Logo
Logo
×

নগর-মহানগর

মানহানি মামলার উদ্দেশ্যই হয়রানি

যার মানহানি হয়েছে শুধু তিনিই মামলা করবেন -বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক * একজনের বিরুদ্ধে ডজন ডজন মামলা স্রেফ রাজনৈতিক অস্ত্র -ড. শাহদীন মালিক * এ বিষয়ে আদালতের ব্যাখ্যা থাকা দরকার -খুরশীদ আলম খান * কর্মজীবনে দেখিনি মামলা সুপ্রিমকোর্ট গড়িয়েছে -ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া

Icon

আলমগীর হোসেন

প্রকাশ: ০২ জানুয়ারি ২০২১, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মানহানি মামলার উদ্দেশ্যই হয়রানি

কোনো মন্তব্যে একজনের মানহানি হলো, কিন্তু বাদী হিসেবে মামলা করছেন অন্যজন। আবার একই ঘটনায় হচ্ছে একাধিক মামলাও। কোটি থেকে শত বা হাজার কোটি টাকার মানহানির মামলাও হয় একজনের বিরুদ্ধে।

এরপর বছরের পর বছর ধরে চলে এর বিচার। তারিখে তারিখে আসামিকে হাজিরা দিতে হচ্ছে আদালতে। হচ্ছেন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। এভাবে ১৫-২০ বছর চলার পর একপর্যায়ে হয় মৃত্যু হয় বাদীর নতুবা তিনি মামলা চালানোর সক্ষমতা/আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।

আর এভাবেই সমাপ্তি ঘটে মানহানি মামলার। এর মাধ্যমে এক দিকে অপপ্রয়োগ হচ্ছে আইনের, অন্য দিকে যে মামলার ফলাফল নেই-সেই মামলার বিচার কার্যক্রম চালাতে গিয়ে ভারাক্রান্ত হচ্ছে আদালত। বাড়ছে মামলা জট। 

দেশে কার্যকর রয়েছে ‘তথ্য-প্রযুক্তি’ ও ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা’ আইন। তথ্য-প্রযুক্তি আইনে কেউ ‘অনুভূতিতে আঘাত’ অনুভব করলেই মামলা ঠুকে দিতে পারবেন।

যদিও ‘অনুভূতিতে আঘাত’ লাগার সংজ্ঞা নির্ধারণ করা নেই। তথ্য-প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিকসহ অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, যার বেশির ভাগই মিথ্যা। 

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতীয়মাণ হয়, অনেক মামলা শুধু হয়রানি করার জন্যই করা হয়। কারণ, মানহানি মামলা নিম্ন আদালতে নিষ্পত্তি হয়েছে বা চূড়ান্ত পর্যায়ে গেছে-এমন দৃষ্টান্ত নেই বললেই চলে।

এমন পরিস্থিতি গণতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত অশুভ। আইন রাষ্ট্রের জনগণের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য, জনগণের অধিকার ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য নয়। 

বিভিন্ন মামলা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, একজন ব্যক্তির বিষয়ে কথা বলা হয়েছে, কিন্তু অনেকে সংক্ষুব্ধ হয়েছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন স্থান থেকে মামলা করা হচ্ছে।

যেমন : সুপ্রিমকোর্ট বারের সাবেক সভাপতি ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে অন্তত ২০টি মানহানি মামলা হয়। এসব মামলায় তার কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয় ২৫ হাজার কোটি টাকা।

২০১৬ সালে ৭৭টি মামলা হয় ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে। এসব মামলায় বাদীরা তাদের ‘হানি হওয়া’ মানের দাম হেঁকেছেন ৭১ হাজার কোটি টাকা।

এমন অনেক ঘটনা রয়েছে। পত্রিকার প্রকাশক, সম্পাদক, লেখক, রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এসব মামলার শিকার হচ্ছেন।

ফৌজদারি আইনে করা এসব মামলায় দাবি করা অর্থ এখনো কাউকে শোধ করতে হয়নি। কিন্তু আসামিদের অনেকেই গ্রেফতার হয়েছেন। কারাভোগ করেছেন।

দণ্ডবিধির ৪৯৯ ধারা অনুযায়ী মানহানি মামলা হয়। মানহানি একই সঙ্গে দেওয়ানি ও ফৌজদারি অপরাধ।

এ ধারা অনুযায়ী, ‘কোনো ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির খ্যাতি বা সুনাম নষ্ট করার উদ্দেশ্যে উদ্দেশ্যমূলক শব্দাবলি বা চিহ্নাদি বা দৃশ্যমান প্রতীকের সাহায্যে কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে এমনভাবে কোনো নিন্দা প্রণয়ন বা প্রকাশ করে, তাহলে ওই ব্যক্তির মানহানি হয়েছে মর্মে গণ্য হবে।’

এমনকি মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে বললেও তা মানহানি হবে। মৃত ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজন মানহানির অভিযোগ আনতে পারবেন। মানহানির অভিযোগে ফৌজদারি ও দেওয়ানি উভয় ধরনের মামলা করার সুযোগ আছে। 

মানহানির একই অপরাধে দেশের আইনে দুই ধরনের সাজা কার্জকর রয়েছে। পত্রিকা বা বইয়ে লিখে কারো মানহানি করলে তার শাস্তি ৫০০ ধারায় দুই বছরের জেল।

এই একই অপরাধ অনলাইন বা ইলেকট্রনিক বিন্যাসে করলে তথ্য-প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধরায় ১৪ বছরের জেল। ৫৭ ধারায় কারও অনুভূতিতে আঘাত লাগলেই তিনি মামলা করতে পারেন।

এ ‘অনুভূতির’ কোনো ব্যাখ্যা না থাকায় এই আইন দিয়ে সহজেই হয়রানিমূলক বা মিথ্যা মামলা দেয়া যায়। 

পরিসংখ্যানে জানা যায়, দেশের ৬৪টি আদালতে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে তিন লাখ ৪৯ হাজার ৭১৮টি দেওয়ানি এবং দুই লাখ ৩৬ হাজার ১১৬টি ফৌজদারি মামলা বিচারাধীন। উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত আছে ১৩ হাজার ৬০৭টি মামলা। 

জানতে চাইলে আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, আইনে বলা আছে যার মানহানি হয়েছে তিনিই মামলা করতে পারবেন, অন্য কেউ নয়। তার পরও মামলা হচ্ছে।

আইনে না থাকলেও বিভিন্ন আদালত মামলা নিচ্ছেন। এ বিষয়ে উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যেতে পারে। 

সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, মানহানির মামলা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হয়রানির উদ্দেশ্যেই করা হয়ে থাকে। যদি কেউ এমন মিথ্যা মানহানির মামলা করে থাকেন, তাহলে আদালত তার বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ২১১ ধারা অনুসারে শাস্তি দিতে পারেন।  

সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক যুগান্তরকে বলেন, এক ঘটনায় একজনের বিরুদ্ধে ডজন ডজন মামলা করার মানে হচ্ছে ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থাকে স্রেফ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা।

আইনে রয়েছে, মানহানির মামলা একমাত্র ভুক্তভোগী ব্যক্তিই করতে পারে। আমার বিশ্বাস, এ কথা জানেন না এমন কোনো বিচারক দেশে নেই।

তা সত্ত্বেও যখন তারা (বিচারক) ডজন ডজন মামলা নিচ্ছেন, গ্রেফতারি পরোয়ানা দিচ্ছেন, এ থেকে ধারণা হচ্ছে-তারা সম্ভবত স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন না।

তিনি আরও বলেন, বিচার বিভাগের প্রশাসনিক ঊর্ধ্বতন ব্যক্তি হচ্ছেন প্রধান বিচারপতি। আইন ভঙ্গ করে এত মামলা কেন নেয়া হচ্ছে, তিনি সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে পারেন।

আর না হলে একই ঘটনায় যে কোনো ব্যক্তি, যে কোনো জেলায়, মামলা করতে পারবেন কিনা-সেটা আমাদের সবার জন্য স্পষ্ট করে দেয়া উচিত। 

মানহানি, বিয়ে ও চুক্তি ভঙ্গ-এ তিন বিষয়ে শুধু ভুক্তভোগী বা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিই মামলা করতে পারবেন অন্য কেউ না-বলেছেন আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।

তিনি বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের পরিষ্কার বিধান হচ্ছে, যদি মানহানির ব্যাপার ঘটে থাকে তবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি এসে মামলা করতে পারবে।

আদালত এত মামলা কোন আইনে নিচ্ছেন জানতে চাইলে জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, রাজনৈতিক নানান বিচার-বিবেচনার কারণে হয়তো বাধ্য হয়ে নিচ্ছেন।

অবৈধ ও অন্যায়ভাবে এ মামলাগুলো হচ্ছে। এসব মামলা আমলে নেয়ার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, মামলাগুলোতে বলা হচ্ছে, অমুক সাহেবের মানহানি হয়েছে, তিনি আমার খুব প্রিয়, সে কারণে আমি মামলা করছি।

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, আমার কর্মজীবনে দেখিনি এ পর্যন্ত কোনো মানহানির মামলা বিচারিক আদালত শেষ করে সুপ্রিমকোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে। অধিকাংশ মামলাই প্রমাণ হয়নি। 

দুর্নীতি দমন কমিশনের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খুরশীদ আলম খান যুগান্তরকে বলেন, পত্রিকায় রিপোর্টসংক্রান্ত বিষয়ে যদি কেউ বিক্ষুব্ধ হয়ে থাকেন, তাহলে সেই ব্যক্তিকেই মানহানির মামলা করতে হবে।

এখানে বিক্ষুব্ধ ব্যক্তিকেই আসা উচিত। আদালতের এ বিষয়ে একটা ব্যাখ্যা থাকা দরকার। 

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার বলেন, সম্মানহানি ঘটলে কেউ ফৌজদারি ও দেওয়ানি উভয় আদালতে মামলা করতে পারেন।

দণ্ডবিধিতে মানহানিকে অপরাধ সংজ্ঞায়িত করে এর লঙ্ঘন বা হানির ক্ষেত্রে শাস্তির বিধান করা হয়েছে। তিনি বলেন, সংবিধানের ৩৯ ধারা মোতাবেক যদিও বাকস্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু কারও ব্যাপারে মানহানিকর বক্তব্য দেয়া যাবে না।
 

মামলা

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম