রাজধানীতে ভোটের হাওয়া
jugantor
রাজধানীতে ভোটের হাওয়া
যানজট ও দূষণমুক্ত নগরীর প্রত্যাশা * ডেঙ্গু আর চিকুনগুনিয়া আর না * নারীর জন্য নিরাপদ ঢাকা চাই

  যাকারিয়া ইবনে ইউসুফ  

২৮ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০:০০  |  প্রিন্ট সংস্করণ

আগামী ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বহুল প্রতীক্ষিত ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন। রাজধানী ঢাকায় এখন ভোটের আমেজ।

পোস্টার-ব্যানার-ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে ঢাকার অলিগলি থেকে রাজপথ। মহল্লার চায়ের টেবিল থেকে শুরু করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস সবখানেই এক আলোচনা কে হচ্ছেন নগরপিতা।

নতুন মেয়রদ্বয় কি পারবেন তিলোত্তমা ঢাকাকে বসবাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে? নগরপিতারা কি পারবেন যানজটমুক্ত দূষণমুক্ত একটি নিরাপদ নগরী হিসেবে ঢাকাকে প্রতিষ্ঠা করতে? ভোটের আগে এমন প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে সাধারণ ভোটারদের মনে।

যানজট ও দূষণমুক্ত ঢাকা চান ভোটাররা : প্রতিনিয়তই বিভিন্ন সমস্যায় নাকাল রাজধানীর মানুষ। নগর জীবনের বড় সমস্যা যানজট। যানবাহনের চাপ সহ্য করতে পারছে না ঢাকার সড়কগুলো। সীমিত, অপ্রশস্ত, অপরিকল্পিত রাস্তার শহর ঢাকা এখন হয়ে উঠেছে বসবাসের অযোগ্য।

সারা দেশে চলাচলকারী যানবাহনের অর্ধেকের বেশি চলাচল করছে রাজধানীতে। মেগাসিটি ঢাকায় জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে যাচ্ছে যানবাহনের সংখ্যা। সে অনুপাতে রাস্তার প্রশস্তকরণ বা বিকল্প রাস্তা নির্মাণ হয়নি। আধুনিক নগরীর আন্তর্জাতিক মানদণ্ড হিসেবে, একটি শহরের রাস্তার পরিমাণ হওয়া উচিত মোট আয়তনের শতকরা ২৫ ভাগ। অথচ ঢাকায় মোট রাস্তার পরিমাণ আয়তনের মাত্র ৮ ভাগ। রাস্তার জন্য জায়গা না বাড়লেও প্রতিনিয়ত বাড়ছে যানবাহনের সংখ্যা। যানজটে পড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় গাড়িগুলোকে। এতে পুড়ছে তেল, অপচয় হচ্ছে শ্রমশক্তি। নতুন নগর পিতার কাছে শহরবাসীর প্রত্যাশা যানজটমুক্ত ঢাকা।

যানজটের পাশাপাশি রাজধানী ঢাকার অন্যতম প্রধান সমস্যা দূষণ। প্রতিবেদনটি লেখার সময়ও রাজধানীর বায়ু দূষিত শহরগুলোর তালিকায় শীর্ষ পাঁচে অবস্থান করছে ঢাকা। গত এক দশকে বায়ুদূষণে মৃত্যুর হার চারগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে, বর্তমানে গড়ে প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী ৫৫ লাখের বেশি মানুষ বায়ুদূষণের কারণে মারা যাচ্ছে। এর মধ্যে নিু ও মধ্য আয়ের দেশ, বিশেষ করে প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিমপ্রান্তীয় ও দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অঞ্চলে প্রাণহানির হার সবচেয়ে বেশি।

বায়ুদূষণের দিক থেকে ভারত এবং চীনের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। বিভিন্ন কারণে দূষিত হচ্ছে ঢাকাসহ বাংলাদেশের প্রতিটি নগর ও শহর এলাকার বায়ু। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক হেলথ ইফেক্টস ইন্সটিটিউট এবং ইন্সটিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন নামে দুটি যৌথ গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে দূষিত বায়ুর শহরগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে ঢাকা। শীর্ষে রয়েছে ভারতের দিল্লি। ঢাকার পরেই অবস্থান করছে পাকিস্তানের করাচি ও চীনের বেইজিং। কাজেই নগরবাসীর প্রত্যাশা একটা দূষণমুক্ত শহর।

মশা আর নয় : বিগত কয়েক বছরের মধ্যে রাজধানীবাসীকে সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া। ২০১৯ সালে ঢাকাসহ সারা দেশে মহামারির মতো ছড়িয়ে যায় ডেঙ্গু। এবার দেশের ইতিহাসে রেকর্ড সংখ্যক মানুষ ডেঙ্গুতে প্রাণ হারিয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাবে, ১ জানুয়ারি ২০১৯ থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এক বছরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারান ১৪৮ জন।

তবে মৃতের প্রকৃত সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি। তাই রাজধানীবাসীর চিন্তায় মশা। দিনমজুর থেকে শুরু করে চাকরিজীবী সবাই মশামুক্ত ঢাকা গড়তে নতুন মেয়রদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ সব দল বা স্বতন্ত্র মেয়রপ্রার্থীরাও তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে মশা নিয়ন্ত্রণে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন।

নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে : বাংলাদেশে দিন দিন ধর্ষণ বাড়ছে। পাশাপাশি বেড়েছে নারীর প্রতি সহিংসতা। কঠোর আইন, প্রচার-প্রচারণা ও উচ্চ আদালতের নানা ধরনের নির্দেশনার পরও নারীর প্রতি সহিংসতা কমানো যাচ্ছে না। ধর্ষকের লোলুপ দৃষ্টি থেকে বাদ যাচ্ছে না শিশু-বৃদ্ধরাও। এমনকি রেহাই পাচ্ছেন না বাকপ্রতিবন্ধী বা ভবঘুরে পাগলও।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে চরম নৈতিক অবক্ষয়, আকাশ সংস্কৃতি, মাদকের বিস্তার, বিচারহীনতা, বিচার প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধকতা ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতা। পরিসংখ্যান বলছে, গত বছর সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। চলতি বছরের শুরুতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ১ হাজার ৪১৩ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ২০১৮ সালে এ সংখ্যা ছিল ৭৩২। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় ধর্ষণের ঘটনা দ্বিগুণ বেড়েছে।

রাজধানীর নারী ভোটাররা যুগান্তরকে বলেছেন, আমরা নিরাপদে ঢাকায় চলাচল করতে চাই। নগরীর যেসব জায়গায় আলোকস্বল্পতা আছে সেখানে প্রয়োজনীয় বাতি এবং সিসি ক্যামেরার আওতায় আনতে হবে।

নগরীতে চলাচলকারী বাসগুলোতে নারীর জন্য সংরক্ষিত আসন নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি নারীর আইনি সহায়তার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

পোস্টারে ব্যবহার হচ্ছে নিষিদ্ধ পলিথিন : আসন্ন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী সব মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীই পরিচ্ছন্ন সবুজ নগরী গড়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন নগরবাসীকে। তবে দুঃখের হলেও সত্য কাউন্সিলর, সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর প্রার্থী থেকে শুরু করে মেয়র প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণায় বানানো পোস্টার-প্ল্যাকার্ড ঝোলান হচ্ছে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নিষিদ্ধ পলিথিনে মুড়িয়ে।

দুই সিটি করপোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডের অলি-গলি, চায়ের দোকান, বাসা-বাড়ি, প্রধান সড়কসহ সব জায়গাতেই পলিথিনে মোড়ানো পোস্টার ঝুলছে। পরিবেশে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ পলিথিনের কারণেই বর্ষাকালে রাজধানীতে তীব্র জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। সিটি নির্বাচনে ভয়াবহ আকারে পলিথিনের ব্যবহার হওয়ায় সামনের বর্ষায় ঢাকা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে অধিকাংশ প্রার্থীই যুগান্তরকে বলেছেন, সিটি নির্বাচনের পর তারা দায়িত্ব নিয়ে এগুলো অপসারণ করবেন।

এ ব্যাপারে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপস জানান, পরিবেশের ক্ষতি হোক সেটা আমরা চাই না।

লেমিনেটিং করা পোস্টার ইসির আচরণবিধির বাইরে নয়। নেতাকর্মীরা অনেকেই হয়তো লেমিনেটিং পোস্টার ঝুলিয়েছেন। তবে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যে, সিটি নির্বাচনের পর নিজ দায়িত্বে এসব পোস্টার সরিয়ে ফেলা হবে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বিএনপি মনোনীত প্রার্থী তাবিথ আউয়াল বলেন, আমি সচেতনভাবেই কর্মীদের পলিথিন ব্যবহার না করতে বলেছি। তারপরও অনেকে হয়তো করেছেন। নির্বাচনের রায়ে যেমনই হোক সব প্রার্থীর লেমিনেটিং করা পোস্টার দায়িত্ব নিয়ে সরিয়ে রিসাইকেলের ব্যবস্থা করা হবে।

প্রচারণার নামে শব্দদূষণ : আসন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে এখন চলছে শেষ মুহূর্তের প্রচারণা। নগরীর অলিগলি এমনকি বাড়ি বাড়ি গিয়ে নগরবাসীর কাছে ভোট ও দোয়া চাচ্ছেন প্রার্থীরা। এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও চলছে জোর প্রচারণা। তবে নগরবাসীর কাছে ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সারাক্ষণ মাইকের ব্যবহার। সকাল ৯টা থেকে শুরু করে রাত দশটা পর্যন্ত কোনো না কোনো প্রার্থীর প্রচারণা চলছেই। উচ্চ ভলিউমে চলা এসব মাইকে হচ্ছে শব্দদূষণ।

বিশেষ করে বিভিন্ন গানের সুরে বানানো প্রচারণার নতুন ধরনে খানিকটা বিরক্তও নগরবাসী। অমুক ভাইয়ের/আপার সালাম নিন, অমুক মার্কায় ভোট দিন সারাদিন এ ধরনের বাজনা চলছেই। মাইকের এ বাড়াবাড়িতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা। অভিভাবকরা বলছেন, ৩ তারিখ থেকে এসএসসি পরীক্ষা হাতে একদম সময় নেই। মাইকে উচ্চস্বরে প্রচারণার কারণে পরীক্ষার্থীদের সমস্যাতো হচ্ছেই সাধারণ মানুষও বিরক্ত।

বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষ : নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে গিয়ে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের কর্মী সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে বিএনপির প্রার্থী তাবিথ আউয়ালের প্রচারণায় মিরপুর ও গাবতলীতে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। তবে ইসি বলছে, হামলা নয় সামান্য ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটেছে। অন্যদিকে রোববার রাজধানীর গোপীবাগে প্রচারণা চালানোর সময় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে বিএনপির প্রার্থী ইশরাক হোসেনের বহরেও হামলার ঘটনা ঘটেছে। পরে আওয়ামী লীগ-বিএনপি সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া শুরু হয়। ৩০ মিনিট ধরে চলা এ সংঘর্ষে নেতাকর্মী ছাড়াও বেশ কয়েকজন সাংবাদিক আহত হয়েছেন।

এ সময় গুলির শব্দও শোনা যায়। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। এ ব্যাপারে ইশরাক হোসেন বলেন, আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর প্রার্থীর অফিস থেকে আমাদের প্রচারণায় অতর্কিত হামলা হয়েছে। আমি তাদের একজনের হাতে আগ্নেয়াস্ত্রও দেখেছি। তাদের হামলায় আমার বেশ কয়েকজন কর্মী রক্তাক্ত হয়েছে।

তারা আমার ওপর হামলার চেষ্টা করেছে। আমার কর্মীরা আমাকে রক্ষা করেছে। তিনি বলেন, আমরা ভীত নই, ব্যালটের মাধ্যমে এ হামলার জবাব দেয়া হবে। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ফজলে নূর তাপস বলেন, বিএনপি প্রার্থী নিজেই নির্বাচন পরিস্থিতি বানচালের জন্য এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি করেছে।

আমার দলের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। আমরা এ ব্যাপারে আইনের আশ্রয় নিয়েছি। আমরা ঢাকাবাসীকে যে উন্নয়নের রূপরেখা দিয়েছেন সেটা ঢাকাবাসী গ্রহণ করেছেন। পহেলা ফেব্রুয়ারি নৌকার পক্ষে রায় দিয়ে জনগণ আমাদের পাশে থাকবেন।

রাজধানীতে ভোটের হাওয়া

যানজট ও দূষণমুক্ত নগরীর প্রত্যাশা * ডেঙ্গু আর চিকুনগুনিয়া আর না * নারীর জন্য নিরাপদ ঢাকা চাই
 যাকারিয়া ইবনে ইউসুফ 
২৮ জানুয়ারি ২০২০, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

আগামী ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বহুল প্রতীক্ষিত ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন। রাজধানী ঢাকায় এখন ভোটের আমেজ।

পোস্টার-ব্যানার-ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে ঢাকার অলিগলি থেকে রাজপথ। মহল্লার চায়ের টেবিল থেকে শুরু করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস সবখানেই এক আলোচনা কে হচ্ছেন নগরপিতা।

নতুন মেয়রদ্বয় কি পারবেন তিলোত্তমা ঢাকাকে বসবাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে? নগরপিতারা কি পারবেন যানজটমুক্ত দূষণমুক্ত একটি নিরাপদ নগরী হিসেবে ঢাকাকে প্রতিষ্ঠা করতে? ভোটের আগে এমন প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে সাধারণ ভোটারদের মনে।

যানজট ও দূষণমুক্ত ঢাকা চান ভোটাররা : প্রতিনিয়তই বিভিন্ন সমস্যায় নাকাল রাজধানীর মানুষ। নগর জীবনের বড় সমস্যা যানজট। যানবাহনের চাপ সহ্য করতে পারছে না ঢাকার সড়কগুলো। সীমিত, অপ্রশস্ত, অপরিকল্পিত রাস্তার শহর ঢাকা এখন হয়ে উঠেছে বসবাসের অযোগ্য।

সারা দেশে চলাচলকারী যানবাহনের অর্ধেকের বেশি চলাচল করছে রাজধানীতে। মেগাসিটি ঢাকায় জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে যাচ্ছে যানবাহনের সংখ্যা। সে অনুপাতে রাস্তার প্রশস্তকরণ বা বিকল্প রাস্তা নির্মাণ হয়নি। আধুনিক নগরীর আন্তর্জাতিক মানদণ্ড হিসেবে, একটি শহরের রাস্তার পরিমাণ হওয়া উচিত মোট আয়তনের শতকরা ২৫ ভাগ। অথচ ঢাকায় মোট রাস্তার পরিমাণ আয়তনের মাত্র ৮ ভাগ। রাস্তার জন্য জায়গা না বাড়লেও প্রতিনিয়ত বাড়ছে যানবাহনের সংখ্যা। যানজটে পড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় গাড়িগুলোকে। এতে পুড়ছে তেল, অপচয় হচ্ছে শ্রমশক্তি। নতুন নগর পিতার কাছে শহরবাসীর প্রত্যাশা যানজটমুক্ত ঢাকা।

যানজটের পাশাপাশি রাজধানী ঢাকার অন্যতম প্রধান সমস্যা দূষণ। প্রতিবেদনটি লেখার সময়ও রাজধানীর বায়ু দূষিত শহরগুলোর তালিকায় শীর্ষ পাঁচে অবস্থান করছে ঢাকা। গত এক দশকে বায়ুদূষণে মৃত্যুর হার চারগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে, বর্তমানে গড়ে প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী ৫৫ লাখের বেশি মানুষ বায়ুদূষণের কারণে মারা যাচ্ছে। এর মধ্যে নিু ও মধ্য আয়ের দেশ, বিশেষ করে প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিমপ্রান্তীয় ও দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অঞ্চলে প্রাণহানির হার সবচেয়ে বেশি।

বায়ুদূষণের দিক থেকে ভারত এবং চীনের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। বিভিন্ন কারণে দূষিত হচ্ছে ঢাকাসহ বাংলাদেশের প্রতিটি নগর ও শহর এলাকার বায়ু। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক হেলথ ইফেক্টস ইন্সটিটিউট এবং ইন্সটিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন নামে দুটি যৌথ গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে দূষিত বায়ুর শহরগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে ঢাকা। শীর্ষে রয়েছে ভারতের দিল্লি। ঢাকার পরেই অবস্থান করছে পাকিস্তানের করাচি ও চীনের বেইজিং। কাজেই নগরবাসীর প্রত্যাশা একটা দূষণমুক্ত শহর।

মশা আর নয় : বিগত কয়েক বছরের মধ্যে রাজধানীবাসীকে সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া। ২০১৯ সালে ঢাকাসহ সারা দেশে মহামারির মতো ছড়িয়ে যায় ডেঙ্গু। এবার দেশের ইতিহাসে রেকর্ড সংখ্যক মানুষ ডেঙ্গুতে প্রাণ হারিয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাবে, ১ জানুয়ারি ২০১৯ থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এক বছরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারান ১৪৮ জন।

তবে মৃতের প্রকৃত সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি। তাই রাজধানীবাসীর চিন্তায় মশা। দিনমজুর থেকে শুরু করে চাকরিজীবী সবাই মশামুক্ত ঢাকা গড়তে নতুন মেয়রদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ সব দল বা স্বতন্ত্র মেয়রপ্রার্থীরাও তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে মশা নিয়ন্ত্রণে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন।

নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে : বাংলাদেশে দিন দিন ধর্ষণ বাড়ছে। পাশাপাশি বেড়েছে নারীর প্রতি সহিংসতা। কঠোর আইন, প্রচার-প্রচারণা ও উচ্চ আদালতের নানা ধরনের নির্দেশনার পরও নারীর প্রতি সহিংসতা কমানো যাচ্ছে না। ধর্ষকের লোলুপ দৃষ্টি থেকে বাদ যাচ্ছে না শিশু-বৃদ্ধরাও। এমনকি রেহাই পাচ্ছেন না বাকপ্রতিবন্ধী বা ভবঘুরে পাগলও।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে চরম নৈতিক অবক্ষয়, আকাশ সংস্কৃতি, মাদকের বিস্তার, বিচারহীনতা, বিচার প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধকতা ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতা। পরিসংখ্যান বলছে, গত বছর সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। চলতি বছরের শুরুতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ১ হাজার ৪১৩ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ২০১৮ সালে এ সংখ্যা ছিল ৭৩২। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় ধর্ষণের ঘটনা দ্বিগুণ বেড়েছে।

রাজধানীর নারী ভোটাররা যুগান্তরকে বলেছেন, আমরা নিরাপদে ঢাকায় চলাচল করতে চাই। নগরীর যেসব জায়গায় আলোকস্বল্পতা আছে সেখানে প্রয়োজনীয় বাতি এবং সিসি ক্যামেরার আওতায় আনতে হবে।

নগরীতে চলাচলকারী বাসগুলোতে নারীর জন্য সংরক্ষিত আসন নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি নারীর আইনি সহায়তার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

পোস্টারে ব্যবহার হচ্ছে নিষিদ্ধ পলিথিন : আসন্ন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী সব মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীই পরিচ্ছন্ন সবুজ নগরী গড়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন নগরবাসীকে। তবে দুঃখের হলেও সত্য কাউন্সিলর, সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর প্রার্থী থেকে শুরু করে মেয়র প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণায় বানানো পোস্টার-প্ল্যাকার্ড ঝোলান হচ্ছে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নিষিদ্ধ পলিথিনে মুড়িয়ে।

দুই সিটি করপোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডের অলি-গলি, চায়ের দোকান, বাসা-বাড়ি, প্রধান সড়কসহ সব জায়গাতেই পলিথিনে মোড়ানো পোস্টার ঝুলছে। পরিবেশে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ পলিথিনের কারণেই বর্ষাকালে রাজধানীতে তীব্র জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। সিটি নির্বাচনে ভয়াবহ আকারে পলিথিনের ব্যবহার হওয়ায় সামনের বর্ষায় ঢাকা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে অধিকাংশ প্রার্থীই যুগান্তরকে বলেছেন, সিটি নির্বাচনের পর তারা দায়িত্ব নিয়ে এগুলো অপসারণ করবেন।

এ ব্যাপারে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপস জানান, পরিবেশের ক্ষতি হোক সেটা আমরা চাই না।

লেমিনেটিং করা পোস্টার ইসির আচরণবিধির বাইরে নয়। নেতাকর্মীরা অনেকেই হয়তো লেমিনেটিং পোস্টার ঝুলিয়েছেন। তবে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যে, সিটি নির্বাচনের পর নিজ দায়িত্বে এসব পোস্টার সরিয়ে ফেলা হবে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বিএনপি মনোনীত প্রার্থী তাবিথ আউয়াল বলেন, আমি সচেতনভাবেই কর্মীদের পলিথিন ব্যবহার না করতে বলেছি। তারপরও অনেকে হয়তো করেছেন। নির্বাচনের রায়ে যেমনই হোক সব প্রার্থীর লেমিনেটিং করা পোস্টার দায়িত্ব নিয়ে সরিয়ে রিসাইকেলের ব্যবস্থা করা হবে।

প্রচারণার নামে শব্দদূষণ : আসন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে এখন চলছে শেষ মুহূর্তের প্রচারণা। নগরীর অলিগলি এমনকি বাড়ি বাড়ি গিয়ে নগরবাসীর কাছে ভোট ও দোয়া চাচ্ছেন প্রার্থীরা। এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও চলছে জোর প্রচারণা। তবে নগরবাসীর কাছে ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সারাক্ষণ মাইকের ব্যবহার। সকাল ৯টা থেকে শুরু করে রাত দশটা পর্যন্ত কোনো না কোনো প্রার্থীর প্রচারণা চলছেই। উচ্চ ভলিউমে চলা এসব মাইকে হচ্ছে শব্দদূষণ।

বিশেষ করে বিভিন্ন গানের সুরে বানানো প্রচারণার নতুন ধরনে খানিকটা বিরক্তও নগরবাসী। অমুক ভাইয়ের/আপার সালাম নিন, অমুক মার্কায় ভোট দিন সারাদিন এ ধরনের বাজনা চলছেই। মাইকের এ বাড়াবাড়িতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা। অভিভাবকরা বলছেন, ৩ তারিখ থেকে এসএসসি পরীক্ষা হাতে একদম সময় নেই। মাইকে উচ্চস্বরে প্রচারণার কারণে পরীক্ষার্থীদের সমস্যাতো হচ্ছেই সাধারণ মানুষও বিরক্ত।

বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষ : নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে গিয়ে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের কর্মী সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে বিএনপির প্রার্থী তাবিথ আউয়ালের প্রচারণায় মিরপুর ও গাবতলীতে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। তবে ইসি বলছে, হামলা নয় সামান্য ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটেছে। অন্যদিকে রোববার রাজধানীর গোপীবাগে প্রচারণা চালানোর সময় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে বিএনপির প্রার্থী ইশরাক হোসেনের বহরেও হামলার ঘটনা ঘটেছে। পরে আওয়ামী লীগ-বিএনপি সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া শুরু হয়। ৩০ মিনিট ধরে চলা এ সংঘর্ষে নেতাকর্মী ছাড়াও বেশ কয়েকজন সাংবাদিক আহত হয়েছেন।

এ সময় গুলির শব্দও শোনা যায়। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। এ ব্যাপারে ইশরাক হোসেন বলেন, আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর প্রার্থীর অফিস থেকে আমাদের প্রচারণায় অতর্কিত হামলা হয়েছে। আমি তাদের একজনের হাতে আগ্নেয়াস্ত্রও দেখেছি। তাদের হামলায় আমার বেশ কয়েকজন কর্মী রক্তাক্ত হয়েছে।

তারা আমার ওপর হামলার চেষ্টা করেছে। আমার কর্মীরা আমাকে রক্ষা করেছে। তিনি বলেন, আমরা ভীত নই, ব্যালটের মাধ্যমে এ হামলার জবাব দেয়া হবে। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ফজলে নূর তাপস বলেন, বিএনপি প্রার্থী নিজেই নির্বাচন পরিস্থিতি বানচালের জন্য এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি করেছে।

আমার দলের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। আমরা এ ব্যাপারে আইনের আশ্রয় নিয়েছি। আমরা ঢাকাবাসীকে যে উন্নয়নের রূপরেখা দিয়েছেন সেটা ঢাকাবাসী গ্রহণ করেছেন। পহেলা ফেব্রুয়ারি নৌকার পক্ষে রায় দিয়ে জনগণ আমাদের পাশে থাকবেন।

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন