Logo
Logo
×

পরবাস

গ্রিসের বিখ্যাত সেই স্বপ্ন দ্বীপ

Icon

জিনাত সুলতানা

প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০১৮, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ইউরোপ ট্যুরের শেষ দিবস ছিল গ্রিস। ইটালির নেপলস্ (নাপোলি) থেকে আড়াই ঘণ্টার প্লেন জার্নির পর এসে পৌঁছালাম গ্রিসের বিখ্যাত Cyclades Island (বৃত্তাকার দ্বীপপুঞ্জ) এর একটি দ্বীপ Santorini-তে। গ্রিসের ২০০ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্ব দিকে এজিয়ান সাগরে এ দ্বীপটির অবস্থান। নগর সভ্যতা থেকে বহু দূরে একেবারে নির্মল সাগরের মধ্যখানে এ আইল্যান্ডটিতে যখন পৌঁছলাম দীর্ঘদিনের ভ্রমণজনিত কারণে অনেকটাই ক্লান্ত আমরা। মধ্যে বাসে, ট্রেনে, প্লেনে ঘুরে ফেলেছি প্রায় অর্ধেক ইউরোপ। আমার ১০ বছর বয়সী মেয়ে রূপকথা, মেয়ের বাবা বুলবুল আর আমি এয়ারপোর্টে নেমে, দেরি না করে রওনা দিলাম আগে থেকে বুক করে রাখা টুরিস্ট লজ মেমেন্টো পেরিসার দিকে।

ট্যাক্সি করে লজে যাওয়ার পথে মাঝে মাঝেই চোখে পড়েছে এজিয়ান সাগর। কোথাও কোথাও পাথুরে কালো পাহাড়। তাছাড়া বাদবাকি পথ রুক্ষ, কালচে এবং ঊষর। কেমন যেন নিষ্প্রাণ। কোথাও কোথাও ২/১টি আঙ্গুর এবং টমেটো ক্ষেত। তাও একেবারে রোদে পুড়ে ঝলসে আছে। বাংলাদেশের সতেজ সবুজে বড় হয়েছি আমি। হঠাৎ মনে হলো বেড়াতে বের হয়ে এ কোন বিরান ভূমিতে এসে উপস্থিত হলাম!

টুরিস্ট লজে পৌঁছে শরীর-মন দুই’ই কিছুটা শান্ত হল। ঢুকতেই ছোট্ট একটা সুইমিংপুল, দেখে রূপকথা তো মহাখুশি। আমাদের রুমটি দোতলায়। বড় আর প্রশস্ত। রুমের সঙ্গে লাগোয়া বেলকনি। আমার জন্য আসল বিস্ময় লুকিয়ে ছিল এ বেলকনিতে। দরজা খুলে বের হতেই মুখে ঝাপটা মারল দুপুরের তপ্ত বাতাস। চোখ মুখ কুচকে তাকাতেই, দেখি অদূরেই সুনীল, সুন্দর অপরূপ এজিয়ান সাগর। ছুট, ছুট, ছুট, আর অপেক্ষা নয়। ছুটতে ছুটতেই পেরিসার উত্তপ্ত ব্লাক বিচ মাড়িয়ে তিন বঙ্গ সন্তান একেবারে এজিয়ানের সুশীতল বুকে।

সংক্ষিপ্ত সময়ে কোনো জায়গা ভালো করে দেখার সবচেয়ে ভালো বুদ্ধি হল পছন্দমতো একটা সিটি ট্যুর নেয়া। সান্তরিনীতে আমরা থাকব তিন দিন। দ্বিতীয় দিনেই আমরা একটা আইল্যান্ড হপিং ট্যুর নিলাম। সকাল ৮.৩০টার দিকে ট্যুর কোম্পানির মাইক্রোবাস আমাদের উঠিয়ে নিল মেমেন্টো পেরিসা থেকে। আবারও দু’পাশের রুক্ষ বিরান ভূমি, উঁচু-নিচু পথ, বিক্ষিপ্ত কিছু সাদা ঘরবাড়ি পাড়ি দিয়ে আমরা চলেছি Athinios পোর্টে। সেখান থেকে প্রাচীন নকশার পালতোলা জাহাজে করে দ্বীপের চারপাশে ঘুরবো সারাদিন। কিছু পাহাড়ি, কিছু সমতল পথ পাড়ি দিয়ে অবশেষে আমরা মালভূমির চূড়া থেকে নামতে শুরু করলাম নিচে। কুচকুচে কালো পাহাড়ের গা বেয়ে ফিতার মতো এঁকেবেঁকে নেমেছে পিচ ঢালা পথ। নানা ট্যুর কোম্পানির বাস, মাইক্রোবাস, ট্যাক্সি এ পথ বেয়েই কেমন যেন পোকার মতো মাটি কামড়ে উঠছে নামছে। সমতলে চলা আমার বাঙালি মন তো এ দৃশ্য দেখে ভয়েই জড়সড়।

আমাদের জাহাজটি চমৎকার। প্রাচীন গ্রিক ঢংয়ের পালতোলা কাঠের ছোটখাটো এক জাহাজ। নামটাও বেশ ভাইকিংস (Vikings)। ভেতরে সুযোগ-সুবিধা সব আধুনিক। ওপেন ডেকে বসে মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখছি চারপাশ। রাজহাঁসের মতো পানি কেটে এজিয়ানের বুক চিরে এগিয়ে যাচ্ছে জাহাজ। যতদূর চোখ যায় আদিগন্ত নীল। সৃষ্টিকর্তা যেন লাখো কোটি দোয়াত নীল কালি ঢেলে সৃষ্টি করেছেন এজিয়ানকে। এ নয়নাভিরাম নীলের বুকে কোথাও কোথাও মাথা তুলে আছে ছোট সব আইলেট-ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণ তারা। আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের লাভা জমে জন্ম তাদের। পাথুরে, প্রাণহীন। আমরা গিয়ে নামলাম এরকমই একটি আইলেট Nea Kameni তে। Nea Kameni আসলে একটা জীবন্ত আগ্নেয়গিরি। এখানে অনেক বছর আগে থেকেই নিয়মিত বিরতিতে অগ্ন্যুৎপাত হয়ে চলেছে। মাত্র ৬৫ বছর আগেই শেষবার অগ্ন্যুৎপাত হয়েছে। অন্যান্য টুরিস্টের সঙ্গে পায়ে চলা পাথুরে পথ বেয়ে আমরাও রওনা হয়েছি Nea Kameni কে এক্সপ্লোর করার উত্তেজনা বুকে নিয়ে। কিন্তু রৌদ্র তপ্ত ঊষ্ণ দিনে এমন পাথুরে পথ বেয়ে উঠতে গিয়ে অল্পক্ষণেই আমার একেবারে কাহিল অবস্থা। পা আর চলতে চায় না, গলা শুকিয়ে কাঠ। না পেরে বসে পড়লাম পথের পাশে। বুলবুল আর রূপকথাকে জোর করে পাঠিয়ে দিলাম অন্যদের সঙ্গে। আমার জন্য ওরা এমন চমৎকার সুযোগ কেন মিস করবে? ছোট হতে হতে কিছুক্ষণেই ওরা মিশে গেল পাহাড়ের ঢালের আড়ালে। তবে আমি একটু স্বস্তির হতেই ফিরে পেলাম মনের জোর। আচ্ছা, এ জায়গাটিতে আর কখনও কি আসব আমি? যদি আসিও বয়স হয়তো বেড়ে যাবে আরও ১০-২০ বছর। এখনই যদি শক্তি না পাই, তখন পাব কী করে? এত কাছে এসেও তবে মিস করে ফেলব জীবন্ত এ আগ্নেয়গিরিটি ঘুরে দেখার সুবর্ণ সুযোগ। নাহ, গা ঝাড়া দিয়ে অদেখাকে দেখার নেশায় আবার রওনা হলাম একা। বিজন পাথুরে পথে চড়াই-উৎরাই বেয়ে চারদিক দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছি। পুরো আইলেটটিই পাথুরে, পোড়া কয়লার মতো কালো, ভীষণ দুর্গম, কোথাও প্রাণের কোনো সাড়া চোখে পড়ে না। জায়গায় জায়গায় পড়ে আছে বিরাট পাথর, জমে শক্ত হয়ে আছে লাভা আর ছাইয়ের স্তূপ। প্রাগৈতিহাসিক আদিম পৃথিবী বুঝি এমনই ছিল। চলতে চলতে এসে দাঁড়িয়েছি গভীর ফানেল সদৃশ, পুকুরের মতো একটি জায়গায়। কি অপার বিস্ময়, Nea Kameni-এ একটি জ্বালামুখ এটি। এখান দিয়েই তবে বেরিয়ে এসেছিল লাখ লাখ টন ছাই, লাভা, আগুন, পাথর! হায় হায় কি ভয়ঙ্কর! এখনি যদি আবার শুরু হয় অগ্ন্যুৎপাত। দুর, ছাই পাশ ভাবনা ফেলে পা চালিয়ে রওনা হলাম আবার। পথে পেলাম এমনই ছোট-বড় আরও ৪টি জ্বালামুখ। তারপর ধুঁকতে ধুঁকতে গিয়ে পৌঁছালাম Nea Kameni-র সব চেয়ে উঁচু জায়গাটিতে। আবারও বিস্ময়ের সঙ্গে সীমাহীন মুগ্ধতা। ছোট্ট এ আইলেটটির চারপাশে সুনীল সাগর। নীল ঢেউয়েরা সজোরে পাথরে আছড়ে পড়ে রাশি রাশি ফেনা হয়ে আবারও ফিরে যাচ্ছে সাগরের বুকে। কাচ সদৃশ স্বচ্ছ পানিতে মাছ আর সূর্যের আলোর অপূর্ব লুকোচুরি খেলা। আর ওই দূর দিগন্ত রেখায় দেখা যায় Oia- সূর্যাস্ত দেখার জন্য আদর্শ, ভ্রমণপিপাসুদের জন্য সান্তরিনীর সবচেয়ে জনপ্রিয় শহর।

দিন শেষে আমাদের গন্তব্যও ছিল Oia। পথে পড়েছে Palea Kameni, Nea Kameni-র জলন্ত তলদেশ থেকে উৎসারিত একটা ঊষ্ণ প্রসবণ (Hot Water Spring), যেটা বের হয়ে মিলেছে এজিয়ান সাগরে। আর সেখানে অনেকটা এলাকার পানি বেশ গরম হয়ে আছে। সবাই ধুপধাপ নেমে সেই গরম পানিতে সুইমিং করছে। বুলবুল আর রূপকথা এ রকম সুযোগ নষ্ট করবে ভাবাই যায় না। Thirassia নামের আর একটি ছোট্ট দ্বীপে হল আমাদের যাত্রা বিরতি-লাঞ্চ ব্রেক, ঘোরাঘুরি এবং সুইমিং। সাগরের সতেজ হাওয়া আর বিস্তর ওঠা-নামাতে খিদেও লেগেছিল বেশ। ঝটপট খেয়ে নিলাম আমরা। তারপর গিয়ে বসলাম ছোট্ট একটি বিচে। রূপকথা খলখল হাসিতে পাথুরে কালো বিচ মাড়িয়ে আবারও ঝাঁপিয়ে পড়ল এজিয়ানের নীল পানিতে। তার পেছনে বুলবুলও। ঝকঝকে স্বচ্ছ পানিতে স্পষ্ট দেখা যায় রঙ্গিন নুড়ি পাথরগুলো। কোথাও কোথাও শৈবাল আর জলজ উদ্ভিদের ঝাড়, নানা বর্ণের মাছেরা অকুতোভয় সাঁতরে বেড়াচ্ছে পানির নিচ দিয়ে। সুইমিং গগলস পরাতে ওরা আরও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল সাগরের নিচের রঙ্গিন জগৎ। তাই আমাকেও টেনে নামাল পানিতে। সুইমিং গগলস চোখে রঙিন মাছ আর অজস্র রংবেরঙের শৈবাল দেখে মুগ্ধতায় ভরে গেল মন। না নামলে কি মিসটাই না করতাম আমি।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম