Logo
Logo
×

প্রতিমঞ্চ

ফার্মেসিতে সবচেয়ে বেশি বিক্রি গ্যাস্ট্রিকের নানা ধরনের ওষুধ

Icon

সাইফুল ইসলাম খান

প্রকাশ: ০৬ আগস্ট ২০১৮, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মানুষের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এসেছে। পাল্টে গেছে খাদ্যাভ্যাস থেকে শুরু করে ঘুমের রুটিনও। ধূমপান ও অ্যালকোহলে আসক্তি, সময়-অসময়ে ইন্টারনেটে পড়ে থাকাসহ নানা কারণে মানুষের জীবনধারা পাল্টে গেছে। যার বিরূপ প্রভাব পড়ছে স্বাস্থ্যের ওপর। সময়মতো খাবার গ্রহণ না করার ফলে পেটে জমছে গ্যাস, গ্যাসের মাত্রা বেড়ে গেলে নিচ্ছে মুঠি মুঠি ওষুধ। ফামের্সিতে গেলেই সুলভে মিলে গ্যাসের সমস্যা প্রশমিত করার ওষুধ। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই যখন তখন গ্যাসের ওষুধ সেবনে অজান্তেই শরীরের সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে। হাড় ক্ষয় থেকে শুরু করে ক্যান্সার পর্যন্ত ঘটে যেতে পারে এ ধরনের অনিয়ন্ত্রিত ওষুধ সেবনে।

খাদ্যাভ্যাস ও খাবার গ্রহণে অনিয়মের ফলে সারা দেশে গ্যাস্ট্রিকের রোগীর সংখ্যা বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। রোববার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের বাইরে সরেজমিনে দেখা গেছে রোগীদের দীর্ঘ লাইন। ২০ বছরের কম বয়সী ছেলে-মেয়ে থেকে শুরু করে ষাটোর্ধ বৃদ্ধ সব বয়সী শ্রেণী পেশার মানুষ দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়ার জন্য।

আদিবা ইয়াসমিন নামে এক তরুণী জানান, প্রচণ্ড গ্যাসের ব্যথায় এর আগেও তিনি চিকিৎসা নিয়েছেন। বাইরের ফাস্ট ফুড খাওয়া ও সময়মতো খাবার গ্রহণ না করার কারণে তার এ সমস্যা হয়েছে বলে জানান তিনি। বয়স্ক একজন রোগী দীর্ঘ লাইনের পাশেই রাখা বেঞ্চিতে বসে ছিলেন। নিজের দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হওয়ায় নাতিকে লাইনে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন তিনি। আলাপচারিতা কালে তিনি বলেন, তরুণ বয়সে তার এ ধরনের সমস্যা খুব একটা না থাকলেও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি গ্যাসের সমস্যা অনুভব করতে থাকেন। গ্যাস্ট্রিকের কারণে প্রচণ্ড বুকে ব্যথাও অনুভব করেন তিনি। হৃদরোগের আশঙ্কাও করেছিলেন, পরে ইসিজি করে নিশ্চিত হয়েছেন তিনি আসলে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যায় ভুগছেন।

অ্যাসিডিটিসহ পেটের নানা সমস্যার ভুক্তভোগী রোগীদের এখন নির্ভরতা বাড়ছে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধের ওপর। প্রতিদিন যে পরিমাণ রোগী অ্যাসেডিটি সমস্যার কারণে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন তার থেকেও বহুগুণ বেশি রোগী নিজে নিজেই ফার্মেসি থেকে কিনে নেন গ্যাসট্রোনমিক্যাল ট্যাবলেট। জানা গেছে, দেশে সর্বাধিক বিক্রিত ওষুধের তালিকায় রয়েছে গ্যাস্ট্রিকজনিত রোগের ওষুধ। শীর্ষ ওষুধ বিক্রির তালিকায় থাকা ১০টি ওষুধের মধ্যে ৬টিই গ্যাস্ট্রো-ইসোফ্যাজিল রিফ্লাক্স ডিজিজ (জিইআরডি) ক্যাটাগরির। সহজেই কিনতে পারায় অনেকেই এখন বাড়িতে এ জাতীয় ওষুধ সংরক্ষণ করেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই পপুলার ফার্মেসির ওষুধ বিক্রেতা মোহাম্মাদ আশীক যুগান্তরকে জানান, তাদের কাছে দিনে যে পরিমাণ মানুষ ওষুধ কিনতে আসেন তাদের প্রায় ৭০ ভাগই গ্যাসের ওষুধ নিয়ে থাকেন। আর ডাক্তারদের লেখা ব্যবস্থাপত্রের শতকরা ৮৫ ভাগেরও ওপরে গ্যাসের ওষুধ লেখা থাকে বলে জানান তিনি।

এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশে ওষুধ শিল্পের বর্তমান বাজার প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকার। আর ওষুধ শিল্পের গড় প্রবৃদ্ধি ১৯ শতাংশ হলেও গ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ওষুধের প্রবৃদ্ধি ২১ দশমিক ৯৫ শতাংশ। এ হার ও দেশের গ্যাস্ট্রিক রোগীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে এ জাতীয় ওষুধ বিক্রির পরিমাণ।

স্বাস্থ্যসেবা খাত নিয়ে কাজ করে এমন আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইএমএস হেলথ ও লংকাবাংলা গবেষণার প্রতিবেদন বলছে, ২০১৭ সালে দেশের বাজারে সর্বাধিক বিক্রিত ১০টি ওষুধের মধ্যে ৬টিই গ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ওষুধ। আর বেশি বিক্রিত এ ১০ ওষুধের মধ্যে টানা প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ স্থান এবং সপ্তম ও দশম স্থান দখল করেছে এ জাতীয় ওষুধ। সর্বাধিক বিক্রিত ওষুধের তালিকায় বাকি পঞ্চম স্থানে অ্যান্টিবায়োটিক, ষষ্ঠ স্থানে ইনসুলিন এবং অষ্টম ও নবম স্থানে রয়েছে অ্যান্টি-পাইরেটিক বা প্যারাসিটামল গ্রুপের জ্বরের ওষুধ।

তালিকায় সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের গ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ওষুধ সেকলো। গত বছর ওষুধটির বিক্রির পরিমাণ ছিল প্রায় ৩৭৭ কোটি টাকা। স্কয়ারের ৮০৪ ধরনের ট্যাবলেট, ক্যাপসুল, লিকুইড ও ইনজেক্টেবল ওষুধের মধ্যে সর্বোচ্চ উৎপাদন ও বিক্রি সেকলোরই। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা হেলথকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের গ্যাসের ওষুধ সার্জেল বিক্রি হয়েছে ২৯৫ কোটি টাকা, তৃতীয় অবস্থানে থাকা রেনাটা ফার্মার গ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ওষুধ ম্যাক্সপ্রো ২২৮ কোটি টাকা বিক্রি হয়েছে। ভ্যাকসিন উৎপাদনে বিখ্যাত হলেও গ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ওষুধ প্যানটোনিক্স বিক্রি করে ২১৬ কোটি টাকা কামিয়েছে ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস এবং স্কয়ারের অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ সেফ-৩ বিক্রি হয়েছে ১৫৫ কোটি টাকার।

এছাড়া নভো নরডিক্স কোম্পানির উৎপাদিত ইনসুলিন মিক্সমটার্ড বিক্রি হয়েছে ১৩৪ কোটি টাকা, এসকেএফ ফার্মার গ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ওষুধ লোসেকটিল বিক্রি হয়েছে ১২২ কোটি টাকা, বেক্সিমকোর অ্যান্টি-পাইরেটিক ওষুধ নাপা এক্সট্রা ১২১ কোটি টাকা, একই কোম্পানির একই কার্যকারিতার ওষুধ নাপা বিক্রি হয়েছে ১১৩ কোটি টাকা এবং অপসোনিন কোম্পানি ১০০ কোটি টাকা পেয়েছে গ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ওষুধ ফিনিক্স বিক্রি করে।

গ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ওষুধ উৎপাদনে শীর্ষে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য মতে, বর্তমানে মানুষের খাদ্যাভ্যাসে বেশ পরিবর্তন এসেছে। সাধারণ খাবারের পরিবর্তে অনেকেই এখন স্পাইসি খাবারের প্রতি ঝুঁকছে। এছাড়া অনিয়মিত খাবার গ্রহণসহ পেটে গ্যাস বৃদ্ধিকারক খাবার গ্রহণের ফলে অ্যাসিডিটি সমস্যা ক্রমেই বেড়ে চলছে। এসব কারণে এ ধরনের ওষুধের বিক্রির পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ওষুধ বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান লাজ ফার্মা লিমিটেডের ব্যবস্থাপক আনোয়ার হোসেন যুগান্তরকে বলেন, আর্থিক সচ্ছলতা বৃদ্ধির সঙ্গে মানুষের খাদ্যাভ্যাসেও পরিবর্তন এসেছে। মানুষ সাধারণ খাবার বাদ দিয়ে স্পাইসি খাবারে ঝুঁকছে। এসবের কারণে অ্যাসিডিটি সমস্যা তৈরি হচ্ছে। দেশের মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পাওয়াও গ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ওষুধ বিক্রি বাড়ার কারণ। গত বছর গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ আমাদের প্রচুর বিক্রি হয়েছে। তার মধ্যে ওমিপ্রাজল এবং পেন্টোপ্রাজল অনেক বেশি পরিমাণে বিক্রি হয়েছে।

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. স্বপন চন্দ্র ধর বলেন, আমাদের দেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষের গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা রয়েছে। এ কারণে বাজারে এ জাতীয় ওষুধের চাহিদা খুব বেশি। আর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তুলানমূলক কম থাকায় প্রেসক্রিপশন ছাড়াই যে কেউ এ ওষুধ কিনতে পারায়, রোগীরা সহজেই কিনে নিচ্ছেন। এসব কারণে এ ওষুধের বিক্রি বেশ বেশি।

ওষুধ নীতি অনুযায়ী গ্যাস্ট্রিকের বিভিন্ন গ্রুপের ওষুধ কিনতে প্রেসক্রিপশন প্রয়োজন হয় না। ফলে কোনো রকম অস্বস্তিবোধ করলেই রোগীরা ওষুধটি সেবন করেন। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এ ওষুধ সেবনের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ ক্যান্সারের চিহ্নগুলোকে লুকিয়ে ফেলে। এ কারণে রোগী বা ডাক্তার কেউই সহজে বুঝতে পারেন না যে, রোগীর ক্যান্সার হচ্ছে কী না। যার ফলে এ বিষয়ে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। টানা গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ সেবন করার বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ডা. চঞ্চল কুমার ঘোষ বলেন, টানা গ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ওষুধ সেবন করে আসলে হাড় ক্ষয় হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। যেটা হলে হাড় ভেঙে যেতে পারে। এছাড়া পাকস্থলিতে ক্যান্সারও হতে পারে।

 

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম