Logo
Logo
×

ঘরে বাইরে

কারুশিল্প ও লোকজ উৎসব

Icon

হাসান মাহমুদ রিপন

প্রকাশ: ০৮ মার্চ ২০২১, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

গ্রাম বাংলার হারিয়ে যাওয়া উৎসব যেন সোনারগাঁয়ে। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে অবস্থিত বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের বিশাল চত্বরে উৎসব আমেজে আর লালনের একতারার সুরে বেজে উঠছে এ উৎসব। এখানে বসেছে মাসব্যাপী লোককারুশিল্প মেলা। গ্রামকে কে না ভালোবাসে। নয়নালোভা গ্রামগুলো আমাদের দেশের প্রকৃতির লীলানিকেতন। গ্রামে কত সৌন্দর্য, কত প্রেম, কত প্রীতি লুকিয়ে আছে তা না দেখলে বোঝা বড় কঠিন। গ্রামে এত প্রাণের চঞ্চলতা আছে, আছে হারিয়ে যাওয়া অনেক কিছু, অনেক স্মৃতি। সেই গ্রামের হারিয়ে যাওয়া সব এখন পাবেন সোনারগাঁয়ে এলে।

গ্রাম বাংলার ব্যবহৃত বাঁশের সব কারুপণ্য আপনাকে যেন স্বাগত জানাচ্ছে। প্রকৃতির ছায়াঘেরা নয়নাভিরাম স্থানটিতে বৃক্ষরাজির সমাহার, সাঁকো, লেক, পুকুর, নৌকা, এখানে সেখানে গ্রাম বাংলার নানা নিদর্শন সবই আছে ফাউন্ডেশন চত্বরে।

প্রকৃতির সৌন্দর্যের অবারিত আকর্ষণ অনবদ্য স্থাপত্যশৈলী ও অতীত ঐতিহ্যের স্মৃতিতে সমুজ্জ্বল প্রাচীন রাজধানী শহর সোনারগাঁ যেন এক অন্য রকম সুবাসিত অনুভূতির পরশমাখা আনন্দময় পরিবেশে নতুন করে জেগে উঠেছে। মেলায় আগত পর্যটকদের প্রবহমান পরম্পরাগত ঐতিহ্য ও লোক সাংস্কৃতিক উপাদানের সঙ্গে পরিচিত করার প্রয়াসে এবং ঐতিহ্যবাহী লোকসংগীত বাঙালি সাংস্কৃতিক লালন, কারুশিল্পীদের সৃষ্টিশীল কর্মের প্রদর্শন, বিলুপ্ত প্রায় গ্রামীণ খেলাধুলার প্রচার প্রসারের পাশাপাশি দেশীয় সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবনে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন লোক কারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসবের আয়োজন করে আসছে।

ইতিহাসের নানা ক্রান্তিকালে এ দেশের অনেক ঐতিহ্য হারিয়ে গেছে। সময়ের চাকা বেয়ে অনেক ঐতিহ্য আজ বিলুপ্ত। সেই হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য পুনরায় আনয়ন করে সোনার বাংলাকে ভরিয়ে তুলতে সোনারগাঁয়ের প্রাণকেন্দ্র নৈসর্গিক পরিবেশে লোক কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের এ মাসব্যাপী মেলা বসেছে। এ মেলার বৈশিষ্ট্য গ্রাম বাংলার লোকজ তৈজসপত্র পণ্যসামগ্রী, প্রাকৃতজনের আচার-আচরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশ এবং পিতামহ ও মাতামহদের যুগের খাদ্যসামগ্রী তথা বাতাসা, খই, কদমা, উখড়া, জিলাপি ইত্যাদি আধুনিক যুগের কাছে উপস্থাপন করা। দেশের কৃষিজীবী সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতি থেকে উৎসরিত লোক ও কারুশিল্পের ঐতিহ্যকে তুলে ধরার লক্ষ্যে এ বছর গত ১ মার্চ থেকে শুরু হয়েছে মাসব্যাপী এ মেলা। এবারে করোনা মহামারির জন্য মেলা পেছানো হয়েছে। প্রতিবছরই জানুয়ারিতে এ মেলা হয়। তবে এবারের মেলায় একটু ভিন্নতায় এনেছে মেলার আয়োজক লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন। এবারের মেলায় শুধুই লোকজ ঐতিহ্যের পণ্য নিয়ে সাজানো হয়েছে। লোকজ কারুপণ্য ছাড়া অন্য কোনো কিছুই প্রদর্শন ও বিক্রি হবে না।

এদিকে করোনার জন্য এবারে মেলায় কারুশিল্পীও কম এসেছে। স্টল বসেছে কম। তারপরও এ মেলা যেন পুরো বাংলাদেশকে ফুটিয়ে তুলেছে। সোনারগাঁয়ে এ লোকজ উৎসবে গ্রামীণ ঐতিহ্যের কি না আছে? নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর তাঁতশিল্প থেকে শুরু করে সোনারগাঁয়ের হাতি, ঘোড়া, জামদানি, রাজশাহীর শখের হাঁড়ি, বাঁশবেত, সোনারগাঁওয়ের দারুশিল্প, নকশি কাঁথা, টেপা পুতুল, সিলেট ও মুন্সীগঞ্জের শীতলপাটি, কিশোরগঞ্জের মৃৎশিল্প, মাগুরা ও ঝিনাইদহের লুপ্তপ্রায় শোলা শিল্প সবই আছে এ মেলায়।

মেলার চিরায়ত আকর্ষণ বাংলার মাঠে ঘাটে প্রান্তরে নদী বনান্তরে ঘুরে বেড়ানো লোকজ শিল্পীদের জারি, সারি, বাউল, পালাগান, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, কবি গান, হাছনরাজার গান, লালন সংগীত, বিয়ের গান, আলকাপ গান, বিচ্ছেদ গান, শরিয়তি, মারফতি, গম্ভীরা, লোকজ গীতিনাট্য, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মেলায় আগত দর্শকদের একদম মাতোয়ারা করে তোলে।

মেলার বিশেষ আকর্ষণ হলো আয়োজক প্রতিষ্ঠানের বিশেষ প্রদর্শনী দেশের প্রথিতযশা কারুশিল্পীদের শিল্পকর্ম নিয়ে ‘কর্মময় কারুশিল্পী’ প্রদর্শনী। এটি মেলার মূল চত্বরের মাঠের মাঝে অবস্থান। এ বিশেষ প্রদর্শনীতে ২৪টি স্টলে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ৪৮ কারুশিল্পী দেশের হারানো ঐতিহ্যকে আবার নতুন করে আবিষ্কার করছে। প্রদর্শনীর গ্যালারিগুলো কারুশিল্পীরা তাদের স্বহস্তে তৈরি করছে নওগাঁ, ঝিনাইদহ ও মাগুরার শোলাশিল্প, রাজশাহীর শখের হাঁড়ি ও মুখোশ, ঢাকার শাঁখা ও মৃৎশিল্প, চট্টগ্রামের তালপাতার নকশি হাতপাখা, রংপুরের শতরঞ্জি, ঠাকুরগাঁয়ে বাঁশের কারুশিল্প, সোনারগাঁয়ের হাতি ঘোড়া পুতুল ও কাঠের কারুশিল্প, বাঁশবেত শিল্প, নকশিকাঁথা, নকশি হাতপাখা, সিলেট ও মুন্সীগঞ্জের শীতল পাটি, কুমিল্লার খাদি, তামা-কাঁসা পিতলের কারুশিল্প, রাঙামাটি, বান্দরবান ও মৌলিভীবাজারের ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠীর কারু পণ্য, কিশোরগঞ্জের টেরাকোটা শিল্পসহ ইত্যাদি কারুপণ্য। এখানে শিল্পীরা বসেই তাদের নিপুণ হাতে নিজস্ব মেধা ও মননে তৈরি করছে বাহারি কারুপণ্য এবং তা প্রদর্শন ও বিক্রি করছে। প্রদর্শনীর গ্যালারিগুলোতে থরে থরে সাজানো কারুপণ্যের পসরা দেখে কেউ কেউ লোভ সামলাতে না পেরে কেনাকাটা করছেন শখের চিত্রিত হাঁড়ি, শোলাশিল্প, কাঠের সামগ্রী, শতরঞ্জি, নকশি কাঁথাসহ বিভিন্ন কারুপণ্য সামগ্রী। এখানে শিল্পীরা বসেই তাদের নিপুণ হাতে নিজস্ব মেধা ও মননে তৈরি করছে বাহারি কারুপণ্য এবং তা প্রদর্শন ও বিক্রি করছে।

মেলায় আবহমান বাংলার গ্রাম্য সালিশ, কনে দেখা, গায়ে হলুদ, বরযাত্রা, জামাইকে পিঠা খাওয়ানো ইত্যাদি লোকজীবন প্রদর্শনী কারুশিল্প মেলার একপাশে চলছে। আবহমান বাংলার লৌকিক আচার এবং ঐতিহ্যগত সংস্কৃতিই ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে এ প্রদর্শনীতে। দেশ-বিদেশের দর্শনার্থী ভিড় করেছেন এ মেলায়। তবে এ বছর করোনার জন্য লোক সমাগম একটু কম। ছুটির দিনগুলোতে একটু ভিড় লক্ষ করা যায়। দর্শনার্থীরা কিনে নিচ্ছেন তাদের পছন্দের হস্তশিল্পসহ নানা জিনিস আর সময় বুঝেই বসে পড়ছেন মঞ্চের সামনে। উপভোগ করছেন বাউল, লালন, জারি, সারি, বাউল, কবি আর পালাগানসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। লোক কারুশিল্পের প্রসারের জন্য প্রতি বছরের মতো আকর্ষণীয় বিভিন্ন খেলা, গান, প্রদর্শনী অনুষ্ঠান ছাড়া এবারের উৎসবে গ্রাম বাংলার আর্থসামাজিক জীবনের প্রতিচ্ছবি উপস্থাপন করা হয়েছে বৈচিত্র্যময়ভাবে।

এ ছাড়া সোনারতরী লোকজ মঞ্চে প্রতিটি বিকালে বাউল, চর্যাগান, লোকগল্পবলা, লালন, হাছনরাজাসহ নানা গান হচ্ছে। মেলা ও উৎসবে বিলুপ্তির অন্ধকার থেকে উদ্ধার করে বাঙালির শৈশবের সম্পদ গ্রামীণ খেলাধুলা যেমন- কানামাছি, বৌচি, এক্কা-দোক্কা, লাঠিখেলা, সাপের খেলা, গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্দা, হাডু-ডু, ওপেনটি বাইস্কোপ, মোরগ লড়াই, আঁকুনি টুকুনি, ইছোন বিছোন প্রভৃতি খেলাও পরিবেশিত হচ্ছে।

এবারের মেলায় মোট স্টল রয়েছে ১০০টি। মুড়ি মুড়কি, মন্ড মিঠাই থেকে শুরু করে গ্রামীণ হস্তশিল্প, বাঁশ বেত, কাঠ, লোহা, পাটজাত দ্রব্যসামগ্রী বিলুপ্ত প্রায় কুটিরশিল্পের পসরা বসেছে মেলায়। মেলা চলবে আগামী ৩০ মার্চ পর্যন্ত।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম