Logo
Logo
×

ঘরে বাইরে

ভ্রমণ

নজরুল স্মৃতিধন্য ত্রিশাল

Icon

সুমন্ত গুপ্ত

প্রকাশ: ২৩ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর তাকে আবার কাজে ফিরে যেতে হয়। প্রথমে যোগ দেন বাসুদেবের কবি দলে। এর পর একজন খ্রিষ্টান রেলওয়ে গার্ডের খানসামা এবং সবশেষে আসানসোলের চা-রুটির দোকানে রুটি বানানোর কাজ নেন। এভাবে বেশ কষ্টের মাঝেই তার বাল্যজীবন অতিবাহিত হতে থাকে। এ দোকানে কাজ করার সময় আসানসোলের দারোগা কাজী রফিজ উল্লাহর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। দোকানে একা একা বসে যেসব কবিতা ও ছড়া রচনা করতেন তা দেখে রফিজ উল্লাহ তার প্রতিভার পরিচয় পান। তিনিই তাকে ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন। বন্ধুরা এতক্ষণে আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমি কার কথা বলছি আমি বলছি আমাদের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কথা। অনেক দিন ধরে পরিকল্পনা করছি আমাদের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিধন্য ত্রিশালে ঘুরে আসব কিন্তু ব্যাটে-বলে না হওয়ার ফলে যাওয়া হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত ছোট ভাই পিকুর কল্যাণে চলছি ময়মনসিংহের পথে। সকাল ৭টা ২০ বাজে আমি কমলাপুর রেলস্টেশনে পৌঁছে পিকুর জন্য অপেক্ষা করছি গন্তব্য তিস্তা এক্সপ্রেস করে ময়মনসিংহ। আমাদের ধারণা ছিল আমাদের বাংলাদেশ রেলওয়ে সেই আগের মতো সময়ের থেকে আধাঘণ্টা এক ঘণ্টা দেরি করে ছাড়ে কিন্তু আমাদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো আমাদের ট্রেন ঠিক ৭টা ৩০ মিনিটে আমাদের গন্তব্যের উদ্দেশে নিয়ে যাত্রা শুরু করল। ট্রেন তার কু ঝিক ঝিক ছন্দে এগিয়ে চলছে। গফরগাঁও স্টেশনে গরম গরম শিঙাড়া খেলাম এতটাই গরম যে জিভ পোড়ার জোগাড়। দেখতে দেখতে আমরা এসে পৌঁছলাম ময়মনসিংহ স্টেশনে। আমাদের নামিয়ে দিয়ে ট্রেন ছুটে চলল তার পরবর্তী গন্তব্য দেওয়ানগঞ্জের দিকে। আমরা ট্রেন থেকে নেমে রিকশা ঠিক করলাম ত্রিশাল বাসস্ট্যান্ডে যাওয়ার জন্য। আমাদের ব্যাটারিচালিত রিকশা তুফানের গতিতে এগিয়ে চলছে আর আমি উপভোগ করছি ময়মনসিংহ শহরকে। বেশ ঘিঞ্জি শহর অফিস খোলার দিন থাকায় রাস্তায় বেশ জ্যাম। গাঙ্গিনার পাড়, সি কে ঘোষ রোড, সেহড়া ঢাকা রোড দিয়ে এগিয়ে চলছি। ত্রিশাল বাসস্ট্যান্ডে পেঁৗঁছে আমরা পদ্মা গেট লক সার্ভিসের বাসে উঠলাম প্রায় বিশ মিনিট পর বাস আমাদের বইলর নামক স্থানে নামিয়ে দিল। এর পর বাস থেকে নেমে আমরা ব্যাটারিচালিত অটো করে পৌঁছে গেলাম আমাদের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিধন্য দারোগা বাড়িতে। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের পবিত্র মাটিতে জাতীয় কবির জন্মদিন উপলক্ষ্যে প্রদত্ত বাণীতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বলেছিলেন, নজরুল বাংলার বিদ্রোহী আত্মা ও বাঙালির স্বাধীন ঐত্যিহাসিক সত্তার রূপকার। ১৯২৯ সালে ১৫ ডিসেম্বর কলকাতা আ্যালবার্ট হলে বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে দেওয়া জাতীয় সংবর্ধনা সভায় প্রদত্ত মানপত্রের জবাবে নজরুল বলেছিলেন, সুন্দরের ধ্যান, তার স্তবগানই আমার উপাসনা আমার ধর্ম। যে কুলে যে সমাজে যে ধর্মে যে দেশেই জন্মগ্রহণ করি সে আমার দৈব। আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই আমি কবি। নজরুলের এ ধরনের বলিষ্ঠ উচ্চারণ নিয়ে গবেষণার সহযোগী ক্ষেত্র এখন এ পাঠাগার। এখানে কবি নজরুল যে ঘরটিতে থাকতেন সেটি পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে। কবি তার কবিতা গানে যেসব গাছের নাম উল্লেখ করেছেন সে গাছগুলো দিয়ে নজরুল স্মৃতি কেন্দ্রে ব্যতিক্রমধর্মী দৃষ্টিনন্দন বৃক্ষ বাগান তৈরি করা হয়েছে। এখানে কবি যে পুকুরে গোসল করতেন সেটিও সংরক্ষণ করা আছে। বিলের পাড়ে একটি বটগাছের নিচে কবি নজরুল আপন মনে বাঁশিতে সুর তুলতেন। এটি এখন নজরুল বটবৃক্ষ। দুই বাংলার নজরুলভক্তদের কাছে এটি তীর্থ স্থানের মর্যাদা পেয়েছে। বটের নিচে প্রায়ই বসে কবিদের আসর। আজ কবি নেই কিন্তু এ বটগাছটি আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে কবির অস্তিত্ব ঘোষণা করছে। এখানকার মনোরম পরিবেশ পর্যটকদের মোহিত করবে। নিচতলায় ময়মনসিংহ ত্রিশালে অবস্থানকালে যে খাটে ঘুমাতেন কবি সে খাটটির সঙ্গে রয়েছে মিলনায়তন, দ্বিতীয় তলায় উঠে আমরা দেখা পেলাম কবির বিভিন্ন ধরনের ছবি, যা যে কাউকেই মুগ্ধ করবে। সঙ্গে লাইব্রেরির দেখা পেলাম প্রায় কয়েক হাজার বই আছে এ লাইব্রেরিতে। এখানে যত্নসহকারে রয়েছে কাজী নজরুল ইসলামের স্বহস্তে লিখিত বই, নজরুল জীবন নিয়ে লিখা বই, নজরুলকে নিয়ে সমালোচনা করাসহ বিভিন্ন গানের রেকর্ড। কবির ওপর বই ছাড়াও সমসাময়িক লেখকদের বইও আছে এখানে। এরপর আমরা গেলাম ত্রিশাল বাসস্ট্যান্ডের পাশেই নজরুল একাডেমি। কবির স্মৃতিবিজড়িত দরিরামপুর হাইস্কুলই বর্তমানে নজরুল একাডেমি। এ স্কুলে কবি ৭ম ও ৮ম শ্রেণিতে লেখাপড়া করেছেন। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার খাতায় নজরুল লিখেছিলেন আমি এক পাড়া-গাঁয়ে স্কুল-পালানো ছেলে, তার ওপর পেটে ডুবুরি নামিয়ে দিলেও ‘ক’ অক্ষর খুঁজে পাওয়া যাবে না। স্কুলের হেডমাস্টারের চেহারা মনে করতেই আজও জল তেষ্টা পেয়ে যায়। কবির স্মৃতিকে ধরে রাখতে কবির সেই ক্লাস রুম ও দেওয়ালে এ কবিতার লাইন খোদাই করে সংরক্ষণ করা আছে। স্কুল মাঠের পাশেই রয়েছে ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে নজরুল মঞ্চ ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আধুনিক রেস্ট হাউজ। দেখতে দেখতে আমাদের বিদায়ের সময় চলে এলো আমরা আবার ৫টা ২০-এর তিস্তা এক্সপ্রেস করে ফিরে গেলাম সেই চিরচেনা শহরপানে।

কীভাবে আসবেন : ঢাকার মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে ভোর ৫টা থেকে প্রতি আধা ঘণ্টা পরপর ময়মনসিংহের উদ্দেশে সৌখিন, এনা, নিরাপদ বাস ছেড়ে আসে। টিকিটের মূল্য ২২০ টাকা। সময় লাগবে ২ ঘণ্টা অথবা সকাল ৭টা ৩০ মিনিটের তিস্তা এক্সপ্রেস করে ময়মনসিংহে ঘুরে আবার ৫টা ২০ মিনিটের ট্রেনে ফিরে যেতে পারেন ঢাকাতে। ট্রেনের ভাড়া ১২০ টাকা থেকে ২৫০ টাকা।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম