যাহা ভেন্না তাহাই ক্যাস্টার অয়েল
সুপ্তি জামান
প্রকাশ: ১৪ জুন ২০২১, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
রবীন্দ্রনাথের ‘আমার ছেলেবেলা’ পাঠ্য হিসাবে পাই নবম-দশমের পাঠ্যপুস্তকে। আমার ছেলেবেলার শুরুতেই আছে- ‘তখন শহরে না ছিল গ্যাস, না ছিল বিজলি বাতি; কেরোসিনের আলো পরে যখন এলো তার তেজ দেখে আমরা অবাক। সন্ধ্যাবেলায় ঘরে ঘরে ফরাস এসে জ্বালিয়ে যেত রেড়ির তেলের আলো। আমাদের পড়ার ঘরে জ্বলত দুই সলতের একটা সেজ’। আমাদের মাধ্যমিক স্কুলে সিক্স থেকে টেন পর্যন্ত বাংলা পড়াতেন আনোয়ার স্যার। দরাজ কণ্ঠে স্যার জোরে জোরে পরিষ্কার উচ্চারণে সম্পূর্ণ গল্প বা কবিতাটি পড়তেন ক্লাসে। তার কণ্ঠের আপ-ডাউনে ক্লাসময় এমন এক ব্যঞ্জনা ছড়িয়ে পড়ত যে আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়তাম। তারপর স্যারকে আলাদা করে আমাদের বেশি কিছু বুঝিয়ে বলতে হতো না। মূল ভাবটা বুঝে যেতাম আপছে। ফলে গল্প-কবিতাগুলো আমাকে আরও বেশি কাছে ডেকে নিত। রবীন্দ্রনাথের আমার ছেলেবেলাও হয়ে উঠল প্রিয় পাঠ্য। রেড়ি নিয়ে লিখব ভাবতেই মনে পড়ে গেল ‘আমার ছেলেবেলা’ পড়ার সময় প্রথম নাম শুনি রেড়ির তেল নামক বস্তুর সঙ্গে। আমরা শৈশবে রয়নার বীজ দিয়ে ছোট ছোট মাটির গর্তে বীজ ফেলে একটা খেলা খেলতাম গভীর মনোযোগ দিয়ে। আমি মনে মনে ধরে নিলাম রেড়ির তেল হলো রয়না থেকে জাত এক প্রকার তেল। রেড়ির তেলের কোনোরকমের ব্যবহার তখন দেখিনি। রেড়ির তেলের সেজ যেন সাহিত্যেই থাকতে পারে, বাস্তবে না। অথচ আমাদের ঘরেই তখন ভ্যারেন্ডার বীজ সরিষার সঙ্গে মিশিয়ে ভাঙাতে দেখেছি অহরহ। ভেন্নাকেই আমাদের সফিপুরে বলা হতো ভ্যারেন্ডা, বরিশাল জুড়েই হয়তো ভ্যারেন্ডা বলে। পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের ‘আসমানী’ কবিতায় আসমানীদের দুঃখের সঙ্গে মিলেমিশে আছে যে ভেন্না পাতার ছাউনি দেওয়া ঘর। ভেন্নার পাতা সহজেই দৃষ্টি কাড়বে যে কোনো মানুষের। অনেকটাই পেঁপে পাতার মতো দেখতে তবে আরও কারুকার্যময়। হঠাৎ বৃষ্টি থেকে বাঁচতে ভেন্নার কয়েকটা পাতা মাথার ওপর ধরেই তো ভোঁ-দৌড় দিয়ে উঠে যেতাম ঘরের দাওয়ায়। ভেন্না গাছ যত্রতত্র বেড়ে উঠতে দেখেছি। এখন সেরকম হয়তো দেখা যায় না। বাড়ির আনাচে-কানাচে, পথের ধারে, বনে-বাদাড়ে যেমন আপন খেয়ালে জন্মাত ভেন্না গাছ, আবার গৃহস্থর বাড়ির আশপাশে ভিটা-ঘাটায় বুনে দিত ভেন্না। এত বেশি দেখেছি বলেই কিনা ভেন্না গাছের সঙ্গে ছিল অনেক চেনাজানা। আমাদের এলাকায় শ্বেত ভেন্না এবং রক্ত ভেন্না এ দু’ধরনের ভেন্না গাছই চোখে পড়ত। তবে আমার চোখে চোখে এখনো ভাসে ঈষৎ লাল রঙের রক্ত ভেন্না গাছের মিষ্টি লাল কচি পাতার লাজুক হাসি। আমার চোখ আটকে যেত, কি অনির্বচনীয় মাধুরী আমি দেখতাম রক্ত এরেন্ডার সদ্য জন্ম নেয়া কচি কচি ছোট পত্র পল্লবে। ভেন্না বা ভ্যারেন্ডাই হিন্দি ভাষায় এরেন্ড বা আরান্ড। ভেন্নার তেল হলো এরেন্ড কা তেল! কিন্তু আমি যখন অনেক বড় হলাম অর্থাৎ বলতে গেলে এই তো সেদিন জানলাম ভেন্নাই রেড়ি এবং রেড়ির তেলই ইংরেজিতে ক্যাস্টার অয়েল! শহরের বিপণিবিতানে থরে থরে সাজানো থাকে রূপবর্ধনের নানা উপকরণ। তারই মধ্যে অন্যতম ক্যাস্টার অয়েল। নামিদামি ব্র্যান্ডের ক্যাস্টার অয়েলের নানাবিধ ব্যবহার রয়েছে। তবে চুল এবং ত্বকের স্বাস্থ্য রক্ষায় ক্যাস্টার অয়েল নাকি অব্যর্থ। আমার গাঁয়ের ভ্যারেন্ডার তেলই যে ক্যাস্টার অয়েল সে কথা জানিনে আগে! তবে ভোজ্য হিসাবে ভেন্নার বীজ বেটে বিভিন্ন ব্যঞ্জন রান্নায় ব্যবহারের কথা আগে জানতাম। ভেন্না বা রেড়ি ছোট গুল্মজাতীয় গাছ। সাধারণত ১০ থেকে ১২ ফুট উঁচু হয়। কাণ্ড ও পত্রদণ্ড নরম ও ফাঁপা। পাতাগুলো প্রায় গোলাকার হলেও আঙ্গুলসমেত হাতের মতো দেখতে। ভ্যারেন্ডার বৈজ্ঞানিক নাম Jatropho gossypifolia. এখানেই শেষ নয় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে এই ভেন্না বা রেড়িই আবার কচা নামে পরিচিত! কচার লাঠি গ্রামে বহুল চর্চিত অস্ত্র। তবে কচার আসল পরিচয় কৃষক বন্ধু হিসাবে। অনায়াস লব্ধ তৈলবীজ, বীজ ভালো দামে বিক্রি হয়। কচার ডালপালা জ্বালানি হিসাবেও চমৎকার দাহ্য। মূলত কৃষক তার ফসলের মাঠে বেড়া গাছ হিসাবে ভেন্নার বীজ বুনে দেয় আইল ধরে। বেড়া থেকেই ভেন্না শব্দের উৎপত্তি অনুমেয়। ভেন্না নিয়ে অনেক ভ্যারেন্ডা ভাজা হলো। তবে ভেন্নার গোটা বীজের সঙ্গে করোনাভাইরাসের অবয়বগত মিল দেখে প্রায়ই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা জন নানারকম পোস্ট দিয়ে লিখতে দেখি করোনাভাইরাস গাছে ধরে!
