসের দলিল লেখক ও ভেন্ডার কল্যাণ সমিতির একজন কর্মকর্তা জানান, ত্রুটিপূর্ণ গড় মূল্যের কারণে জরুরি প্রয়োজনে কেউ অর্ধেক দামে জমি বিক্রি করতে চাইলেও জমি বিক্রি করতে পারছে না। আর এ কারণে বাস্তবের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ফি জমা দিতে হচ্ছে ক্রেতাদের।

গাজীপুর জেলা রেজিস্ট্রার মুন্সি মোকলেছুর রহমান জানান, জেলার অধিক্ষেত্রভুক্ত এলাকায় ৭টি সাবরেজিস্ট্রি অফিস রয়েছে। অন্য জেলার ন্যায় এ জেলায়ও মৌজাওয়ারি শ্রেণিভিত্তিক শতাংশপ্রতি জমির গড় মূল্য নির্ধারণ করা হয়। এ গড় মূল্য গেজেটভুক্ত হয়ে ২০১০ সাল থেকে চলমান রয়েছে। প্রতিবছর গড় মূল্য পুনঃনির্ধারণ করা হলেও গাজীপুরে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের গড় মূল্য তালিকা ২০১৯-২০ সালেও বলবৎ রাখা হয়েছে।

জনগণের আর্থিক সঙ্গতির বিষয়টি বিবেচনা করে সরকার স্ট্যাম্প চালানোর ক্ষেত্রে দেড় শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে। তিনি বলেন, আর্থ-সামাজিক কারণে বর্তমানে জমি রেজিস্ট্রেশনের সংখ্যা কমে গেলেও রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ কমেনি। আগে জমির মূল্য কম ছিল বিধায় রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ কম হতো। কিন্তু বর্তমানে জমির মূল্য বেড়ে যাওয়ায় রাজস্ব আদায়ের পরিমাণও বেড়ে গেছে। তবে তিনি দলিলের ওপর আরোপিত অন্যান্য করের পরিমাণও কমিয়ে দেয়া উচিত বলে মনে করেন।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম