প্রাণের মেলায় জীবনের আলো
‘রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু বইখানা অনন্ত-যৌবনা, যদি তেমন বই হয়।’ ওমর খৈয়ামের এই বিখ্যাত মন্তব্যের মধ্যেই লুকিয়ে আছে বইয়ের চিরন্তনতার কথা।
বই একটি জাতিকে অন্ধকার থেকে আলোর পথ দেখায়। মার্কাস টুলিয়াস সিসারো বলেছেন, ‘বই ছাড়া একটি কক্ষ আত্মা ছাড়া দেহের মত।’ পৃথিবীর যতগুলো দেশ ও সভ্যতা উন্নতির চরম শিখরে উঠেছে তার নেপথ্যে ছিল জ্ঞান সাধনা। বই সেই জ্ঞানের ধারক ও বাহক। জ্ঞানকে বলা হয় শ্রেষ্ঠ সম্পদ। আর ঠিক সে কারণেই সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছিলেন, ‘বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না।’
একই প্রসঙ্গে, প্রতিভা বসু বলেছেন, ‘বই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ আত্মীয়, যার সঙ্গে কোনোদিন ঝগড়া হয় না, কোনোদিন মনোমালিন্য হয় না।’ তবে বর্তমানে পুঁজি ও প্রচারণার জোরে মানসম্মত বইয়ের চেয়ে নিুমানের বই নিয়েই বেশি উচ্চবাচ্য লক্ষ করা যাচ্ছে। বাংলা একাডেমির তথ্যমতে, এ বছর বইমেলায় ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মোট ২ হাজার ৩৪০টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
তবে বইয়ের মান নিয়ে প্রতি বছরের মতো এবারও প্রশ্ন রয়ে গেছে। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মাদ আজম যুগান্তরকে বলেন, বইমেলা উপলক্ষে বই লেখা ও প্রকাশ করার যে সংস্কৃতি এটা বইয়ের জন্য খারাপ সংস্কৃতি। এটা থেকে আমাদের সচেতনভাবে বেরিয়ে আসতে হবে। এক মাস বই বের হবে এবং লেখকেরা এ উপলক্ষে বই লিখবে এটা ভালো লক্ষণ নয়।
সবচেয়ে বড় পরিসরে বইমেলা
এবারের বইমেলা উৎসর্গিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতির প্রতি। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে বইমেলা ডানা মেলেছে পূর্বের চেয়ে বড় পরিসরে। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ এবং একাডেমির সামনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রায় ৮ লাখ বর্গফুট জায়গাজুড়ে এবার বসেছে বইমেলার পসরা। বাংলা একাডেমির উপ-পরিচালক কামাল উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে জানান, এবার একাডেমি প্রাঙ্গণে ১২৬টি প্রতিষ্ঠানকে ১৭৯টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৪৩৪টি প্রতিষ্ঠানকে ৬৯৪টি ইউনিট, মোট ৫৬০টি প্রতিষ্ঠানকে ৮৭৩টি ইউনিট এবং বাংলা একাডেমিসহ ৩৩টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে ৩৪টি প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
এ বছর লিটল ম্যাগাজিন চত্বর স্থানান্তরিত হয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মূল মেলা প্রাঙ্গণ। সেখানে ১৫২টি লিটলম্যাগকে স্টল বরাদ্দের পাশাপাশি ৬টি উন্মুক্ত স্টলসহ ১৫৮টি লিটলম্যাগকে স্টল দেয়া হয়েছে। একক ক্ষুদ্র প্রকাশনা সংস্থা এবং ব্যক্তি উদ্যোগে যারা বই প্রকাশ করেছেন তাদের বই বিক্রি/প্রদর্শিত হচ্ছে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের স্টলে। মেলা উপলক্ষে বাংলা একাডেমি ও মেলায় অংশগ্রহণকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ২৫% কমিশনে বই বিক্রি করছে। আর বিকাশে মূল্য পরিশোধ করলে পাঠক-ক্রেতারা আরও অতিরিক্ত ১০% ছাড় পাবেন।
জাল নোট চক্রের জালিয়াতি
