Logo
Logo
×

নগর-মহানগর

চট্টগ্রামে বর্ষায় পাহাড় ধসের আতঙ্ক

৩৬ সুপারিশের একটিও বাস্তবায়ন হয়নি

পাহাড় কাটা ও অবৈধভাবে বসতি স্থাপন চলছে আগের মতোই * চসিক গ্রহণ করেছে আপৎকালীন পরিকল্পনা

Icon

আহমেদ মুসা, চট্টগ্রাম

প্রকাশ: ১৩ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ষোলো বছর পরও চট্টগ্রামে পাহাড় কাটা বন্ধে তদন্ত কমিটির ৩৬ সুপারিশের একটিও বাস্তবায়ন হয়নি। নগরীর বিভিন্ন পাহাড়ে অবৈধভাবে বসতি স্থাপন আগের মতোই চলছে। তাই বর্ষা মৌসুম এলেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। চট্টগ্রামে দুদিন ধরে হালকা ও মাঝারি বর্ষণ অব্যাহত রয়েছে। নগরীর পৃথক ১১টি ওয়ার্ডের বিভিন্ন এলাকা রয়েছে পাহাড়ধসের সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে। ওয়ার্ডগুলোর ৪ হাজার ৬২৫টি ভবন ও অবকাঠামো আছে পাহাড়ধসের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত এলাকায়। রয়েছে ২৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ১৫টি স্বাস্থ্যকেন্দ্রও। ওয়ার্ডগুলোয় পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসতি স্থাপন বন্ধ না হওয়ায় পাহাড়ধসে প্রাণহানির শঙ্কা থেকেই যায়।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) প্রণীত ‘মাল্টি হ্যাজার্ড কন্টিনজেন্সি প্ল্যান ফর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন’-এর আপৎকালীন কর্মপরিকল্পনায় এসব তথ্য উঠে আসে। এতে পাহাড়ধসের কারণ, তা রোধ এবং প্রাণহানি এড়াতে বৃক্ষরোপণ ও বনায়নে গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন সুপারিশ করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন বুধবার চসিক মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর কাছে হস্তান্তর করা হয়। এটি প্রণয়নের ক্ষেত্রে কনসালটেন্ট হিসাবে কাজ করেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. শাহ জালাল মিশুক। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেভ দ্য চিলড্রেন ও ইপসা কর্মপরিকল্পনাটি প্রণয়নে সহযোগিতা করে।

এদিকে তদন্ত কমিটির ৩৬ সুপারিশমালার একটিও বাস্তবায়ন না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সহসভাপতি প্রফেসর ড. ইদ্রিস আলী। ২০০৭ সালের ১১ জুন লালখান বাজার মতিঝর্ণা এলাকায় স্মরণকালের ভয়াবহ পাহাড়ধসে মারা গিয়েছিলেন ১২৭ জন। একই দিন নগরীর আরও আট স্থানে পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটেছিল। এছাড়াও দুই যুগে নগরে ২৫৯ জন মারা গেছেন পাহাড়ধসে। এর মধ্যে সর্বশেষ চলতি বছরের ৮ এপ্রিল আকবর শাহ থানার বেলতলী ঘোনায় মারা যান একজন। এছাড়া দুই যুগ আগে পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে ১৯৯৯ সালের ১৩ আগস্ট। ওইদিন সিআরবি পাহাড়ের একাংশের সীমানা প্রাচীরসহ পাহাড়ধসে মারা যান ১০ জন।

২০০৭ সালে পাহাড়ধসের পর তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশে গঠন করা হয়েছিল পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি। চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারকে সভাপতি ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (রাজস্ব) সদস্য সচিব করে এ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এছাড়াও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম এবং পরিবেশ অধিদপ্তর পৃথক দুটি কারিগরি রিপোর্ট দিয়েছিল। তদন্ত কমিটিগুলো ভূমিধসের ২৮টি কারণ চিহ্নিত করে পাহাড় সুরক্ষায় ৩৬টি সুপারিশ দেয়। পাহাড়ধস রক্ষায় দীর্ঘ, মধ্যম ও স্বল্পমেয়াদি সুপারিশ করা হয়। ১৬ বছরে একটি সুপারিশও বাস্তবায়ন হয়নি। রোববার ওই মর্মান্তিক ঘটনার ১৭ বছরে পড়েছে। তারপরও পাহাড় কাটা রোধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। চসিকের ১১টি ওয়ার্ডকে পাহাড়ধসের ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব ওয়ার্ডের মধ্যে রয়েছে ১নং দক্ষিণ পাহাড়তলী, ২নং জালালাবাদ, ৩নং পাঁচলাইশ, ৭নং পশ্চিম ষোলশহর, ৮নং শুলকবহর, ৯নং উত্তর পাহাড়তলী, ১৩নং পাহাড়তলী, ১৪নং লালখান বাজার, ১৫নং বাগমনিরাম, ১৬নং চকবাজার এবং ২২নং এনায়েত বাজার ওয়ার্ড। এসব ওয়ার্ডে লালখান বাজার মতিঝর্ণা, টাঙ্কির পাহাড়, বাটালি হিল, গোলপাহাড়, এ কে খান পাহাড়, রৌফাবাদ পাহাড়, ফিরোজশাহ, কুসুমবাগ, জালালাবাদ পাহাড়, মুক্তিযোদ্ধা পাহাড়, আরেফিন নগরসহ ৩০টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, নগরীতে প্রায় ৩০ হাজার ৭৮৬ জন মানুষ পাহাড়ধসের ঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে ২ হাজার ৭৭১ শিশু আছে। নিয়মিত পাহাড়ধস হলে প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ ধসে পড়া কাঠামোর ভেতরে আটকা পড়বে। এর মধ্যে ১০ শতাংশ মারা যেতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। পুনর্বাসন সমস্যার সমাধান করা না গেলে পাহাড়ধসের কারণে ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হয়।

চুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. শাহ জালাল মিশুক বলেন, নগর ঝুঁকি নিরূপণের উদ্দেশ্য হচ্ছে সম্ভাব্য আপদগুলো বিশ্লেষণের মাধ্যমে ঝুঁকির প্রকৃতি ও মাত্রা নির্ণয় করা। এর মাধ্যমে কোনো নির্দিষ্ট এলাকার জনগোষ্ঠী যে ঝুঁকিগুলো মোকাবিলা করছে, এর মাত্রা পরিমাপ করা যায়। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার আশপাশে ভবন নির্মাণ কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ, স্বল্প-আয়ের মানুষের জন্য তাদের সামর্থ্যরে মধ্যে আনুষ্ঠানিক আবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাসকারী মানুষের মনস্তাত্ত্বিক সংকট সমাধানের দিকে জোর দিতে হবে।

সব আগের মতো রয়ে গেছে-বাপা : বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) নেতারা বলছেন, ৩৬ দফা সুপারিশের একটিও বাস্তবায়ন করা হয়নি। ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কথা বলা হয়েছিল। এটিও বাস্তবায়ন হয়নি। সব আগের মতো রয়ে গেছে। শুধু জুন মাস এলেই পাহাড়ের জন্য দরদ বাড়ে।

একটি সুপারিশও বাস্তবায়ন না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বাপার সহসভাপতি প্রফেসর ড. ইদ্রিস আলী যুগান্তরকে বলেন, ‘এ পর্যন্ত ৩০০-এর কাছাকাছি লোকজন মারা গেছেন। পাহাড়ধস বন্ধের জন্য সুপারিশমালা হলো। জুন এলে বিশেষ করে ১১ জুন (এইদিনে পাহাড়ধসে ১২৭ প্রাণহানি হয়) চসিকের মেয়রও নড়েচড়ে ওঠেন। আমলারা সারা বছর কোনো মিটিং করেন না। কত ডিসি এলেন-গেলেন, কমিশনার হয়ে আবার এলেন। পাহাড়ধস দেখা গেল। কিন্তু তাদের কোনো অনুশোচনা নেই।’

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম