বিশেষ প্রতিবেদন
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে স্বল্পমূল্যের ট্যাবলেট
এক মাস নিয়ন্ত্রণে থাকবে * নতুন দিশা দেখাচ্ছেন তরুণ বিজ্ঞানী
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৬ নভেম্বর ২০২১, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে চিকিৎসাবিজ্ঞান আরেক ধাপ এগিয়ে গেল। একাধিকবার ইনসুলিন গ্রহণের পরিবর্তে মুখে খাওয়ার স্বল্পমূল্যের একটিমাত্র ট্যাবলেট ডায়াবেটিস এক মাস নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম। গবেষণায় এর সফলতা পাওয়া গেছে। গবেষণাটি সম্পর্কে বিশ্বের শীর্ষ বিজ্ঞানীদের একটি প্যানেলের চূড়ান্ত অনুমোদন পেলে তা বাজারে আসবে। নয় সদস্যের গবেষক দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশের তরুণ বিজ্ঞানী শাতিল শাহরিয়ার। সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার খোড়দো গ্রামের তরুণ বিজ্ঞানী শাতিল বর্তমানে আমেরিকার ওয়ামাহায় ইউনিভার্সিটি অব নেব্রাস্কা মেডিকেল সেন্টারে পিএইচডি করছেন। আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির ম্যাগাজিন ‘ন্যানো লেটারসে’ গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে। এ সম্পর্কে বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকায়ও খবর প্রকাশিত হয়েছে।
বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিস ভয়ংকরভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। বাংলাদেশে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ৮৩ লাখ। চিকিৎসকরা জানান, রোগটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম, খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে উন্নতমানের ওষুধ কিনতে একজন রোগীকে বছরে ৭০ থেকে ৭৫ হাজার টাকা ব্যয় করতে হয়। রোগটি নিয়ন্ত্রণ রাখতে নানা ধরনের ওষুধ ছাড়াও ইনসুলিন ব্যবহৃত হয়। দীর্ঘদিন ও মাত্রাতিরিক্ত ইনসুলিন ব্যবহারে দেহে নানা ধরনের ক্ষতি হওয়ারও আশঙ্কা থাকে।
তরুণ বিজ্ঞানী শাতিল শাহরিয়ার গবেষণায় ইনসুলিনের বিকল্প হিসাবে খাওয়ার ট্যাবলেট জিএলপি-১ এগোনিস্ট (গ্লুকাগন লাইক পেপটাইড-১ এগোনিস্ট) এসেছে। এটি ব্যবহার করে এক মাস ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। কোরিয়া ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব ট্রান্সপোর্টেশন, কোরিয়া অ্যাডভান্সড ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি এবং হ্যানিয়াং ইউনিভর্সিটিতে গবেষণাটি পরিচালিত হয়। তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ, ভারত ও কোরিয়ার নয়জন বিজ্ঞানী গবেষণায় কাজ করছেন।
শুক্রবার মোবাইল ফোনে যুগান্তরকে গবেষক দলের প্রধান শাতিল শাহরিয়ার জানান, কোরিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি এ গবেষণায় সম্পৃক্ত হন। ডায়াবেটিস আক্রান্ত তিন জাতের ইঁদুর ও বানরের ওপর গবেষণা তারা করেন। ওষুধটি প্রয়োগ করে সফলতা পেয়েছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, মানুষের মতো ইঁদুরেরও ডায়াবেটিস হয়। অপর দিকে বানরের সঙ্গে মানবদেহের জিনগত অনেক মিল রয়েছে। বারবার ইনসুলিন গ্রহণের পরিবর্তে জিএলপি-১ এগোনিস্ট ট্যাবলেট প্রয়োগে শরীরের কোষগুলো থেকে প্রতিষেধক তৈরি হয়। এতে কোনো প্রকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। এমনকি ডায়াবেটিসের কারণে যেসব প্রাণীর যকৃত বা অন্যসব অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেগুলোও সেরে উঠতে ওষুধটি সাহায্য করে।
শাতিল শাহরিয়ার বলেন, ইঁদুর ও বানরের ওপর পরিচালিত গবেষণালব্ধ ইতিবাচক ফলাফল তাদের হাতে রয়েছে। তাদের গবেষণায় যে ওষুধ ব্যবহার করা হয়েছে সেটি যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফডিএ) স্বীকৃতি পেয়েছে। নতুন ওষুধটির ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। মানবদেহে সেটি প্রয়োগ করার বিষয়ে দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের কাছে তারা আবেদন করেছেন। তিনি আরও জানান, বিশ্বের শীর্ষ বিজ্ঞানীদের একটি প্যানেল এ বিষয়ের ওপর গবেষণা চালিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিলে তা অনুমোদন লাভ করবে। পরে তা বাজারে আসবে।
শাতিল শাহরিয়ার জানান, দশমিক ৪৮ মিলিগ্রামের ক্ষুদ্র ওষুধের দাম খুবই কম হবে। এটি পাউডার করে অথবা তরল আকারেও খাওয়া সম্ভব। মাসে একটিমাত্র ট্যাবলেট ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হবে। কোনো ডায়াবেটিস রোগীকে আর বারবার ইনজেকশনের মাধ্যমে ইনসুলিন ব্যবহারের মতো ঝামেলা পোহাতে হবে না।
সাতক্ষীরা ডায়াবেটিক হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. মাহমুদুল হক মুক্তা যুগান্তরকে বলেন, নতুন ওষুধটি বর্তমান ওষুধের চেয়ে ১৮ গুণ বেশি কার্যকর ও ফলপ্রসূ হবে। এতে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। এটি বাজারে এলে তা হবে বিশ্বের ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য একটি আশীর্বাদ। সাতক্ষীরার কৃতী সন্তান শাতিল শাহরিয়ারসহ তরুণ গবেষকদের চূড়ান্ত সফলতা আমরা কামনা করছি।
শাতিল শাহরিয়ার সম্পর্কে কলারোয়ার হাজি নাসিরউদ্দিন কলেজের অধ্যক্ষ শরিফুল ইসলাম বলেন, ২০১১ সালে এ কলেজ থেকে শাতিল এইচএসসি পাস করেন। সে অত্যন্ত মেধাবী, গবেষণাপ্রবণ ও কৌতূহলী ছাত্র। তার হাত দিয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে নতুন ওষুধ তৈরি হচ্ছে এবং তা এক দিন বাংলাদেশে আসবে। এতে আমরা গর্ববোধ করছি।
শাতিলের বাবা কলারোয়ার খোড়দো বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শহীদুল ইসলাম বলেন, ঢাকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্মাসিতে এমএসসি করে শাতিল কোরিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ঢাকায় অধ্যয়নকালে ডায়াবেটিসের ওপর তার গবেষণা শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন প্রফেসর ড. রহমতুল্লাহর অনুপ্রেরণায় শাতিল গবেষণা শুরু করেন এবং থিসিস জমা দেন। এরই ধারাবাহিকতায় কোরিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করে শাতিল সফলতা লাভ করেছেন।
