স্বার্থের সার্থকতা?
মোহাম্মদ হাফিজ উদ্দিন
প্রকাশ: ২৯ এপ্রিল ২০১৯, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
জগৎজুড়ে চলছে স্বার্থের লড়াই। এ লড়াইয়ে পিষ্ট হয়ে কত প্রাণ অকালে ঝরে যাচ্ছে, কত হৃদয় ভেঙে খান খান হয়ে যাচ্ছে, তার ইয়ত্তা নেই। স্বার্থের সঙ্গে মর্যাদার লড়াই যুক্ত হয়ে জগতে নেমে আসে অশান্তি। এত যে লড়াই চলছে, তবু আমাদের সত্যিকার স্বার্থটা কী, কিসে আমাদের মর্যাদা- আমরা কি আদৌ তা বুঝতে পেরেছি? জীবনের অন্তিম মুহূর্তে এসে অনেকেই এই সত্যটা উপলব্ধি করতে পেরে শুধু হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। কিন্তু ততদিনে কতজন যে এই স্বার্থের বলি হয়ে গেছেন, তার হিসাব আর জানা যায় না।
সমাজে স্বার্থপর মানুষের যেমন অভাব নেই, তেমনি নিঃস্বার্থ আলোকিত মানুষও আছেন। আবার নিঃস্বার্থ-নির্লোভ হিসেবে পরিচিত মানুষের মধ্যেও খুঁজে পাওয়া যায় চরম স্বার্থপরতার ঘটনা। স্বার্থ ও মর্যাদা ভাবনাটি সবার ক্ষেত্রে একরকম হয় না। কারও ভাবনা জগৎকে আলোকিত করে, কারও অন্ধ ভাবনা আবার সমাজকে নিয়ে যায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।
একই সমাজে পাশাপাশি বসবাস করে কেউ তার সর্বস্ব বিলিয়ে দেয় জগতের কল্যাণে, কেউ আবার সমাজে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করে গড়ে তোলে আপন সুখের প্রাসাদ। এই পার্থক্য শুধু জ্ঞান, দৃষ্টিভঙ্গি আর উপলব্ধিতে। কারও উপলব্ধিতে জগতের সব মানুষ সমান। আর এ সমানাধিকার অর্জনের লক্ষ্যে তিনি এগিয়ে যান দৃঢ় প্রত্যয়ে। একজন মানুষের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি কখনও কখনও পুরোপুরি পরিবর্তন এনে দেয় একটি সভ্যতায়। মানুষ অন্ধকার থেকে আলোর দিকে ধাবিত হয়। বিপরীতে একজন মানুষের আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থবাদিতার কারণে বহু সভ্যতা ধ্বংস হয়েছে। স্বার্থের এ মারাত্মক নেশা হেরোইনের নেশার চেয়েও ভয়ংকর।
ভালো বা মন্দ সব ধরনের কাজের পেছনে যে জিনিসটি লুক্কায়িত থাকে তা হল মনের সন্তুষ্টি ও আনন্দ। মানুষের প্রতিটি কাজের পেছনে কিছু না কিছু আনন্দ নিহিত থাকে, থাকে সন্তুষ্টি। আনন্দ না থাকলে মানুষ কোনো কাজই করতে পারত না। কেউ যখন সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করে শরীরের ঘাম ঝরিয়ে দিনশেষে কিছু চাল, তরিতরকারি, মাছ আর সন্তানের জন্য এক প্যাকেট বিস্কুট হাতে বাড়ি পৌঁছে, তখন তার ওই আনন্দ অনুভব করার মতো মন সবার থাকে না।
একজন ছাত্র যখন প্রচুর পড়াশোনা করে ভালো ফল করে, তখন সেও এর মধ্যে প্রচুর আনন্দ খুঁজে পায়, যা তাকে পরবর্তী বছরে আরও ভালো ফল করার উৎসাহ জোগায়। আবার যে বখাটে ছেলেটি লেখাপড়া বাদ দিয়ে রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকে, সেও এর মধ্যে কোনো না কোনো অনৈতিক আনন্দ খুঁজে পায়। কেউ বা পরের পকেটের টাকা চুরি করে বাজে নেশা করেও আনন্দ পায়। পরের অধিকার হরণ করে বিলাসবহুল প্রাসাদে শুয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলেও কেউ আনন্দ পায়।
নিজের সম্পদ ভোগের অধিকার স্বেচ্ছায় ত্যাগ করে যারা অন্যের মুখে হাসি ফোটান, তারাও কিন্তু পরমানন্দ অনুভব করেন এবং সেখানেই খুঁজে পান জীবনের সার্থকতা। তারা মরণশীল হয়েও যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকেন মানুষের অন্তরে।
তাই নৈতিক ও ভালো কাজে যেমন আনন্দ আছে, তেমনি অনৈতিক ও মন্দ কাজেও আনন্দ আছে। তবে এ দুই আনন্দের পরমানন্দ এক নয়। ভালো কাজের আনন্দ স্থায়ী, আর মন্দ কাজের আনন্দ অস্থায়ী। নৈতিক যে আনন্দ তা মানুষকে তার সঠিক কর্মপথ দেখায়, লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করে। নৈতিকতার মধ্য দিয়ে যে আনন্দ উপলব্ধি করা যায়, তার সুফল কেবল একজন ব্যক্তি নিজেই ভোগ করেন না- তার পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সবাই ভোগ করে। কাজেই কে কোন আনন্দটিকে গ্রহণ করবে; তা নির্ভর করে তার নিজের জ্ঞান ও দৃষ্টিভঙ্গির ওপর।
মানুষ চারপেয়ে পশুর মতো নয়। জগতের ধারাবাহিকতায় শুধু জন্ম, বেড়ে ওঠা আর মৃত্যুর নামও মানবজীবন নয়। আসুন, একটু ভাবি, খামখেয়ালিপূর্ণ স্বার্থের সার্থকতা আসলে কতটুকু?
মোহাম্মদ হাফিজ উদ্দিন : প্রভাষক
