প্রকৃতি ও জীবন বাঁচাবে তালগাছ
এম আমীরুল হক পারভেজ চৌধুরী
প্রকাশ: ১৮ নভেম্বর ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ঘন সবুজে আবৃত বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত, মাঝখানে কর্দমাক্ত মেঠোপথ, তার দু’পাশে মাথা উঁচু তালগাছ আমাদের উপকূল ও গ্রামীণ জীবনের প্রতিচ্ছবি। এমন সুন্দর ও নৈসর্গিক দৃশ্য এখন খুঁজে পাওয়া দুর্লভ। ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে পরিবেশবান্ধব এবং বজ্রপাত থেকে রক্ষাকারী তালগাছ।
এ কারণে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। বজ্রপাতে ২০১০-২০১৯- এই এক দশকে ২,৫৭১ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। বছরে গড়ে এ সংখ্যা আড়াইশ’র বেশি। চলতি বছর প্রথম ছয় মাসেই সারা দেশে বজ্রাঘাতে প্রাণ হারিয়েছেন ১৯১ জন। দেশে প্রতি বছর বজ্রপাতে মৃত্যুর ৯৩ শতাংশ ঘটে থাকে গ্রামীণ জনপদে। আবার মোট মৃত্যুর প্রায় ৮৬ শতাংশ ঘটে উন্মুক্ত স্থানে অবস্থানের কারণে, যার মূল শিকার হয় কৃষক, জেলে ও শ্রমিক শ্রেণির মানুষ।
সাধারণত একটি তালগাছ ৯০ থেকে ১০০ ফুট পর্যন্ত উঁচু হয়। উঁচু হওয়ায় বজ্রপাতের বিদ্যুৎ সরাসরি এ গাছের মাধ্যমে মাটিতে গিয়ে আমাদের রক্ষা করে। এ ছাড়াও তালগাছ ভূমিক্ষয়, ভূমিধস, ভূগর্ভস্থ পানির মজুদ বৃদ্ধি ও মাটির উর্বরতা রক্ষা করে। তালগাছের আকর্ষণে বাড়ে মেঘের ঘনঘটা, ঘটে বৃষ্টিপাতও। তালগাছের শিকড় মাটির অনেক নিচ পর্যন্ত প্রবেশ করায় ঝড়ে হেলে কিংবা ভেঙে পড়ে না। যেখানে কোনোকিছু চাষ হয় না, সেখানেও তালগাছ তার শক্ত অবস্থানে দাঁড়িয়ে যায়। নতুন রাস্তার ল্যান্ডস্কেপ, বাঁধ ও নদীভাঙন ঠেকাতে এর রয়েছে সফল প্রয়োগ।
পাকা তালের অপূর্ব সুন্দর ঘ্রাণ সবাইকে মোহিত করে। পাকা তালের রস থেকে নানারকম সুস্বাদু পিঠা, মিছরি ও গুড় তৈরি হয়। সদ্য সংগৃহীত তালের রস পানীয় হিসেবে অনেক সুস্বাদু। দেখতে সাধারণ হলেও এতে থাকা নানা রকম খনিজ উপাদান ও পুষ্টি আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। পাকা তালের রস কনফেকশনারিতে শুকনো খাবার প্রস্তুতকরণের উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তালের নৌকা আমাদের জাতীয় জীবনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে।
তালের পাতা দিয়ে তৈরি হয় নানা কারুকার্যের হাতপাখা। একসময় গরমকালে তালপাতার পাখার কদর ছিল। তালগাছের আঁশ দিয়ে কুটির শিল্পজাত দ্রব্য তৈরি, কারখানায় বাহারি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য উৎপাদন ছাড়াও জিও টেক্সটাইল হিসেবে তালের ছোবড়া থেকে তৈরি নেট/জালের রয়েছে বিশ্বব্যাপী ব্যবহার। তাল ও তালগাছের উপকার সম্পর্কে না জানায় তালগাছ ইটভাটায় জ্বালানি, ঘর তৈরির উপকরণসহ নানা কাজে ব্যবহারের জন্য নির্বিচারে কেটে ফেলা হচ্ছে।
কিন্তু নতুন করে গাছ লাগানোর কোনো উদ্যোগ নেই। এ কারণে দিন দিন প্রাকৃতিক পরিবেশ ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে। বর্তমানে তালগাছের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যেতে বসেছে বাবুইপাখি। তালপাতার আড়ালে পরিশ্রমী বাবুই পাখির শক্ত বুননে দৃশ্যমান কারুকার্যময় ঝুলন্ত ছোট্ট বাসা এখন খুব কমই চোখে পড়ে।
তালগাছ প্রকৃতির বন্ধু ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষাকারী বৃক্ষ। যে এলাকায় তালগাছের সংখ্যা বেশি, সে এলাকায় ঝড় ও বজ্রপাতে মানুষ ও পশু-পাখির মৃত্যুহার খুব কম। প্রকৃতির জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বাড়ির আঙিনার পাশে, রাস্তার ধারে, অনাবাদি ও পতিত জমিতে ব্যাপকভাবে তালগাছ রোপণ করা উচিত। আসুন, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, বাড়ির আঙ্গিনায়, রাস্তার ধারে তালবীজ বপন করি। একটু উদ্যোগেই বদলে যাবে আমাদের চিরপরিচিত পরিবেশ ও প্রতিবেশ। সারা দেশে গড়ে উঠুক তালগাছের সবুজ বেষ্টনী।
এম আমীরুল হক পারভেজ চৌধুরী : পিএইচডি গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; চেয়ারম্যান, উপকূল ফাউন্ডেশন
ahcparveydu@gmail.com