জাল নোট চক্রের টার্গেটস্থল এখন মেলা। বই মেলায় প্রচুর ভিড় রয়েছে এমন দোকানে বই কিনতে গিয়ে জালনোট বিনিময় করছে এক শ্রেণির প্রতারক চক্র। বাবুই প্রকাশনী, পাললীক সৌরভ, শব্দভূমি ও পেণ্ডুলাম প্রকাশনীসহ বেশ কয়েকটি প্রকাশনী থেকে জাল নোট দিয়ে বই নিয়ে কেনার ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে। পেণ্ডুলাম প্রকাশনীর প্রকাশক রুম্মান তার্শফিক যুগান্তরকে বলেন, মেলায় এক শ্রেণির প্রতারক ঘুরে বেড়াচ্ছে। যারা জাল নোট দিয়ে বই কিনে নিচ্ছে। এতে প্রকাশকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আমার স্টলে দুটি এক হাজার টাকার নোট জাল পেয়েছি। ভিড়ের সময় এগুলো দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
জাল নোট দিয়ে বই কেনায় প্রতারক চক্রের কী লাভ হচ্ছে? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, দেড়শ’ বা দুইশ’ টাকার বই কিনে প্রতারক চক্র যদি এক হাজার টাকা দেয় তাহলে বাকি টাকা আমরা তো তাকে ফেরত দেই। আমরা তাকে যে টাকাটা ফেরত দেই তা তো জাল নয়, বৈধ ও সঠিক টাকা। ফলে দেড়শ’ বা দুইশ’ টাকার বই কেনার নাম করে তারা অবৈধ টাকাকে বৈধ করে নিয়ে যাচ্ছে।
বিক্রয়কর্মীদের নেই নির্দিষ্ট গেট
মেলায় আগত বইপ্রেমীদের কাছে পছন্দের বইটি তুলে দেন বিক্রয়কর্মীরা। তাই মেলায় বিক্রয়কর্মীদের প্রবেশ করতে হয় সবার আগে এবং যেতে হয় সবার পরে। বিক্রয়কর্মীদের জন্য বাংলা একাডেমি গেটপাস রাখলেও তা দেখিয়ে যে কোনো গেট দিয়ে প্রবেশের সুযোগ পান না তারা। ফলে বিড়ম্বনা পোহাতে হয় তাদের। ২০১৭ সাল থেকে বইমেলায় বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করছেন রূপা খানম। এ বছর তিনি চৈতন্য প্রকাশনীর (২৫০-২৫১নং স্টল) বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করছেন। গত চার বছর ধরে বইমেলায় কাজ করা রূপা যুগান্তরকে বলেন, গত সব বারের চেয়ে এবার সবই ভালো। কারণ জায়গা বেশি। কিন্তু একজন বিক্রয়কর্মী হিসেবে আমাদের একটা গেটপাস থাকে। পুরো মেলায় হয়তো চার পাঁচ হাজার বিক্রয়কর্মী হবে। গেটপাস থাকা সত্ত্বেও আমাদের বিভিন্ন গেটে হ্যারাজ হতে হয়। দুই দিন দেখা গেছে আমি একটা গেট দিয়ে ঢুকেছি, তারপর দিন আর ওই গেট দিয়ে আমাকে ঢুকতে দিচ্ছে না। আমাদের তো মেলা শুরু হওয়ার আগে ঢুকতে হয়। কখনও আবার ঢুকতে দিলেও অন্য গেট দিয়ে ঘুরে যেতে বলে। দেখা যাচ্ছে যে গেট দিয়ে আমার স্টল কাছে সে গেট দিয়ে ঢুকতে না দিয়ে দূরের গেট দিয়ে যাওয়ার জন্য বলে। তাই আমাদের জন্য যদি নির্দিষ্ট কোনো একটা গেট থাকত তাহলে এভাবে হয়রানির শিকার হতে হতো না।
ভিড় বাড়লেও বিক্রি কম
বাংলা একাডেমির আয়োজনে প্রতি বছরের মতো চলছে অমর একুশে বইমেলা। ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন বিকাল ৩টার পর থেকে লেখক, প্রকাশক ও পাঠকের আনাগোনায় মুখরিত মেলা প্রাঙ্গণ। মেলায় ঘুরে নিজেদের পছন্দের বই কেনেন অনেকে। তবে মেলায় আশানুরূপ বই বিক্রি হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা। তারা বলেছেন, মেলার শুরু থেকেই পাঠকদের আনাগোনা ভালোই। এখন ভিড় বাড়লেও বিক্রি তেমন বাড়েনি। সন্ধ্যার পর পাঠকের ভিড় বাড়ে কিন্তু তেমন বই বিক্রি হচ্ছে না।
মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্যসচিব ও বাংলা একাডেমির পরিচালক (বিক্রয়, বিপণন ও পুনর্মুদ্রণ বিভাগ) ড. জালাল আহমেদ জানান, মেলার সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছে পুলিশ, র্যাব, আনসার, বিজিবি ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। নিরাপত্তার জন্য মেলায় ২৫০টি সিসিক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। প্রবেশ ও বাহিরপথে পর্যাপ্ত সংখ্যক আর্চওয়ের ব্যবস্থা আছে। এছাড়া মেলা সম্পূর্ণ পলিথিন ও ধূমপানমুক্ত রাখা হয়েছে। মেলা প্রাঙ্গণ ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় নিরাপত্তার স্বার্থে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা রয়েছে। ২ ফেরুয়ারি থেকে মেলা শুরু হয়। ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন বিকাল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত মেলা খোলা থাকবে। ছুটির দিন বেলা ১১টা থেকে রাত ৯টা এবং ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত মেলা চলবে।
পাঠক লেখক প্রকাশক সবাই সন্তুষ্ট
প্রতি বছরই মেলার নিরাপত্তার ব্যাপারে বাংলা একাডেমি বেশ সজাগ থাকে। নিজস্ব সিকিউরিটি ফোর্সের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সহযোগিতাও আমরা নিয়ে থাকি। এ বছরও তিন শিফটে দেড় হাজার পুলিশ নিরাপত্তার কাজে সর্বক্ষণ নিয়োজিত আছেন। প্রবেশপথ এবং বহির্গমন পথে যেন শৃঙ্খলা থাকে, দর্শনার্থীরা যেন কোনো ধরনের হয়রানির শিকার না হয়ে নির্বিঘ্নভাবে মেলায় ঢুকতে এবং বের হতে পারে এ ব্যাপারে বেশ সচেতন আমরা। বিগত সময়ে মেলায় ঢোকা এবং বের হওয়ার বিড়ম্বনা ছিল। এ বছর আমরা অনেক বেশি ঢোকার এবং বের হওয়ার গেট করেছি। এতে করে সে বিড়ম্বনা এখন আর নেই। আমরা মেলাকে শুধু মেলা নয় একটি বিনোদন এবং স্বস্তির নিঃশ্বাসের জায়গা হিসেবে দর্শনার্থীদের উপহার দেয়ার চেষ্টা করেছি। মেলায় একটু পর পর বিশ্রামের ব্যবস্থা করেছি। চা-কফি এবং সুপেয় পানির প্রচুর ব্যবস্থা রেখেছি। আগে মোড়ক উন্মোচনের জায়গায় খুব বেশি ভিড় হতো। এ বছর দু’পাশেই আমরা মোড়ক উন্মোচনের ব্যবস্থা করেছি। ফলে ভিড় অনেক কম হচ্ছে। লিটন ম্যাগ চত্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দেয়ার দাবি ছিল। দাবি ছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মেলার পরিসর বাড়ানোর। আমরা সেগুলোও পূরণ করেছি।
এখন পর্যন্ত পাঠক, লেখক, প্রকাশক সবাই আমাদের আয়োজনে সন্তুষ্ট। তরুণ লেখকদের একটি অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়, প্রকাশকরা তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেন। এক্ষেত্রে আমাদের পরামর্শ হল- চুক্তি ছাড়া কখনোই কোনো প্রকাশকের সঙ্গে লেনদেন করবেন না। প্রমাণসাপেক্ষে কোনো অভিযোগ করলে আমরা সেই প্রকাশকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে আরেকটি কথা বলব- ধর্মীয় প্রকাশনার বিষয়ে আমরা সবসময় উদার-উন্মুক্ত মানসিকতা লালন করি। এখনও মেলায় অসংখ্য কোরআন-হাদিস, বাইবেল, গীতা, ধর্ম আলোচনার বই পাওয়া যাচ্ছে। তবে কাউকে আঘাত করে, ভিন্ন ধর্মকে কটাক্ষ করে, রাষ্ট্রকে হেয় করে বই লিখলে তা ধর্মের নামে হোক আর যে নামেই হোক তার অনুমতি আমরা অনুমোদিত কোনো প্রতিষ্ঠানই দিতে পারবে না।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী, মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমি
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
প্রাণের মেলায় জীবনের আলো
‘রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু বইখানা অনন্ত-যৌবনা, যদি তেমন বই হয়।’ ওমর খৈয়ামের এই বিখ্যাত মন্তব্যের মধ্যেই লুকিয়ে আছে বইয়ের চিরন্তনতার কথা।
বই একটি জাতিকে অন্ধকার থেকে আলোর পথ দেখায়। মার্কাস টুলিয়াস সিসারো বলেছেন, ‘বই ছাড়া একটি কক্ষ আত্মা ছাড়া দেহের মত।’ পৃথিবীর যতগুলো দেশ ও সভ্যতা উন্নতির চরম শিখরে উঠেছে তার নেপথ্যে ছিল জ্ঞান সাধনা। বই সেই জ্ঞানের ধারক ও বাহক। জ্ঞানকে বলা হয় শ্রেষ্ঠ সম্পদ। আর ঠিক সে কারণেই সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছিলেন, ‘বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না।’
একই প্রসঙ্গে, প্রতিভা বসু বলেছেন, ‘বই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ আত্মীয়, যার সঙ্গে কোনোদিন ঝগড়া হয় না, কোনোদিন মনোমালিন্য হয় না।’ তবে বর্তমানে পুঁজি ও প্রচারণার জোরে মানসম্মত বইয়ের চেয়ে নিুমানের বই নিয়েই বেশি উচ্চবাচ্য লক্ষ করা যাচ্ছে। বাংলা একাডেমির তথ্যমতে, এ বছর বইমেলায় ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মোট ২ হাজার ৩৪০টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
তবে বইয়ের মান নিয়ে প্রতি বছরের মতো এবারও প্রশ্ন রয়ে গেছে। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মাদ আজম যুগান্তরকে বলেন, বইমেলা উপলক্ষে বই লেখা ও প্রকাশ করার যে সংস্কৃতি এটা বইয়ের জন্য খারাপ সংস্কৃতি। এটা থেকে আমাদের সচেতনভাবে বেরিয়ে আসতে হবে। এক মাস বই বের হবে এবং লেখকেরা এ উপলক্ষে বই লিখবে এটা ভালো লক্ষণ নয়।
সবচেয়ে বড় পরিসরে বইমেলা
এবারের বইমেলা উৎসর্গিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতির প্রতি। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে বইমেলা ডানা মেলেছে পূর্বের চেয়ে বড় পরিসরে। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ এবং একাডেমির সামনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রায় ৮ লাখ বর্গফুট জায়গাজুড়ে এবার বসেছে বইমেলার পসরা। বাংলা একাডেমির উপ-পরিচালক কামাল উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে জানান, এবার একাডেমি প্রাঙ্গণে ১২৬টি প্রতিষ্ঠানকে ১৭৯টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৪৩৪টি প্রতিষ্ঠানকে ৬৯৪টি ইউনিট, মোট ৫৬০টি প্রতিষ্ঠানকে ৮৭৩টি ইউনিট এবং বাংলা একাডেমিসহ ৩৩টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে ৩৪টি প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
এ বছর লিটল ম্যাগাজিন চত্বর স্থানান্তরিত হয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মূল মেলা প্রাঙ্গণ। সেখানে ১৫২টি লিটলম্যাগকে স্টল বরাদ্দের পাশাপাশি ৬টি উন্মুক্ত স্টলসহ ১৫৮টি লিটলম্যাগকে স্টল দেয়া হয়েছে। একক ক্ষুদ্র প্রকাশনা সংস্থা এবং ব্যক্তি উদ্যোগে যারা বই প্রকাশ করেছেন তাদের বই বিক্রি/প্রদর্শিত হচ্ছে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের স্টলে। মেলা উপলক্ষে বাংলা একাডেমি ও মেলায় অংশগ্রহণকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ২৫% কমিশনে বই বিক্রি করছে। আর বিকাশে মূল্য পরিশোধ করলে পাঠক-ক্রেতারা আরও অতিরিক্ত ১০% ছাড় পাবেন।
জাল নোট চক্রের জালিয়াতি
জাল নোট চক্রের টার্গেটস্থল এখন মেলা। বই মেলায় প্রচুর ভিড় রয়েছে এমন দোকানে বই কিনতে গিয়ে জালনোট বিনিময় করছে এক শ্রেণির প্রতারক চক্র। বাবুই প্রকাশনী, পাললীক সৌরভ, শব্দভূমি ও পেণ্ডুলাম প্রকাশনীসহ বেশ কয়েকটি প্রকাশনী থেকে জাল নোট দিয়ে বই নিয়ে কেনার ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে। পেণ্ডুলাম প্রকাশনীর প্রকাশক রুম্মান তার্শফিক যুগান্তরকে বলেন, মেলায় এক শ্রেণির প্রতারক ঘুরে বেড়াচ্ছে। যারা জাল নোট দিয়ে বই কিনে নিচ্ছে। এতে প্রকাশকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আমার স্টলে দুটি এক হাজার টাকার নোট জাল পেয়েছি। ভিড়ের সময় এগুলো দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
জাল নোট দিয়ে বই কেনায় প্রতারক চক্রের কী লাভ হচ্ছে? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, দেড়শ’ বা দুইশ’ টাকার বই কিনে প্রতারক চক্র যদি এক হাজার টাকা দেয় তাহলে বাকি টাকা আমরা তো তাকে ফেরত দেই। আমরা তাকে যে টাকাটা ফেরত দেই তা তো জাল নয়, বৈধ ও সঠিক টাকা। ফলে দেড়শ’ বা দুইশ’ টাকার বই কেনার নাম করে তারা অবৈধ টাকাকে বৈধ করে নিয়ে যাচ্ছে।
বিক্রয়কর্মীদের নেই নির্দিষ্ট গেট
মেলায় আগত বইপ্রেমীদের কাছে পছন্দের বইটি তুলে দেন বিক্রয়কর্মীরা। তাই মেলায় বিক্রয়কর্মীদের প্রবেশ করতে হয় সবার আগে এবং যেতে হয় সবার পরে। বিক্রয়কর্মীদের জন্য বাংলা একাডেমি গেটপাস রাখলেও তা দেখিয়ে যে কোনো গেট দিয়ে প্রবেশের সুযোগ পান না তারা। ফলে বিড়ম্বনা পোহাতে হয় তাদের। ২০১৭ সাল থেকে বইমেলায় বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করছেন রূপা খানম। এ বছর তিনি চৈতন্য প্রকাশনীর (২৫০-২৫১নং স্টল) বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করছেন। গত চার বছর ধরে বইমেলায় কাজ করা রূপা যুগান্তরকে বলেন, গত সব বারের চেয়ে এবার সবই ভালো। কারণ জায়গা বেশি। কিন্তু একজন বিক্রয়কর্মী হিসেবে আমাদের একটা গেটপাস থাকে। পুরো মেলায় হয়তো চার পাঁচ হাজার বিক্রয়কর্মী হবে। গেটপাস থাকা সত্ত্বেও আমাদের বিভিন্ন গেটে হ্যারাজ হতে হয়। দুই দিন দেখা গেছে আমি একটা গেট দিয়ে ঢুকেছি, তারপর দিন আর ওই গেট দিয়ে আমাকে ঢুকতে দিচ্ছে না। আমাদের তো মেলা শুরু হওয়ার আগে ঢুকতে হয়। কখনও আবার ঢুকতে দিলেও অন্য গেট দিয়ে ঘুরে যেতে বলে। দেখা যাচ্ছে যে গেট দিয়ে আমার স্টল কাছে সে গেট দিয়ে ঢুকতে না দিয়ে দূরের গেট দিয়ে যাওয়ার জন্য বলে। তাই আমাদের জন্য যদি নির্দিষ্ট কোনো একটা গেট থাকত তাহলে এভাবে হয়রানির শিকার হতে হতো না।
ভিড় বাড়লেও বিক্রি কম
বাংলা একাডেমির আয়োজনে প্রতি বছরের মতো চলছে অমর একুশে বইমেলা। ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন বিকাল ৩টার পর থেকে লেখক, প্রকাশক ও পাঠকের আনাগোনায় মুখরিত মেলা প্রাঙ্গণ। মেলায় ঘুরে নিজেদের পছন্দের বই কেনেন অনেকে। তবে মেলায় আশানুরূপ বই বিক্রি হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা। তারা বলেছেন, মেলার শুরু থেকেই পাঠকদের আনাগোনা ভালোই। এখন ভিড় বাড়লেও বিক্রি তেমন বাড়েনি। সন্ধ্যার পর পাঠকের ভিড় বাড়ে কিন্তু তেমন বই বিক্রি হচ্ছে না।
মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্যসচিব ও বাংলা একাডেমির পরিচালক (বিক্রয়, বিপণন ও পুনর্মুদ্রণ বিভাগ) ড. জালাল আহমেদ জানান, মেলার সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছে পুলিশ, র্যাব, আনসার, বিজিবি ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। নিরাপত্তার জন্য মেলায় ২৫০টি সিসিক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। প্রবেশ ও বাহিরপথে পর্যাপ্ত সংখ্যক আর্চওয়ের ব্যবস্থা আছে। এছাড়া মেলা সম্পূর্ণ পলিথিন ও ধূমপানমুক্ত রাখা হয়েছে। মেলা প্রাঙ্গণ ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় নিরাপত্তার স্বার্থে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা রয়েছে। ২ ফেরুয়ারি থেকে মেলা শুরু হয়। ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন বিকাল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত মেলা খোলা থাকবে। ছুটির দিন বেলা ১১টা থেকে রাত ৯টা এবং ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত মেলা চলবে।
পাঠক লেখক প্রকাশক সবাই সন্তুষ্ট
প্রতি বছরই মেলার নিরাপত্তার ব্যাপারে বাংলা একাডেমি বেশ সজাগ থাকে। নিজস্ব সিকিউরিটি ফোর্সের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সহযোগিতাও আমরা নিয়ে থাকি। এ বছরও তিন শিফটে দেড় হাজার পুলিশ নিরাপত্তার কাজে সর্বক্ষণ নিয়োজিত আছেন। প্রবেশপথ এবং বহির্গমন পথে যেন শৃঙ্খলা থাকে, দর্শনার্থীরা যেন কোনো ধরনের হয়রানির শিকার না হয়ে নির্বিঘ্নভাবে মেলায় ঢুকতে এবং বের হতে পারে এ ব্যাপারে বেশ সচেতন আমরা। বিগত সময়ে মেলায় ঢোকা এবং বের হওয়ার বিড়ম্বনা ছিল। এ বছর আমরা অনেক বেশি ঢোকার এবং বের হওয়ার গেট করেছি। এতে করে সে বিড়ম্বনা এখন আর নেই। আমরা মেলাকে শুধু মেলা নয় একটি বিনোদন এবং স্বস্তির নিঃশ্বাসের জায়গা হিসেবে দর্শনার্থীদের উপহার দেয়ার চেষ্টা করেছি। মেলায় একটু পর পর বিশ্রামের ব্যবস্থা করেছি। চা-কফি এবং সুপেয় পানির প্রচুর ব্যবস্থা রেখেছি। আগে মোড়ক উন্মোচনের জায়গায় খুব বেশি ভিড় হতো। এ বছর দু’পাশেই আমরা মোড়ক উন্মোচনের ব্যবস্থা করেছি। ফলে ভিড় অনেক কম হচ্ছে। লিটন ম্যাগ চত্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দেয়ার দাবি ছিল। দাবি ছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মেলার পরিসর বাড়ানোর। আমরা সেগুলোও পূরণ করেছি।
এখন পর্যন্ত পাঠক, লেখক, প্রকাশক সবাই আমাদের আয়োজনে সন্তুষ্ট। তরুণ লেখকদের একটি অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়, প্রকাশকরা তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেন। এক্ষেত্রে আমাদের পরামর্শ হল- চুক্তি ছাড়া কখনোই কোনো প্রকাশকের সঙ্গে লেনদেন করবেন না। প্রমাণসাপেক্ষে কোনো অভিযোগ করলে আমরা সেই প্রকাশকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে আরেকটি কথা বলব- ধর্মীয় প্রকাশনার বিষয়ে আমরা সবসময় উদার-উন্মুক্ত মানসিকতা লালন করি। এখনও মেলায় অসংখ্য কোরআন-হাদিস, বাইবেল, গীতা, ধর্ম আলোচনার বই পাওয়া যাচ্ছে। তবে কাউকে আঘাত করে, ভিন্ন ধর্মকে কটাক্ষ করে, রাষ্ট্রকে হেয় করে বই লিখলে তা ধর্মের নামে হোক আর যে নামেই হোক তার অনুমতি আমরা অনুমোদিত কোনো প্রতিষ্ঠানই দিতে পারবে না।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী, মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমি