রিকশা না চালিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন রনি
উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায় মা
একে সালমান, মোহাম্মদপুর (ঢাকা)
প্রকাশ: ১৮ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা হতে দেখে ১৮ জুলাই রিকশা চালানো বাদ দিয়ে মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেন জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দা রনি (১৮)। ওইদিন বিকালে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা গুলি করলে তার বুক ভেদ করে বুলেট চলে যায়। ঘটনাস্থলে মারা যান এই তরুণ। তবে এ খবর ধামাচাপা দেওয়ার জন্য হাসপাতাল থেকে দেওয়া হয়নি মৃত্যুসনদ। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা নানা রকম চাপ দিয়ে তড়িঘড়ি করে লাশ দাফন করান। ১৮ জুলাই রাজধানীর মোহাম্মদপুরে তিন রাস্তার মোড়ে এ ঘটনা ঘটে। এখন ছেলে হত্যার বিচার চাইতে গিয়েও আতঙ্কে রয়েছেন মা। সব হারানো এ বৃদ্ধা সাহস পাচ্ছেন না মামলা করা।
আশপাশের বাসিন্দারা জানান, ৮ মাস আগে রনির বাবা মারা যান। এরপর রিকশা চালিয়ে সংসারের হাল ধরেন রনি। মাকে নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকতেন। সেই সুখ আর কপালে জুটল না। স্বামী হারানোর ৮ মাস পর ছেলেকে হারিয়ে এখন পাগলের মতো আচরণ করছেন নিহত রনির মা পারভীন বেগম। একা একা কথা বলে চোখের পানি ফেলতে থাকেন তিনি। বাসা ভাড়া দেওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে এখন ভাসুরের পরিবারের সঙ্গে বসবাস করেন। একমাত্র উপার্জনক্ষম ও বুকের ধন ছেলেকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। আচরণ করছেন পাগলের মতো। ছেলেকে হারানোর দিন থেকে কেউ জোর করে তাকে খাওয়াতে পারছেন না। এমন টগবগে যুবককে হারিয়ে আত্মীয়স্বজনরাও বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন।
নিহত রনির মা পারভীনের সঙ্গে বৃহস্পতিবার (১৫ আগস্ট) জেনেভা ক্যাম্পে গিয়ে কথা হয়। তিনি বলেন, আমার বুকের ধনটা রিকশা চালিয়ে যা আয় করত তাই দিয়ে আমার বাসা ভাড়া, খাওয়া-দাওয়া হয়ে যেত। ১৮ জুলাই দুপুরে আমার ছেলে রিকশা চালানো বাদ দিয়ে হঠাৎ বাসায় চলে আসে। বাসায় এসে বলে মা খাবার দাও। রাস্তায় দেখেছি পুলিশ ও সরকারের লোকজন ছাত্রদের অনেক মারতেছে। ছাত্রদের এভাবে মার খেতে দেখে আমার সহ্য হচ্ছে না। তাই আজকে আর রিকশা চালাব না। ছাত্রদের সঙ্গে আন্দোলনে যেতে তাড়াতাড়ি বাসায় চলে এসেছি। একথা বলতে বলতে আমার ছেলে খাওয়া শেষ করে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। তখনও বুঝতে পারিনি আমার বুকের ধনকে আমি হারিয়ে ফেলব। হঠাৎ করে রাতে ক্যাম্পের কয়েকজন খবর নিয়ে আসে আমার ছেলের লাশ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে দেখেছে। এ খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমি দৌড়ে হাসপাতালে গিয়ে আমার ছেলেকে দেখে অজ্ঞান হয়ে যাই। আমি আর কিছু বলতে পারি না। আমার ছেলেকে হত্যার বিচার চেয়ে মামলা করতে যাব, সেই সামর্থ্য আমার নেই। আমি আমার একমাত্র বুকের ধন ছেলে হত্যার বিচার চাই।
রনির চাচাতো বোন রোজী বেগম বলেন, খবর শুনে ওই দিন হাসপাতালে গিয়ে রনির লাশ আমরা দ্রুত নিয়ে আসি। কিন্তু হাসপাতাল থেকে আমাদের কোনো কাগজ দেয়নি। চাচাতো ভাইকে হারিয়ে আমাদের মনের অবস্থা কারও ভালো নেই। রনি মারা যাওয়ার পর আমার চাচি পাগলের মতো আচরণ শুরু করেছেন। তার আর কোথাও থাকার জায়গা নেই। বাসাটাও ছেড়ে দিতে হয়েছে। বর্তমানে আমার মায়ের সঙ্গে আমাদের বাসায় থাকছেন। আমরা রনি হত্যার বিচার চাই। আর কেউ যেন এমন হত্যা করতে সাহস না পায়। আমরা এর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।
ক্যাম্পের কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, জেনেভা ক্যাম্পে থাকা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও কাউন্সিলরের সহযোগীদের কারণে তাড়াহুড়া করে তার লাশ দাফন করতে হয়েছে। এ ঘটনা যেন বাইরে কেউ জানতে না পারে সেজন্য তাদের বিভিন্নভাবে বোঝানো হচ্ছে। পাশাপাশি ক্যাম্পের ভেতর থাকা অনেক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী তার মাকে মামলা করে ছেলেকে আর ফেরত পাওয়া যাবে না বলে নানা রকম ভুল বুঝিয়ে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে।
