Logo
Logo
×

সম্পাদকীয়

ভাটিয়ালি গানের বরপুত্র

Icon

মাহমুদ ইউসুফ

প্রকাশ: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ভাটিয়ালি গানের বরপুত্র

বাংলা লোকসংগীতের কিংবদন্তি শিল্পী আবদুল আলীম। মরমি গানের একনিষ্ঠ সাধক। বাংলার মাটি ও মানুষের সঙ্গে ছিল তার গভীর সম্পৃক্ততা। জন্মস্থান মুর্শিদাবাদ। শৈশব থেকেই নৌকাবাইচের গান, মাঝির গান ও ভাটিয়ালির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। ১৯৪২ সালে বড় ভাইয়ের সঙ্গে কলকাতায় যান। তখন বয়স মাত্র ১১। এ সময়েই মেগাফোন কোম্পানিতে কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও আব্বাসউদ্দীনের সহায়তায় প্রথম গান রেকর্ড করেন। গানটি ছিল-‘তোর মোস্তফাকে দে না মাগো’। ওই সময়ের প্রেক্ষাপটে এত অল্প বয়সে গান রেকর্ড হওয়া সত্যিই বিস্ময়কর।

বাংলা লোকগীতিকে নাগরিক সমাজে জনপ্রিয় করে তোলেন আব্বাসউদ্দীন ও আবদুল আলীম। উভয়ের প্রচেষ্টায় লোকসংগীতের ভাণ্ডার নতুন আঙ্গিকে সমৃদ্ধ হয়। ১৯৪২ সালে কলকাতায় শেরেবাংলা একে ফজলুল হককে দেওয়া এক সংবর্ধনা সভায় গান গেয়ে প্রথম প্রশংসিত হন আলীম। শেরেবাংলা গান শুনে কেঁদে ফেলেন। দেশ বিভাগের পর ১৯৪৭-এর ডিসেম্বরে ঢাকা আসেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বেতারে অডিশন দেন। ১৯৪৮ সালের ৯ আগস্ট ঢাকা বেতার থেকে তার প্রথম গান শুনতে পায় শ্রোতারা। আব্বাসউদ্দীন তার কণ্ঠজাদুতে মুগ্ধ হয়ে সরকারের পাবলিসিটি বিভাগে চাকরি দেন। চার বছর কাজ করার পর চাকরি থেকে ইস্তফা দেন আবদুল আলীম। তার জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে রয়েছে : যার আপন খবর আপনার হয় না, পরের জায়গা পরের জমি, সব সখীরে পার করিতে নেব আনা আনা, নাইয়া রে নায়ের বাদাম তুইলা, সর্বনাশা পদ্মা নদী, হলুদিয়া পাখি, মেঘনার কূলে ঘর বাঁধিলাম, এই যে দুনিয়া, দোল দোল দুলনি, দুয়ারে আইসাছে পালকি, কেহ করে বেচাকেনা কেহ কান্দে ইত্যাদি। আজও এসব অবিস্মরণীয় গান মানুষের মুখে মুখে ফেরে। নদীর তীরে বেড়াতে গেলে নৌকা, ট্রলার, জাহাজ থেকে আগত ভাটিয়ালির সুর মূর্ছনায় আমরা বিমোহিত না হয়ে পারি না। অন্তরের অন্তস্থলে পৌঁছে যায় সেই সুর।

পল্লি শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি আকর্ষণ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। আবদুল আলীমের গান না শুনলে সেটা উপলব্ধি করা কঠিন। আবদুল আলীম বিটিভি ও বেতার ছাড়াও দেশের বিভিন্ন চলচ্চিত্রে অসংখ্য গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। শিল্পীর রেকর্ডকৃত গানের সংখ্যা প্রায় ৫০০। এ ছাড়া স্টুডিও রেকর্ডেও রয়েছে অসংখ্য গান। ‘মুখ ও মুখোশ’সহ প্রায় ৫০টি সিনেমায় কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি। গ্রামেগঞ্জে তার গান এখনো জনপ্রিয়। গ্রামের তামাম জনগোষ্ঠী তার জন্য মাতোয়ারা।

লোকসংগীতের এই বরপুত্রের জীবনাবসান ঘটে ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ মাত্র ৪৩ বছর বয়সে। তিনি লিভার সিরোসিস রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তার ইচ্ছা ছিল বিদেশ গিয়ে চিকিৎসা করাবেন। কিন্তু আর্থিক অসঙ্গতির কারণে তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। শেষের দিকে যখন তিনি সামান্য কথা বলতে পারতেন, কেউ দেখতে গেলে বলতেন, ‘আর বাঁচব না ভাই, আমি সবসময় মৃত্যুকে দেখছি।’ মৃত্যুর আটদিন আগে নিজেই আংটি ও ঘড়ি খুলে স্ত্রীর হাতে দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছিলেন। মৃত্যুর পর খুলনা বেতার থেকে প্রচারিত কথিকার অংশবিশেষ : ‘মনে বড় আশা ছিল যাব মদীনায়-কিন্তু সে আশা অপূর্ণ রেখেই ‘কাঁচা বাঁশের পাল্কী’ চড়ে অজানার উদ্দেশে যাত্রা করলেন বাংলার আপামর জনগণের মরমি কণ্ঠশিল্পী আবদুল আলীম।’

মাহমুদ ইউসুফ : প্রাবন্ধিক, বরগুনা

 

ভাটিয়ালি গান লোকসংগীত বরপুত্র

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম