পুলিশের তালিকায় ৬৫০ জনের নাম
রাজশাহীর আইনশৃঙ্খলায় বড় হুমকি কিশোর গ্যাং
রাজশাহী ব্যুরো
প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
রাজশাহী মহানগরীতে আবারও ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে কিশোর গ্যাং। হত্যাকাণ্ড, সন্ত্রাসী হামলা, চাঁদাবাজি, মাদক বিক্রি ও গ্রহণ ছাড়াও চুরি-ছিনতাইয়ের মতো অপরাধে জড়াচ্ছে এরা। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের এরা উত্ত্যক্ত ও যৌন হয়রানি করছে। বছর দুয়েক আগে মহানগরীতে কিশোর গ্যাংয়ের পাঁচ শতাধিক সদস্যের ডাটাবেজ তৈরি করেছিল পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট। তবে পুলিশের নজরদারির অভাবে এলাকাভিত্তিক গড়ে ওঠা বিভিন্ন কিশোর গ্যাং আবারও দাপিয়ে বেড়াচ্ছে নগরী। নতুন নতুন গ্রুপও তৈরি হচ্ছে। ছিনতাই ও ছুরিকাঘাত যেন নিত্যদিনের ঘটনা। এমনকি দলবেঁধে প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে উল্লাস নৃত্যও করছে তারা। কিশোর ছিনতাইকারীদের কারণে বিশেষ করে ভোর ও রাতের রাজশাহী আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। এতে নগরবাসীর মধ্যে তৈরি হয়েছে নতুন আতঙ্ক। মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার ভোর পর্যন্ত নগরীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ দেশীয় অস্ত্রসহ কিশোর গ্যাংয়ের সাত সদস্যকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
ভুক্তভোগী নগরবাসীর অভিযোগে জানা গেছে, সন্ধ্যা হলেই এসব কিশোর দলবেঁধে মোটরসাইকেল বহর নিয়ে সড়কে নেমে পড়ে। পথচারী নারীদের শাড়ি-ওড়না ধরে টান দেয় প্রায়ই। সুযোগ পেলে ছিনতাইও করে। শুধু তাই নয়, প্রতিটি গ্রুপের হাতেই রয়েছে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র।
সম্প্রতি নগরীর শাহ মখদুম থানার গাংপাড়া এলাকায় প্রতিপক্ষের আরাফাত নামে এক কিশোরকে হামলা চালিয়ে মারাত্মক আহত করে অস্ত্র উঁচিয়ে নৃত্য করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। তুমুল ভাইরাল হওয়া ওই ভিডিওতে দেখা যায়, বাদ্যের তালে তালে চাইনিজ কুড়াল, ছুরি, রাম-দা ও অন্য দেশি অস্ত্র নিয়ে কিশোর গ্যায়ের কিছু সদস্য নৃত্য করছে। মঙ্গলবার রাতে এই ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এর পরই পুলিশ তাদের গ্রেফতারে মাঠে নামে।
মঙ্গলবার রাতভর অভিযানে নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে সাত কিশোরকে গ্রেফতার করে আরএমপির শাহ মখদুম থানা পুলিশ। গ্রেফতারকৃতরা হলো, রফিকুল ইসলাম সম্রাট (২১), নাজমুস সাকিব আবির (২১), মোহাইমিনুল শেখ (২০), জিসাদ (২০), সোহেল রানা (২১), মনিরুল ইসলাম অপূর্ব (২২) ও মারুফ হোসেন (২১)। এরা সবাই নগরীর শাহ মখদুম থানা এলাকার বাসিন্দা। পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা জানিয়েছে। ভয়ংকর এই গ্রুপটি রাজশাহীর আমচত্বরসহ আশপাশের সড়কে নানাবিধ অপরাধ করে আসছিল।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহীতে বিভিন্ন ওয়ার্ডে ও পাড়া-মহল্লায় নানা নামে গড়ে উঠেছে কিশোর গ্যাং। এর মধ্যে ‘টেন স্টার বয়’ গ্রুপের নাম-ডাক বেশি। গত ২ মে চন্দ্রিমা থানার ছোট বনগ্রাম পশ্চিম পাড়া এলাকায় এই গ্রুপের সদস্যদের ধারালো অস্ত্রের কোপে সিয়াম, আকাশ, সোহান ও মাহিম নামে চার যুবক গুরুতর আহত হন। এ ঘটনায় আসাম কলোনি রবের মোড় এলাকার প্রেম (২০), শিশির (১৮), বাবু (১৯) ও ইমনের (২১) বিরুদ্ধে চন্দ্রিমা থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করা হয়।
স্থানীয়রা জানান, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা এলাকায় ডাব চুরি থেকে শুরু করে পোলের তার চুরি, চাঁদাবাজি, ছিনতাইয়ে জড়িত। এছাড়া স্কুল পড়ুয়া মেয়েদের উত্ত্যক্তসহ এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করে চলেছে। এদের হামলার শিকার হয়ে অনেকে ভয়ে মুখ খুলতে চায় না। এই বয়সেই এদের বেশিরভাগ মাদকাসক্ত। অনেকে অস্ত্র হাতে নিয়ে ছবি তুলে ফেসবুকে আপ করে। অভিযোগ রয়েছে এদের বেশিরভাগকে নিয়ন্ত্রণ করছেন ওয়ার্ড পর্যায়ের আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা। এদের পৃষ্ঠপোষকতায় আছেন রাসিকের কয়েকজন ওয়ার্ড কাউন্সিলরও। এসব গ্রুপের সদস্যরা বেশিরভাগ নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের বখে যাওয়া সন্তান।
জানা গেছে, রাতের নগরী বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। রাত ১১টার পর বিভিন্ন সড়ক ও মোড়ে মোড়ে ওঁৎ পেতে থাকে এরা। সুযোগ পেলেই অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ছিনতাই করছে। ভোরে ঢাকা থেকে ট্রেনে বা বাসে আসা যাত্রীরাই ছিনতাইচক্রের প্রধান টার্গেট। গত ২৯ অক্টোবর রাতে রাজশাহী রেলস্টেশন এলাকায় সশস্ত্র ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন দুই কলেজছাত্র কৌশিক ও অভিজিৎ। ছিনতাইকারীদের ধারাল অস্ত্রের আঘাতে আহত হয়ে তারা দুজনই হাসপাতালে ভর্তি হন। কৌশিকের বুকে ৫০টি এবং অভিজিতের বুকে ৩০টি সেলাই দিতে হয়েছে।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর দিনের বেলায় নগরীর কাদিরগঞ্জ এলাকায় ছিনতাইকারীদের আঘাতে মাথায় গুরুতর আঘাত পান রাজশাহী কলেজের পরিসংখ্যান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র নিশাদ আকরাম রিংকু। ১৬ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে গত ৩ অক্টোবর তিনি মারা যান। চলতি বছরের ৭ এপ্রিল ছিনতাই করে পালানোর সময় অনিক (১৯) নামের এক কিশোর নগরীর ডাবতলা এলাকায় মোটরসাইকেলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। এ ঘটনায় তার আরেক সহযোগী মারুফ হোসেন (১৮) মারাত্মক আহত হয়।
কিশোর অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক হবিবুর রহমান। তিনি বলেন, ১৬-২২ বছর বয়সিরাই এই চক্রের বেপরোয়া সদস্য। এই বয়সে তারা হিরোইজম দেখাতে চায়। এজন্য নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে এরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব এদের সুপথে ফিরিয়ে আনা।
সাম্প্রতিক সময়ে কিশোর গ্যাংয়ের উত্থান ঘটেছে বলে স্বীকার করেছেন রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) বিজয় বসাক। তিনি বলেন, দেড় বছর আগে কিশোর গ্যাংয়ের প্রায় ৫০০ সদস্যের ডিজিটাল ডাটাবেজ তৈরি করা হয়েছিল। তবে এখন এই সংখ্যা অন্তত ৬৫০। বিভিন্ন এলাকায় নতুন নতুন গ্রুপ তৈরি হচ্ছে। তবে তাদের ওপর পুলিশের কড়া নজরদারি রয়েছে। কোনো অপরাধ করে কেউ পার পাবে না। এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।
