Logo
Logo
×

নগর-মহানগর

জেলহত্যার ৪৭ বছর

দণ্ডিত দশ আসামি আজও পলাতক

পলাতকদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে : আইনমন্ত্রী * শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারলে আইনের শাসন প্রশ্নবিদ্ধ হবে -ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ

Icon

আলমগীর হোসেন

প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০২২, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দণ্ডিত দশ আসামি আজও পলাতক

বাঙালি জাতির ইতিহাসে কলঙ্কময় জেলহত্যা মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তির ৯ বছর পরও পলাতক আসামিদের সাজা কার্যকর হয়নি। ৪৭ বছর আগের এ মামলার বিচারিক প্রক্রিয়ার তিনটি ধাপ পার হলেও দণ্ডিত ১১ আসামির ১০ জন আজও পলাতক। এদের ৩ জনের মৃত্যুদণ্ড ও ৮ জনের যাবজ্জীবন হয়। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ওই খুনিদের দেশে ফিরিয়ে এনে শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে কারা-সে বিষয়েও অনুসন্ধান চলছে।

দণ্ডিত ১১ জনের মধ্যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলো-বহিষ্কৃত তিন সেনাসদস্য-রিসালদার মোসলেহ উদ্দীন, দফাদার মারফত আলী শাহ ও দফাদার আবুল হাশেম মৃধা। আর যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্তরা হলো-ক্যাপ্টেন (অব.) কিসমত হাশেম, ক্যাপ্টেন (অব.) নাজমূল হোসেন আনসার, কর্নেল (অব.) খন্দকার আবদুর রশীদ, লে. কর্নেল (অব.) শরিফুল হক ডালিম, ক্যাপ্টেন (অব.) এমবি নূর চৌধুরী, ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদ, লে. কর্নেল (অব.) এএম রাশেদ চৌধুরী ও মেজর (অব.) আহম্মদ শরিফুল হোসেন। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় আবদুল মাজেদের মৃত্যুদণ্ড ২০২০ সালের ১১ এপ্রিল রাতে কার্যকর করে সরকার। মাজেদ ভারতে পলাতক। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত তিনজন কোথায় আছে সে ব্যাপারে সরকারের কাছে নিশ্চিত কোনো তথ্য নেই। শুধু যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত দুজনের ব্যাপারে তথ্য আছে। তাদের মধ্যে কর্নেল (অব.) এমবি নূর চৌধুরী কানাডা এবং লে. কর্নেল (অব.) এএম রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে আছে। নূর চৌধুরী বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায়ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত। তাকে দেশে ফেরাতে কানাডায় আইনি লড়াই চালাচ্ছে বাংলাদেশ। ২০১৯ সালের অক্টোবরে কানাডার আদালত বাংলাদেশের করা এ সংক্রান্ত একটি আবেদনে সাড়া দিয়েছেন। অন্যদিকে রাশেদ চৌধুরীও বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত। তাকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরাতে কয়েক বছর ধরেই মার্কিন প্রশাসনের নানা স্তরে অনুরোধ জানিয়ে আসছে সরকার। ২০২০ সালের অক্টোবরে মার্কিন উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন বিগানের ঢাকা সফরের সময় রাশেদকে ফেরানো নিয়ে আলোচনা হয়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর ওই বছর ৩ নভেম্বর কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি অবস্থায় হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামানকে। এমন হত্যাকাণ্ড পৃথিবীতে নজিরবিহীন।

জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক যুগান্তরকে বলেন, সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা এবং পরে জাতীর চার নেতা হত্যা মামলার বিচারকাজ সম্পন্ন হয়েছে। রায় কার্যকর চলছে। পলাতক যারা বিদেশে আছে, তাদের ফিরিয়ে আনার সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হচ্ছে। গোপনীয়তার রক্ষার্থে অগ্রগতি বলতে পারছি না।

৩ নভেম্বর জেলখানায় নৃশংস হত্যাযজ্ঞের পরদিন ৪ নভেম্বর তৎকালীন কারা উপমহাপরিদর্শক কাজী আবদুল আউয়াল লালবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় সেনাবাহিনীর রিসালদার মোসলেহ উদ্দিনের নাম উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, তার নেতৃত্বে চার-পাঁচজন সেনাসদস্য কারাগারে ঢুকে চার নেতাকে হত্যা করে। গুলি করার পর বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। ঘটনার পরদিন মামলা হলেও এই মামলার তদন্ত থেমে ছিল ২১ বছর। ১৯৯৬ সালের জুনে আবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মামলার কার্যক্রম শুরু হয়। জেলহত্যার ২৯ বছর পর ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালত মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে তিন আসামি রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন, দফাদার মারফত আলী শাহ ও দফাদার মো. আবুল হাশেম মৃধাকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১২ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ১২ জনের মধ্যে ওই সময়ে কারাগারে থাকা যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত চার আসামি সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা এবং একেএম মহিউদ্দিন আহমেদ (ল্যান্সার) বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করে। ২০০৮ সালের ২৮ আগস্ট হাইকোর্ট রায় দেন। রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত তিন আসামির মধ্যে রিসালদার মোসলেহ উদ্দিনের মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে। মারফত আলী শাহ ও দফাদার আবুল হাশেম মৃধা মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাস পায়। এছাড়া আপিল করা চার আসামি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকে খালাস পান। যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত অপর আট আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল থাকে।

তবে জেলহত্যা মামলায় অব্যাহতি পেলেও ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি রাতে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা এবং একেএম মহিউদ্দিন আহমেদের (ল্যান্সার) ফাঁসি কার্যকর হয়।

হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। সাবেক প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ ২০১৩ সালের ৩০ এপ্রিল চূড়ান্ত রায় দেন। আপিল বিভাগ দফাদার মারফত আলী শাহ ও দফাদার মো. আবুল হাশেম মৃধাকে খালাস করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বাতিল করে বিচারিক আদালতের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। ২০১৫ সালের ১ ডিসেম্বর আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়।

বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার লেখা ২৩৫ পৃষ্ঠার ওই রায়ে বলা হয়, ‘এ মামলায় পর্যাপ্ত প্রমাণ রয়েছে যে, ২ নভেম্বর রাতে রিসালদার মোসলেম উদ্দিনের সঙ্গে এ দুই আসামি কারাগারে ঢুকেছিল। তাদের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর আরও দুজন লোক ছিল। তারা তাদের আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে আওয়ামী লীগের চার নেতাকে হত্যা করে। হাইকোর্ট বিভাগ এ দুই অভিযুক্তকে নির্দোষ দেখিয়ে ভুল এবং অবিচার করেছেন।

সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, ৩ নভেম্বর বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি কলঙ্কিত দিন। এমন হত্যাকাণ্ড পৃথিবীতে নজিরবিহীন। এ হত্যার বিচার হয়েছে, কিন্তু খুনিদের শাস্তি নিশ্চিত করা হয়নি। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য। শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, না হলে আইনের শাসন প্রশ্নবিদ্ধ হবে।

পলাতক আসামি জেলহত্যা

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম