Logo
Logo
×

নগর-মহানগর

অনিয়মের ঘেরাটোপে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র

বই নির্বাচন কমিটিতে নেই লেখক * গুরুত্বপূর্ণ ২১ পদ শূন্য * দায়সারা বইমেলার আয়োজন

Icon

হক ফারুক আহমেদ

প্রকাশ: ২৯ জুন ২০১৮, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

অনিয়মের ঘেরাটোপে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র

আকারে ছোট ও বাজেট তুলনামূলক কম হলেও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান। তবে সমস্যা ও অনিয়মের ঘেরাটোপে আটকা পড়েছে এর কার্যক্রম।

সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের অন্যতম লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য দেশে জ্ঞান ও মননশীলতার উৎকর্ষ সাধন করা।

আন্তর্জাতিক, বিভাগীয়, জেলা-উপজেলা পর্যায়ে বইমেলার আয়োজন করা, বেসরকারি গ্রন্থাগারগুলোর মধ্যে আর্থিক অনুদান ও বই প্রদান ও নানা সেমিনারসহ বই সংক্রান্ত নানা কাজ করে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু ভেতর ও বাইরে নানারকম সমস্যা এবং অনিয়ম জর্জরিত প্রতিষ্ঠানটি অনেকটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে।

প্রতিষ্ঠানটির ২১টি গুরুত্বপূর্ণ পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য, জনবলের অভাবে কাজের গতি নেই, বইমেলাগুলো অনেকটা দায়সারা আয়োজনের। বেসরকারি গ্রন্থাগারগুলোর মধ্যে আর্থিক অনুদান ও বই প্রদান করার যে কার্যক্রম তার স্বচ্ছতা নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। বই নির্বাচন কমিটিতে নেই খোদ লেখকরাই।

রাজধানীর গুলিস্তানে অবস্থিত জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে গ্রন্থাগারিক, প্রোগ্রাম অর্গানাইজার, সহকারী পরিচালক (প্রদর্শনী ও বিক্রয়), সহকারী পরিচালক (প্রকাশনা), সহকারী পরিচালক (গবেষণা), প্রকাশনা কর্মকর্তা, গবেষণা কর্মকর্তা, হিসাবরক্ষক কর্মকর্তাসহ ২১টি গুরুত্বপূর্ণ পদ শূন্য।

দেশের নানা জায়গায় প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে যে বইমেলার আয়োজন হয় তাও অনেকটা দায়সারা গোছের। মেলা আয়োজনের জন্য যে বরাদ্দ দেয়া হয় তা খরচের দায়িত্বে মূলত পালন করে জেলা প্রশাসন। সেখানে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের কর্তৃত্ব থাকে খুব সামান্যই।

মাঠপর্যায়ে জনবলের অভাবে তারা তদারকির কাজটিও করতে পারেন না। প্রতিষ্ঠান থেকে দেশের গ্রন্থ ও সাহিত্য জগতের মাসিক পত্রিকা ‘বই’-এর প্রকাশনা প্রায় এক বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। সেমিনার সভাও হয় হাতেগোনা।

বেসরকারি গ্রন্থাগারগুলোতে আর্থিক অনুদান ও বই প্রদান কার্যক্রম কিছু হচ্ছে। এ কার্যক্রমের আওতায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৭৫২ টি রেজিস্ট্রার্ড বেসরকারি পাঠাগারের মধ্যে ২ কোটি টাকার নানা ধরনের বই ও আর্থিক অনুদান দেয়ার কথা।

এ লাইব্রেরিগুলোর মধ্যে আবার এবিসি তিনটি ক্যাটাগরি আছে। ক্যাটাগরি অনুযায়ী যথাক্রমে ৩০ হাজার ৩৩২, ২৫ হাজার ও ২ হাজার টাকার অর্ধেক মূল্যের বই ও বাকি অর্ধেক টাকার চেক দেয়া হয়। প্রতি বছর পাঠাগারের জন্য ১ কোটি টাকার বই কেনা হয়।

সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রোকসানা মালেককে আহ্বায়ক করে ১০ সদস্য বিশিষ্ট ‘বই বাছাই কমিটি’র সুপারিশে বই কেনা হয়। কিন্তু কমিটির সদস্য পদে কোনো লেখক নেই।

জানা গেছে, নিয়ম অনুযায়ী ১০টি সভার মধ্যে বই নির্বাচনের সমুদয় কার্যক্রম সম্পন্ন করার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত ১৬টি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

বর্তমানে বই বাছাইয়ের কাজ শেষ পর্যায়ে। এ ব্যাপারে দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, পাঠাগারের জন্য বইয়ের নির্বাচনও আমলাতান্ত্রিকভাবে হচ্ছে। কিন্তু কোনটি আসলে ভালো বই, মানসম্পন্ন বই সেটা ভালো বলতে পারবেন বিভিন্ন ধারার লেখকরা। লেখকদের সম্পৃক্ততা সেখানে বেশি প্রয়োজন। কিন্তু সেটি হয়নি।

জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের ১৭ সদস্যবিশিষ্ট পরিচালনা বোর্ড রয়েছে। যাদের মধ্যে অন্যতম শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।

তিনি যুগান্তরকে বলেন, আমাদের পাশের দেশ ভারতের এ বিষয়ক প্রতিষ্ঠানটি প্রচুর কাজ করছে। আর আমাদের জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র অনেকটাই নিভু নিভু প্রতিষ্ঠান।

বোর্ডের সদস্যদের নিয়ে ৩ মাস বা ৬ মাসে একটি সভা হয়। নানা আলোচনা হয়, তারপর আবার সব নিশ্চুপ। অনেকটাই দায়সারা গোছের কাজ হচ্ছে। তবে অনেকেই আছেন যারা ভালো কাজ করতে চান বা চেষ্টা করেন। কিন্তু জনবল, পর্যাপ্ত বাজেট না থাকায় সেটা সম্ভব হয় না।

অনেক সময় দেখা যায়, এমন পাঠাগার অনুদান পেল যা হয়তো নামসর্বস্ব। এগুলো সেভাবে মনিটরিংয়ের জন্যও প্রতিষ্ঠানটির জনবল নেই।

প্রতিষ্ঠানটির বাজেট ও জনবল বাড়িয়ে মহাপরিচালকের মতো পদ তৈরি করা যেতে পারে। পদটির জন্য ভাষা, সাহিত্য, শিক্ষাক্ষেত্রে যারা কাজ করছেন তাদের দায়িত্ব দিতে হবে। আর গুলিস্তানের মতো জায়গা থেকে সরিয়ে অন্য কোথাও নতুনভাবে সুন্দর করে সাজানো জরুরি।

আর বই বাছাই কমিটিতে বিভিন্ন ধারার লেখক- যারা বই নিয়ে চিন্তা করেন তাদের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। তালিকায় দেখা যায় এমনও বই চলে আসে যা হয়তো আসার উপযুক্ত নয়।

বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশনীর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি খান মাহবুব বলেন, ‘জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের কার্যক্রম প্রসারিত করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। অনেক সমস্যার ভেতর থেকে সমাধানের পথটি খুঁজে বের করতে হবে।

জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের বর্তমান পরিচালক একেএম রেজাউল করিম কয়েক মাস আগে দায়িত্ব পেয়েছেন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, জনবল ও বাজেটের বড় ধরনের সমস্যা রয়েছে।

আরেকটি বড় সমস্যা প্রতিষ্ঠানটি এমন জায়গায় যার চারপাশ ঘিরে আছে হকাররা। তাদের সঙ্গে অনেকের রেষারেষির ঘটনাও ঘটেছে।

রেজাউল করিম বলেন, এ বছর একটি আন্তর্জাতিক বইমেলার পাশাপাশি দেশব্যাপী অনেকগুলো বইমেলা ও সেমিনারের আয়োজনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।

আমি আশাবাদী ভালো কিছু করা সম্ভব হবে। তবে তার জন্য বাজেট বাড়ানো জরুরি। সেটা পেলে মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন ও ইতিহাসনির্ভর আরও আকর গ্রন্থ সংগ্রহ করে পাঠকদের মধ্যে আমরা সেগুলো ছড়িয়ে দিতে পারব।

এদিকে ২০১০ সালে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রকে পুনর্গঠন করে বাংলাদেশ গ্রন্থ উন্নয়ন পরিষদের রূপদানের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু বিষয়টি এখনও কাগজে-কলমেই রয়ে গেছে।

গ্রন্থাগার

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম