চাপে পিষ্ট ভাড়াটিয়া, মুখোমুখি বাড়িওয়ালা
jugantor
চাপে পিষ্ট ভাড়াটিয়া, মুখোমুখি বাড়িওয়ালা

  আল ফাতাহ মামুন  

২১ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০:০০  |  প্রিন্ট সংস্করণ

জীবন-জীবিকার তাগিদে গ্রাম ছেড়ে মানুষ শহরে আসে। শহরের কোলাহলে একটুখানি সুখের নীড় খুঁজে পেতে ভাড়া বাড়ি নগরের বেশিরভাগ মানুষের প্রধান আশ্রয়। ভাড়া থাকা নিরুপায় মানুষগুলো অনেকটা জিম্মি বাড়িওয়ালাদের কাছে। তবে বাড়িওয়ালারাও উপায়হীন বাস্তবতার কশাঘাতে।

‘বছর ঘুরলেই বাড়ি ভাড়া বেড়ে যায়, বেড়ে যায় সার্ভিস চার্জও। কিন্তু সে তুলনায় বেতন-ভাতা তো তেমন একটা বাড়ে না’- বলছিলেন লালবাগের ভাড়াটিয়া আনোয়ার হোসেন জয়। একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এ ভাড়াটে বলেন, আমি যে বাড়িতে থাকি, বাড়িওয়ালা খুবই ভালো মানুষ। কিন্তু রাজধানীর বেশিরভাগ বাড়িওয়ালা সম্পর্কে যা শুনি কিংবা অন্যসব ভাড়া বাসায় থেকে যে অভিজ্ঞতা জমেছে, তাতে ভাড়াটিয়ারা বাড়িওয়ালার কাছে জিম্মিই বলা চলে।’

খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা নজরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘পেশায় আমি একজন ব্যবসায়ী। বাড়ি ভাড়াসহ আবাসনের অন্যান্য খরচ মিটিয়ে কুলিয়ে উঠতে বেজায় হিমশিম খেতে হয়। বাড়িওয়ালা এ বছর আমার ফ্লাটের ভাড়া বাড়িয়েছে দু’হাজার টাকা, গত বছর দেড় হাজার টাকা, এর আগের বছর এক হাজার টাকা। তিন বছর আগে বাসা ভাড়া দিতাম ষোলো হাজার টাকা। এ বছর শুধু বাসা ভাড়াই দিচ্ছি বিশ হাজার পাঁচশ টাকা।’

রাজধানীর অন্যসব এলাকা থেকে জুরাইনে সবচেয়ে কম টাকায় বাসা ভাড়া পাওয়া যায়। পাঁচ বছর আগে আট হাজার টাকায় ডাইনিংসহ দুই রুমের ফ্লাট ভাড়া নিয়েছিলেন প্রবাসীর স্ত্রী নাসরিন সুলতানা। এ বছরের জানুয়ারি মাসে ওই বাসার ভাড়া দাঁড়িয়েছে চৌদ্দ হাজার টাকা। নাসরিন সুলতানা বলেন, ‘বছরে বছরে বাসা ভাড়া বাড়ায়। জুতসই বাসা পাওয়া মুশকিল। তাই অন্যসব ব্যয় কমিয়ে হলেও বাড়িওয়ালার দাবি মেনে এ বাসাতেই থাকছি।’

উত্তরা, মিরপুর, কল্যাণপুর, ধানমণ্ডি, মোহাম্মদপুর, পুরান ঢাকায় বসবারত অন্তত বিশজন ভাড়াটিয়ার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাড়িওয়ালারা ভাড়াটিয়ার সঙ্গে যুদ্ধংদেহী আচরণ করে। কিছু কিছু এলকায় নিয়ম করে পানি দেয়া, ছাদে বেড়াতে না দেয়া, বেশি মেহমান অ্যালাও না করাসহ নানা সব বিধিনিষেধ ঝুলিয়ে দেয় বাড়িওয়ালারা। এক কথায় বাড়িওয়ালার আইনে (!) ভাড়াটিয়াদের চলতে হয়। এ সম্পর্কে যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা আরিফ হোসেন বলেন, টাকা দিয়ে থাকি তবুও বাড়িওয়ালা কত কথা শোনায়। কখনও যদি অনুরোধের সুরেও বাড়িওয়লাকে কিছু বলি, কড়া গলায় জবাব দিয়ে বলেন, পছন্দ হলে থাকেন না হলে চলে যান। এ সবের একটা বিহিত হওয়া দরকার।

নারিন্দার বাসিন্দা মুরসালিন আহমেদ বলেন, ভাড়াটিয়াদের অধিকারের বিষয়ে আইন আছে। কিন্তু সে আইনের বাস্তবায়ন নেই। আবার ভাড়াটিয়ারাও আইনের দ্বারস্থ হতে আগ্রহী নয়। তা ছাড়া রাজধানীর বেশিরভাগ বাসিন্দাই ভাড়াটিয়া হওয়া সত্ত্বেও বাড়িওয়ালার চাপে পিষ্ট। এর একমাত্র কারণ, প্রতিবাদ করতে গিয়ে না জানি অস্থায়ী এ আশ্রয়টি হারাতে হয়। এ ভয়ই বাড়িওয়ালাদের প্রশ্রয় বাড়িয়ে দেয় অনেক বেশি।

বছর ঘুরলেই বাড়ি ভাড়া পাঁচশ, হাজার, দুই হাজার কোথাও কোথাও আরও বেশি বেড়ে যায়। কেন এমনটা হয়- জানতে কথা বলেছি ক’জন বাড়িওয়ালার সঙ্গে। বাড়িওয়ালাদের কমন অজুহাত গ্যাস-কারেন্ট, বিদুৎ বিল বেড়ে যায়, এ জন্যই বাড়ি ভাড়া বাড়ে। তবে লালবাগের বাড়িওয়ালা হাসনাত মজুমদার বলেন, সত্যি কথা বলতে কোনো কোনো বাড়িওয়ালা টাকার মোহে ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে অমানবিক আচরণও করে থাকে। বিষয়টি আরেকটু ব্যাখ্যা করে ওই বাড়িওয়ালা বলেন, আমার নিয়মিত ভাড়াটিয়ার কাছে জানুয়ারি মাসে হাজার দুই হাজার টাকা ভাড়া বাড়াতে পারি। কিন্তু ওই ভাড়াটিয়ার জায়গায় যদি নতুন ভাড়াটিয়া ওঠে আমি চোখ বন্ধ করে দুই থেকে আড়াই কখনও কখনও তিন হাজার টাকাও বেশি দাবি করতে পারি। এ জন্য কোনো কোনো বাড়িওয়ালার চাওয়াই থাকে ঘনঘন ভাড়াটিয়া বদল হোক।

সব বাড়িওয়ালাই যে এমন তা নয়। ব্যতিক্রমও আছে। জুরাইনের বাড়ির মালিক ইমতিয়াজ সর্দার বলেন, আমি প্রতি বছরে বাড়ি ভাড়া বাড়াই না। আমার এখানে ছয় বছর আগে যে ভাড়াটিয়া দশ হাজার টাকায় উঠেছে এখন সে সর্বোচ্চ বারো থেকে তেরো হাজার টাকা দিচ্ছে। দু’বছরে বা সঙ্গত কারণ বুঝে ভাড়া বাড়াই। তবে পুরনো ভাড়াটিয়া গেলে নতুন ভাড়াটিয়া উঠতে চাইলে তখন আগের চেয়ে বেশি ভাড়া চাওয়া হয়। গ্যাস-কারেন্টসহ আনুষাঙ্গিক সব খরচই তো ভাড়াটিয়া বহন করে। তাহলে বছরে বছরে অযৌক্তিক কেন ভাড়া বাড়ানো হবে?

বাড়িওয়ালাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাড়ির আনুষঙ্গিক ব্যয় বাড়ার কারণেই ভাড়া বেড়ে যায়। যেমন গেণ্ডারিয়ার বাড়িওয়ালা সাবরিনা সুলতানা বলেন, বছরে একাধিকবার পানি তোলার মোটর জ্বলে যায়। একেকটা ভালো মোটরের বেশ দাম আছে। এসব খরচ তো ভাড়াটিয়াদের থেকেই নিতে হবে। এসব বিবেচনা করেই বছরের শুরুতে আমরা একটা আনুমানিক হিসাব কষে ভাড়া বাড়িয়ে থাকি। তবে বাড়িওয়ালাদের উচিত ভাড়াটিয়াদের সামর্থ্যরে দিকে খেয়াল রাখা। ভাড়াটিয়াদেরও উচিত বাড়িওয়ালার সীমাবদ্ধতা বোঝা। ভাড়াটিয়া-বাড়িওয়ালার মধুর সম্পর্কই পারে অনেক জটিল সমস্যার সহজ সমাধান করতে।

চাপে পিষ্ট ভাড়াটিয়া, মুখোমুখি বাড়িওয়ালা

 আল ফাতাহ মামুন 
২১ জানুয়ারি ২০২০, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

জীবন-জীবিকার তাগিদে গ্রাম ছেড়ে মানুষ শহরে আসে। শহরের কোলাহলে একটুখানি সুখের নীড় খুঁজে পেতে ভাড়া বাড়ি নগরের বেশিরভাগ মানুষের প্রধান আশ্রয়। ভাড়া থাকা নিরুপায় মানুষগুলো অনেকটা জিম্মি বাড়িওয়ালাদের কাছে। তবে বাড়িওয়ালারাও উপায়হীন বাস্তবতার কশাঘাতে।

‘বছর ঘুরলেই বাড়ি ভাড়া বেড়ে যায়, বেড়ে যায় সার্ভিস চার্জও। কিন্তু সে তুলনায় বেতন-ভাতা তো তেমন একটা বাড়ে না’- বলছিলেন লালবাগের ভাড়াটিয়া আনোয়ার হোসেন জয়। একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এ ভাড়াটে বলেন, আমি যে বাড়িতে থাকি, বাড়িওয়ালা খুবই ভালো মানুষ। কিন্তু রাজধানীর বেশিরভাগ বাড়িওয়ালা সম্পর্কে যা শুনি কিংবা অন্যসব ভাড়া বাসায় থেকে যে অভিজ্ঞতা জমেছে, তাতে ভাড়াটিয়ারা বাড়িওয়ালার কাছে জিম্মিই বলা চলে।’

খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা নজরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘পেশায় আমি একজন ব্যবসায়ী। বাড়ি ভাড়াসহ আবাসনের অন্যান্য খরচ মিটিয়ে কুলিয়ে উঠতে বেজায় হিমশিম খেতে হয়। বাড়িওয়ালা এ বছর আমার ফ্লাটের ভাড়া বাড়িয়েছে দু’হাজার টাকা, গত বছর দেড় হাজার টাকা, এর আগের বছর এক হাজার টাকা। তিন বছর আগে বাসা ভাড়া দিতাম ষোলো হাজার টাকা। এ বছর শুধু বাসা ভাড়াই দিচ্ছি বিশ হাজার পাঁচশ টাকা।’

রাজধানীর অন্যসব এলাকা থেকে জুরাইনে সবচেয়ে কম টাকায় বাসা ভাড়া পাওয়া যায়। পাঁচ বছর আগে আট হাজার টাকায় ডাইনিংসহ দুই রুমের ফ্লাট ভাড়া নিয়েছিলেন প্রবাসীর স্ত্রী নাসরিন সুলতানা। এ বছরের জানুয়ারি মাসে ওই বাসার ভাড়া দাঁড়িয়েছে চৌদ্দ হাজার টাকা। নাসরিন সুলতানা বলেন, ‘বছরে বছরে বাসা ভাড়া বাড়ায়। জুতসই বাসা পাওয়া মুশকিল। তাই অন্যসব ব্যয় কমিয়ে হলেও বাড়িওয়ালার দাবি মেনে এ বাসাতেই থাকছি।’

উত্তরা, মিরপুর, কল্যাণপুর, ধানমণ্ডি, মোহাম্মদপুর, পুরান ঢাকায় বসবারত অন্তত বিশজন ভাড়াটিয়ার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাড়িওয়ালারা ভাড়াটিয়ার সঙ্গে যুদ্ধংদেহী আচরণ করে। কিছু কিছু এলকায় নিয়ম করে পানি দেয়া, ছাদে বেড়াতে না দেয়া, বেশি মেহমান অ্যালাও না করাসহ নানা সব বিধিনিষেধ ঝুলিয়ে দেয় বাড়িওয়ালারা। এক কথায় বাড়িওয়ালার আইনে (!) ভাড়াটিয়াদের চলতে হয়। এ সম্পর্কে যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা আরিফ হোসেন বলেন, টাকা দিয়ে থাকি তবুও বাড়িওয়ালা কত কথা শোনায়। কখনও যদি অনুরোধের সুরেও বাড়িওয়লাকে কিছু বলি, কড়া গলায় জবাব দিয়ে বলেন, পছন্দ হলে থাকেন না হলে চলে যান। এ সবের একটা বিহিত হওয়া দরকার।

নারিন্দার বাসিন্দা মুরসালিন আহমেদ বলেন, ভাড়াটিয়াদের অধিকারের বিষয়ে আইন আছে। কিন্তু সে আইনের বাস্তবায়ন নেই। আবার ভাড়াটিয়ারাও আইনের দ্বারস্থ হতে আগ্রহী নয়। তা ছাড়া রাজধানীর বেশিরভাগ বাসিন্দাই ভাড়াটিয়া হওয়া সত্ত্বেও বাড়িওয়ালার চাপে পিষ্ট। এর একমাত্র কারণ, প্রতিবাদ করতে গিয়ে না জানি অস্থায়ী এ আশ্রয়টি হারাতে হয়। এ ভয়ই বাড়িওয়ালাদের প্রশ্রয় বাড়িয়ে দেয় অনেক বেশি।

বছর ঘুরলেই বাড়ি ভাড়া পাঁচশ, হাজার, দুই হাজার কোথাও কোথাও আরও বেশি বেড়ে যায়। কেন এমনটা হয়- জানতে কথা বলেছি ক’জন বাড়িওয়ালার সঙ্গে। বাড়িওয়ালাদের কমন অজুহাত গ্যাস-কারেন্ট, বিদুৎ বিল বেড়ে যায়, এ জন্যই বাড়ি ভাড়া বাড়ে। তবে লালবাগের বাড়িওয়ালা হাসনাত মজুমদার বলেন, সত্যি কথা বলতে কোনো কোনো বাড়িওয়ালা টাকার মোহে ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে অমানবিক আচরণও করে থাকে। বিষয়টি আরেকটু ব্যাখ্যা করে ওই বাড়িওয়ালা বলেন, আমার নিয়মিত ভাড়াটিয়ার কাছে জানুয়ারি মাসে হাজার দুই হাজার টাকা ভাড়া বাড়াতে পারি। কিন্তু ওই ভাড়াটিয়ার জায়গায় যদি নতুন ভাড়াটিয়া ওঠে আমি চোখ বন্ধ করে দুই থেকে আড়াই কখনও কখনও তিন হাজার টাকাও বেশি দাবি করতে পারি। এ জন্য কোনো কোনো বাড়িওয়ালার চাওয়াই থাকে ঘনঘন ভাড়াটিয়া বদল হোক।

সব বাড়িওয়ালাই যে এমন তা নয়। ব্যতিক্রমও আছে। জুরাইনের বাড়ির মালিক ইমতিয়াজ সর্দার বলেন, আমি প্রতি বছরে বাড়ি ভাড়া বাড়াই না। আমার এখানে ছয় বছর আগে যে ভাড়াটিয়া দশ হাজার টাকায় উঠেছে এখন সে সর্বোচ্চ বারো থেকে তেরো হাজার টাকা দিচ্ছে। দু’বছরে বা সঙ্গত কারণ বুঝে ভাড়া বাড়াই। তবে পুরনো ভাড়াটিয়া গেলে নতুন ভাড়াটিয়া উঠতে চাইলে তখন আগের চেয়ে বেশি ভাড়া চাওয়া হয়। গ্যাস-কারেন্টসহ আনুষাঙ্গিক সব খরচই তো ভাড়াটিয়া বহন করে। তাহলে বছরে বছরে অযৌক্তিক কেন ভাড়া বাড়ানো হবে?

বাড়িওয়ালাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাড়ির আনুষঙ্গিক ব্যয় বাড়ার কারণেই ভাড়া বেড়ে যায়। যেমন গেণ্ডারিয়ার বাড়িওয়ালা সাবরিনা সুলতানা বলেন, বছরে একাধিকবার পানি তোলার মোটর জ্বলে যায়। একেকটা ভালো মোটরের বেশ দাম আছে। এসব খরচ তো ভাড়াটিয়াদের থেকেই নিতে হবে। এসব বিবেচনা করেই বছরের শুরুতে আমরা একটা আনুমানিক হিসাব কষে ভাড়া বাড়িয়ে থাকি। তবে বাড়িওয়ালাদের উচিত ভাড়াটিয়াদের সামর্থ্যরে দিকে খেয়াল রাখা। ভাড়াটিয়াদেরও উচিত বাড়িওয়ালার সীমাবদ্ধতা বোঝা। ভাড়াটিয়া-বাড়িওয়ালার মধুর সম্পর্কই পারে অনেক জটিল সমস্যার সহজ সমাধান করতে।

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন