|
ফলো করুন |
|
|---|---|
জীবনযাপন ছিল সাধারণ; কিন্তু আপাদমস্তক ফ্যাশনসচেতন ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পায়ের জুতা থেকে শুরু করে গায়ের সাদা পাঞ্জাবি ও কালো কোটেও ছিল রুচির ছোঁয়া। বঙ্গবন্ধুর মুজিব কোট ও যাপিতজীবন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তারই খোঁজ পেয়েছেন ডিজাইনার বদরুন নাহার রক্সি। তার সঙ্গে কথা বলে লিখেছেন-
সময়টা ছিল ২০১৩ সাল। ২০১৬ সালে বঙ্গবন্ধুর পোশাক ও অনুষঙ্গের রেপ্লিকা তৈরি করে তা নিয়ে ‘স্বর্ণালি যুগ’ নামে প্রদর্শনী করার প্রস্তুতি শুরু করেন। ২০১৭ সালে অনুমতির জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্টে আবেদন করলেন। কিন্তু এত বিশাল মাপের একজন মানুষকে নিয়ে কাজ করা তো সহজ নয়; তাই প্রচুর পড়াশোনা ও রিসার্চ ওয়ার্ক শুরু করলেন। ২০১৭ সালে অনুমতির জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্টে আবেদন করেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রেজেন্টেশন পেপার দেখে অনুমতি দিলেন। গবেষণা ও প্রদর্শনী করার অনুমতির চিঠি পান ২০১৮ সালে। ২০১৮ সালে এসে পুরোদমে কাজ শুরু হলো। বঙ্গবন্ধুর পোশাক ও অন্যান্য অনুষঙ্গের ছবি ও মাপ নিলেন। শুরু হলো লাইব্রেরি ওয়ার্ক । ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে নিয়মিত যাওয়া, যারা বঙ্গবন্ধুর পোশাক তৈরি করতেন তাদের খুঁজে বের করা, পরিবারকে খুঁজে তথ্য সংগ্রহ করা, যেসব অনুষঙ্গ যেখান থেকে কিনতেন সেসব দোকানের খোঁজ ও তথ্য জোগাড়। যেহেতু এ বিষয় নিয়ে এর আগে কেউ কাজ করেনি, সুতরাং সামনে কোনো রেফারেন্স ছিল না। তাই সে সময়ের পত্রপত্রিকার ছবি এবং বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচরদের বক্তব্যের ওপর নির্ভর করেই কাজ করতে হয়েছে বদরুন নাহার রক্সিকে।
সাদা পাঞ্জাবি ও পায়জামার সঙ্গে ছয় বোতামের কালো মুজিব কোট, মোটা কালো ফ্রেমের চশমা, ব্যাকব্রাশ করা চুল- এ ছিল তার পরিপাটি সাজপোশাক; এটিই হয়ে উঠেছিল প্রতিটি বাঙালির মানসপটে ভেসে ওঠা এক অনন্য বঙ্গবন্ধু।
রক্সি বলেন, বঙ্গবন্ধুর পোশাক ও অনুষঙ্গ নিয়ে কাজ করতে পারা আমার জীবনের বিশাল অর্জন। নিজেকে ভাগ্যবানও মনে করছি। তবে আমি কাজটা হুট করেই শুরু করিনি। আমার বাবা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক। তার চিন্তা-চেতনায়জুড়ে ছিল বঙ্গবন্ধু। ছোটবেলা থেকেই দেখেছি, আমাদের বাড়ির বিভিন্ন দেওয়ালে বঙ্গবন্ধুর ছবি টানানো। বুক শেলফে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ নিয়ে লেখা নানা ধরনের বই। যখন স্কুলে পড়তাম, তখন বাবা প্রতিদিন আমাদের রাতের পড়া শেষ হলে নিয়ে বসতেন আর গল্প করতেন বঙ্গবন্ধুর জীবন কাহিনি, তার রাজনৈতিক জীবন ও স্বাধীনতা নিয়ে। দেশের মানুষের জন্য তার আত্মত্যাগের কথা মনোযোগ নিয়ে শুনতাম। ছোটবেলা থেকেই আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। ফ্যাশন ডিজাইনে পড়ার জন্য যখন বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজিতে (বিইউএফটি) ভর্তি হলাম, তখন থেকেই ভাবতাম, বঙ্গবন্ধুর ওপর কাজ করব; কিন্তু এত বিশাল মাপের একজন মানুষকে নিয়ে কাজ করা তো সহজ নয়; তাই প্রচুর পড়াশোনা ও রিসার্চ ওয়ার্ক শুরু করলাম।
বদরুন নাহার রক্সি বলেন, আস্তে আস্তে কাজে এগিয়ে চললাম। বঙ্গবন্ধুর পোশাকের তালিকায় আছে সাদা পায়জামা, পাঞ্জাবি, মুজিব কোট, শর্টহাতা শার্ট, ফুলহাতা শার্ট, প্যান্ট, নাইট গাউন, শাল, লুঙ্গি ও গেঞ্জি। অনুষঙ্গ হিসাবে আছে জুতা, স্যান্ডেল, টাই, চশমা ও পাইপ। এসব কিছুরই রেপ্লিকা তৈরি করেছি, যা আমার প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হবে। আমার উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে একটি হলো- বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে ১০০ রকমের মুজিব কোট তৈরি করেছি। এ মুজিব কোট তৈরিতে দেশীয় কাপড় ব্যবহার করেছি, এর মধ্যে পাট, খাদি, জামদানি, মসলিন, বিভিন্ন অঞ্চলের তাঁত অর্থাৎ দেশীয় যত রকমের কাপড় আছে, সব নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করেছি।
রক্সি বলেন, বঙ্গবন্ধু প্রথম দিকে খাদি কাপড়ের তৈরি মুজিব কোট পরেছেন, আর সেলাই করে দিয়েছিল ১৬, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ-এর নিউ লাহোর টেইলার্স। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এ টেইলার্সটি বন্ধ হয়ে যায়। যিনি সেলাই করতেন তিনিও বেঁচে নেই। এ টেইলার্সেই বঙ্গবন্ধু অধিকাংশ কাপড় সেলাই করতেন। বঙ্গবন্ধুর মুজিব কোটের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল। কোটে ছয়টি বোতাম ব্যবহার হতো। এ ছয়টি বোতাম ব্যবহার করার কারণ হলো, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সনদ ’৬৬ সালের ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলনের প্রতীক। ভাবতে অবাক লাগে একজন নেতা কতটা দেশপ্রেমিক হলে পোশাকের মধ্যেও দেশপ্রেম ধারণ করেন। বঙ্গবন্ধুর মুজিব কোটের আর একটা বিশেষত্ব হলো, কলারের ভেতরে আলাদা কাপড়ের ডাবল কলার ছিল। যেটি বোতাম দিয়ে আটকানো থাকত। এ আলাদা কাপড় ব্যবহারের কারণ হিসাবে আমার মনে হয়, পোশাক ব্যবহারের পর পোশাকের কলারটাই বেশি ময়লা হয়, যাতে বেশি নোংরা না হয় সে জন্য বোধ হয়। মুজিব কোটের বোতাম নিয়েও আমি অনেক পর্যালোচনা করেছি। বোতামে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি, দেশের মানচিত্র, বর্ণমালা ব্যবহার করেছি।
তিনি যখন পাঞ্জাবি পরতেন, তা সাদাই ছিল। পাঞ্জাবি-পায়জামা একটু ঢিলেঢালা থাকত। পাঞ্জাবির হাতা একটু বড়, এর কারণ হলো- তিনি প্রায় সময়ই হাতাটা গুটিয়ে রাখতেন, কাপড় ছিল সুতি, আর মুজিব কোট কালো পরতেন।
এভাবে সাদা-কালোর কম্বিনেশন ছিল বঙ্গবন্ধুর পোশাকে। সেই সময়টায় এত এয়ারকন্ডিশনার ছিল না। সাদা কাপড়ে গরম কম অনুভূত হয়- এটিও বোধহয় একটা কারণ। এ ছাড়া সাদাকে যেমন পবিত্রতার প্রতীক মনে করা হয়, তেমনি কালো মুজিব কোট ছিল প্রতিবাদের প্রতীক।
রক্সি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পর যখন ইংল্যান্ডে যান সেখানের সেভিল রয়-এর একটি টেইলার্স থেকেও মুজিব কোট তৈরি করেছিলেন, প্রতিষ্ঠানটি আজও আছে, আমি তাদের কাছ থেকে দুটি মুজিব কোট তৈরি করেছি। কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, এত বড় মাপের একজন মানুষ ছিলেন অথচ তার পোশাক-পরিচ্ছদ ছিল খুবই সাধারণ। পোশাকে কোনো বাহুল্য ছিল না। সাদামাটা জীবনযাপনের মতো তার পোশাক-পরিচ্ছদও ছিল সাদামাটা।
একচল্লিশ সাইজের জুতা পরতেন। খুব বেশি জুতা ছিল না তার। জুতাগুলো সে সময়ের দেশীয় কোম্পানির। এক জোড়া ‘সু’ ছিল সুইজারল্যান্ডের বেলি সুজ কোম্পানির। বাংলাদেশের এপেক্স ফুটওয়্যার থেকে বঙ্গবন্ধুর সব জুতা ও স্যান্ডেলের রেপ্লিকা তৈরি করেছি।
রক্সি বলেন, অবসরে বঙ্গবন্ধু যখন বাড়িতে থাকতেন, তখন তিনি আট-দশজন আটপৌরে বাঙালির মতো সাদা চেকের লুঙ্গি ও ছোট হাতার হোসিয়ারি গেঞ্জি পরতেন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি যখন বিদেশে যেতেন, তখন তাকে স্যুট, প্রিন্স কোট, সাফারি স্যুট পরতে দেখা গেছে। দেশে থাকলে তাকে পাঞ্জাবি-পায়জামা আর মুজিব কোটই বেশি পরতে দেখা গেছে। শীতের সময় মুজিব কোটের ওপরে শাল জড়াতেন। বাড়িতে হাফহাতার শার্ট পরতেও দেখা গেছে। তরুণ বয়সে মুজিব কোট পরার আগে বঙ্গবন্ধুকে সাদা ও কালো রঙের শেরওয়ানিও পরতে দেখা গেছে।
রক্সি জানান, বঙ্গবন্ধুর নাইট গাউনও ছিল সাদা, কালো, মেরুন এবং ডট প্রিন্টের। স্যুট বঙ্গবন্ধুকে কমই পরতে দেখা গেছে। বিদেশে গেলে স্যুট পরতেন। অনেক সুন্দর সুন্দর টাই ছিল, যা অনেক কালারফুল। সাদামাটা পোশাকের মধ্যেও কোথায় যেন একটা অসাধারণত্ব ছিল তার। নিজের সাধারণ পোশাক দিয়েও তিনি যেন বাঙালির স্টাইল আইকন। সাধারণ জনতা ভালোবেসে তার বিশেষ সেই কালো পোশাকটির নাম দিয়েছেন মুজিব কোট।
অনুষঙ্গ বলতে বঙ্গবন্ধু কালো মোটা ফ্রেমের চশমা ব্যবহার করতেন। চশমাগুলো তৈরি করতেন অপটিকসম্যান ও সুরুচি বিতান নামক স্টেডিয়াম মার্কেটের দুটি দোকান থেকে। এ ছাড়া পাইপের অনেক সংগ্রহ ছিল। দেশি-বিদেশি বেশ কয়েকটা পাইপ ছিল তার। বিদেশে গেলে অনেক পাইপ উপহার পেতেন। পাইপের অনেক রেপ্লিকাও তৈরি করেছি। রুচিতেও অনন্য ছিলেন তিনি। বদরুন নাহার রক্সি তার ইচ্ছার কথা প্রকাশ করে বলেন, বঙ্গবন্ধুর জীবনযাপন ও পোশাক-পরিচ্ছেদ কত অসাধারণ ছিল, পোশাকেও তিনি কীভাবে দেশপ্রেম লালন করতেন, তা নতুন প্রজন্মকে জানানো। যাতে তারা জাতির পিতা সম্পর্কে আরও বেশি জানতে পারে, তার আদর্শকে হৃদয়ে ধারণ ও লালন করতে পারে। এসব বিষয় নিয়ে বই লেখার কাজও শেষ পর্যায়ে; তৈরি করেছি, থিম সং ও ডকুমেন্টারি।
জাতির পিতার শত ব্যস্ততার মাঝেও এত সুন্দর ও পরিপাটি জীবনে সবচেয়ে বেশি যার অবদান, তিনি হচ্ছেন জাতির পিতার সহধর্মিণী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব। তাই প্রদর্শনীটি বঙ্গমাতাকে উৎসর্গ করব এবং একটি বঙ্গমাতা কর্নার রাখব। প্রদর্শনীর সঙ্গে সঙ্গে সেমিনার করব। বঙ্গবন্ধুর পোশাক ও মুজিব কোট নিয়ে ফ্যাশন শো করব। এ ছাড়া তরুণ ডিজাইনারদের জন্য একটা প্রতিযোগিতার আয়োজন থাকবে। থাকবেন বুনন কারিগর ও সেলাই কারিগররা।
