একজন নাজিমুদ্দিন ও নির্বাসিত সহমর্মিতা
ড. ইশরাত জাকিয়া সুলতানা
প্রকাশ: ১৮ মে ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
করোনাভাইরাস যতটা না মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছে, এর চেয়ে বেশি করোনা আতঙ্কে তার মনুষ্যত্বকে হারিয়েছে। দৈহিক মৃত্যুর চেয়েও মনুষ্যত্বের এই মৃত্যু নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বেদনাদায়ক। করোনা নিয়ে সতর্কতার এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থায় করণীয় যা যা কিছু, সেটা করার প্রয়োজন অবশ্যই আছে। কিন্তু দুঃখজনক হল এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়া, অন্যকে আতঙ্কিত করা এবং আতঙ্কটা এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যেখানে আমরা শুধু নিজের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতারই যে ক্ষতিসাধন করছি তা নয়, আমাদের মনুষ্যত্বেরও বিনাশ ঘটাচ্ছি। এখন কেউ সামনাসামনি তো বটেই, ফোনেও কথা বলার সময় একটা হাঁচি বা কাশি দিলে ভীতসন্ত্রস্ত ও সন্দেহগ্রস্ত হয়ে পড়ি। বাংলাদেশের মানুষের কি ২০২০ সালের আগে হাঁচি, কাশি, সর্দি, জ্বর, পেট খারাপ হয়নি?
মানুষ হিসেবে জন্ম নিলে মৃত্যু যেখানে শতভাগ অবধারিত; সেখানে সাড়ে তিন ভাগেরও কম মৃত্যুহারের কারণ করোনাভাইরাসকে আজ কিছু মানুষ সহমর্মিতা অপহরণের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে এবং সহমর্মিতা নির্বাসিত হয়েছেও বটে। তা না হলে কেন রোগী কাশি দেয়ায় করোনা সন্দেহে তাকে অ্যাম্বুলেন্স থেকে রাস্তায় নামিয়ে দেয়া হয় এবং রাস্তায় পড়ে থেকে বিনা চিকিৎসায় মানুষ মারা যায়? জানাজায় এলাকা তো দূরের কথা, পরিবারের সদস্যরাও অংশ নিচ্ছেন না। মসজিদ থেকে খাটিয়া দেয়া হল না বলে পরিবারের সদস্যরা কাঁধে বয়ে নিয়ে গেলেন লাশ (অপরদিকে ধর্মীয় নেতার জানাজায় রাষ্ট্রের আইন অমান্য করে বিশাল জনসমাগম হয় এ দেশে), ২১ ঘণ্টা সন্তানের লাশ নিয়ে মা আর্তনাদ করলেন, স্বজন বা গ্রামবাসী কেউ লাশ সৎকারে আসেনি। নিজের জীবন বিপন্ন করে যে চিকিৎসাকর্মীরা সেবা দিচ্ছেন, তাদের দেখা হচ্ছে অচ্ছুতের দৃষ্টিতে, বাড়িওয়ালা বের করে দিচ্ছেন বাড়ি থেকে। ঢাকা থেকে নওগাঁগামী বাসে যাত্রী মারা গেলে করোনা সন্দেহে গভীর রাতে যাত্রীবাহী বাস বৃদ্ধ মাকে লাশসহ নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। ছেলের লাশ নিয়ে মা দীর্ঘক্ষণ বসে থেকেও স্থানীয় ব্যক্তিদের সহযোগিতা পেলেন না। এ তালিকা আরও লম্বা করা সম্ভব।
কিন্তু প্রশ্ন হল, নাজিমুদ্দিন কেমন করে নির্বাসিত সহমর্মিতাকে হৃদয়ে লালন করে যাচ্ছিলেন দিনের পর দিন? ভাইরাল ফটোসেশনের লোভে নয়, পত্রিকায় নামসমেত রঙিন ছবি প্রচারের লোভে নয়, তথাকথিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে কয়েক কোটি লাইক পাওয়ার গোপন বাসনায়ও নয়; নেহাতই মনুষ্যত্ববোধ থেকে একসময়ের কৃষক, পরে কোনো কারণে পা ভেঙে যাওয়ায় ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে জীবননির্বাহ করা ৮০ বছরের এই মানুষটি ভিক্ষা করে দুই বছর ধরে জমানো ১০ হাজার টাকা তুলে দিলেন করোনাকালে সংকটে থাকা মানুষের জন্য!
কিছু পরিসংখ্যান দেখা যাক। ১২ মে ২০২০ পর্যন্ত বিশ্বে ৪০ লাখ ৯৮ হাজার মানুষকে করোনাভাইরাসের কনফার্মড কেস হিসেবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে ২ লাখ ৮৩ হাজার ২৭১ জন মারা গেছেন। বাংলাদেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ১৬ হাজার ৬৬০ জন, এবং মারা গেছেন ২৫০ জন (১৩ মে, ২০২০)।
এ তথ্যগুলো যাদের জানা, তাদের অনেকেরই অজানা যে, গড়ে বিশ্বে প্রতিবছর ১০০ কোটি মানুষ ফ্লুতে (অর্থাৎ ঠাণ্ডা-সর্দি-কাশিতে) আক্রান্ত হয়। ৩০ থেকে ৫০ লাখ মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হয়। ২ লাখ ৯১ হাজার থেকে ৬ লাখ ৪৬ হাজার মানুষ মারা যায়। এটি হচ্ছে প্রতিবছরের শুধু ফ্লুতে মৃত্যুর হিসাব। ফ্লু ছাড়া যদি পৃথিবীতে মৃত্যুর হিসাব সন্ধান করা হয়, তাহলে দেখা যাবে, প্রতিবছর ৫ কোটি ৭২ লাখ ৫৫ হাজার ২৪৪ জন মারা যান। প্রতিদিনের মৃত্যুর সংখ্যা ১ লাখ ৫৬ হাজার ৮৬৪। অর্থাৎ প্রতি ঘণ্টায় মারা যাচ্ছেন ৬ হাজার ৫৩৬ জন। যুক্তরাষ্ট্রে, যেখানে এখন করোনার আক্রমণ সবচেয়ে বেশি, ১৩ লাখ ৬৩ হাজার আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা ৮১ হাজার ৬৬৩ (১৩ মে, ২০২০), সেখানেও প্রতিবছর বিভিন্ন কারণে ২৮ লাখ ৩০ হাজার ৬৮৮ জন মারা যান। অর্থাৎ সেখানে প্রতিদিন মৃত্যুর হার হচ্ছে ৭ হাজার ৭৫৫ জন।
আসা যাক বাংলাদেশের কথায়। দেশে করোনায় ১২ মে পর্যন্ত মারা গেছেন ২৫০ জন। ২০১৬ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতিবছর মৃত্যু হচ্ছে ৮ লাখ ৯০ হাজার ৩৬২ জনের। অর্থাৎ প্রতিদিন বাংলাদেশে মারা যান দুই হাজার ৪৩৯ জন, এবং প্রতি ঘণ্টায় মারা যান ১০২ জন। বাংলাদেশে যেখানে প্রতিবছর ১ লাখ ৮৮ হাজার মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন, ১ লাখ মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন, এবং বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে ২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৭ হাজার ৮৫৫ জন, আহত হয়েছে ১৩ হাজার ৩৩০ জন; সেসব নিয়ে আমাদের আতঙ্ক নেই, নেই সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনো হইচই। কিন্তু করোনা নিয়ে মানুষকে আতঙ্কিত, ভীতসন্ত্রস্ত করা হচ্ছে কেন, সেটা ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে বৈকি। কারণ আতঙ্কিত মানুষ যে আচরণ করছে, তা এদেশের মানুষের উদারতা, মমতা, নৈতিকতার যে ঐতিহ্য, এর সঙ্গে কোনোভাবেই মেলে না।
ভিক্ষুক নাজিমুদ্দিনসহ স্থানীয় প্রশাসন-পুলিশ, সাধারণ মানুষের একাংশ, বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ সেবার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন ঠিকই। কিন্তু চারপাশের দুঃখজনক ঘটনাগুলো তো অস্বীকার করার উপায় নেই। নোয়াম চমস্কি সম্প্রতি বলেছেন, করোনাভাইরাসের একটা ভালো দিক থাকতে পারে। তা হচ্ছে, মানুষ এখন চিন্তা করবে যে আমরা কেমন পৃথিবী চাই। পশ্চিমা ভোগবাদী সমাজ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে স্বার্থপর মমতাবর্জিত পৃথিবী নিশ্চয়ই চাই না। দুর্যোগে আতঙ্কগ্রস্ত আর স্বার্থপর না হয়ে কীভাবে মমতার হাত বাড়িয়ে বাঁচতে ও বাঁচাতে হয়, কিউবা আর কেরালা থেকে নেয়া সে শিক্ষাটাই বরং নতুন পৃথিবীর ভিত্তি হোক।
ড. ইশরাত জাকিয়া সুলতানা : সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, এবং গবেষক, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যলয়
