Logo
Logo
×

স্বজন সমাবেশ

স্বজন মুক্তগদ্য

মেঘ ডুবি ডুবি আঁধারের গল্প

Icon

গাজী তারেক আজিজ

প্রকাশ: ০৮ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

গ্রাম থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন একটা বাড়িতে এক বিধবা বৃদ্ধার বাস। বৃদ্ধাকে সবাই টুনির মা বলে ডাকে। যদিও টুনি নামে তার কোনো মেয়ে ছিল না। থাকারও কোনো কারণ নেই। কারণ বিয়ের পরপরই বৃদ্ধা মহিলার স্বামী রেঙ্গুন যায়। এই রেঙ্গুন হচ্ছে বার্মার রাজধানী। একটি শহর। যার নাম পরিবর্তিত করে রাখা হয় ইয়াঙ্গুন। আর দেশের নাম বার্মা হয়ে গেল মিয়ানমার। টুনির মার স্বামী অন্য অনেকের সঙ্গে রেঙ্গুন শহরে যাওয়ার পর থেকে আর হদিস মিলে না। যদিও টুনির মা স্বামীর খোঁজে লোক লাগায় কিন্তু স্বামীকে কাছে টানতে পারে না। একপর্যায়ে টুনির মা খবর পায় রেঙ্গুনে কোনো এক নারীকে বিয়ে করে সংসার পাতে। স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে বেশি সময় নেয় না। অন্তর্দাহ শুরু হয়। গুমরে কেঁদে মরে। লোকচক্ষুর অন্তরালে। তার কান্নার ধ্বনি সে অবধি পৌঁছে না। পৌঁছার কোনো শক্তি তার নেই। থাকার কোনো কারণও নেই। যদিও শক্তি সামর্থ্যে কোনো সক্ষম পুরুষও তার সঙ্গে পেরে উঠবে না!

তারপরও টুনির মা স্বামীর অপেক্ষায় থাকে। বাতাস ধীরে বয়। তার চুলে পাক ধরে। শরীর কুঁজো হতে শুরু করে। গ্রামের মাতবর কিছিমের লোক খায়ের, ফয়েজ তাকে বারবার মতলবি স্বপ্ন দেখায়। রঙিন স্বপ্ন। দিবা স্বপ্ন। রাতে সে অস্থিরবোধ করে। চাঁদ ওঠে। রূপালী চাঁদ। রূপকথার চাঁদ। যেই চাঁদ মাঝ সমুদ্রের জল অসীম শক্তিতে কূলে আছড়ে ফেলে। তবু সে ধীর। অধীর চোখের একজন সামর্থ্যবান মানুষের সঙ্গে যুগসন্ধিকালে কথার ফোড়ন দিয়ে কখনো ক্ষেপিয়ে তুলবে! কখনো আদরে আহ্লাদে ভাসিয়ে দেবে। এ যার তীব্র বাসনা সে বাসনায় মেঘ ডুবি ডুবি আঁধার নেমে আসে। তবুও স্বামীকে ফিরিয়ে আনতে তার কোনো দৃশ্যমান ভূমিকা নেই। দিনরাত মনে মনে জপে এ বুঝি এলো! আর আসে না। কেন আসে না প্রাণের স্বামী? সে কি পথ ভুলে যায়! নাকি পরাণের আবেগ তারে টানে না! যেমন করে শুষ্ক মৌসুমে বিপরীত স্রোতে দাঁড় টানার মতো নিজের মুখী করতে ব্যর্থ হয়। যে স্বামী তাকে কথা দিয়ে যায়। কথা রাখে না। টুনির মা স্বামীর দেওয়া প্রতিশ্রুতি ফিরিয়ে দিতে চায়। আলো আঁধারিতে কোনো এক ফয়েজকে আপন করে নেওয়ার আহ্বান তার কাছে অঙ্গভঙ্গির নিপুণ কৌশলে বারবার ফিরে ফিরে আসে। অথচ সে নির্বিকার ভঙ্গিতে ঠনঠনে মাটিতে কোদালের কোপের মতো ফিরিয়ে দেয় সেই গোপন আসক্তিভরা আবদার।

আজ মনে হচ্ছে সে ভুল করেছে। এ জীবন সায়াহ্নে তারও কথা বলার কেউ দরকার। স্বামী না থাকলেও শ্বশুরের রেখে যাওয়া সহায় সম্পদ একাই ভাগিদার হয়। এখন সেই অঢেল সম্পদও তার কাছে বিষফোঁড়ার মতো মনে হতে থাকে। তার অবর্তমানে এ সম্পত্তির কি হবে! কে ভোগ করবে? চিন্তায় পড়ে যায়। একদিকে স্বামীহীন সামাজিক সংকটময় জীবন। অন্যদিন লোলুপ দৃষ্টির কিছু মানুষের অতিমানবিক বিনয় লোকচক্ষুর আড়ালের কাসুন্দি যদি বলতে চায় সবাই বিশ্বাস করলেও তার প্রতিই থাকবে সন্দেহের ধারালো ফলা। আক্রমণে জর্জরিত হবে সে ভালো করেই জানে। সেসব কাউকে বলা হয় না। বলেও প্রতিকার নেই।

একা বাড়ি জীবনের উদ্বেল তাকে ছোঁয়ো না। এ জীবনের কোনো তাগিদ নেই। পূর্বাপর আস্থার সংকটও নেই। তারপরও টুনির মা স্বামীর অপেক্ষায় থাকে।

টুনির মায়ের কোনো সন্তান না থাকার পরও সবাই তাকে এই নামে ডাকার পেছনেও এক রহস্য কাজ করে। যেহেতু সংসারে আর কেউ নেই কোনো সদাই দরকার পড়লে প্রতিবেশী কিশোরী টুনিকেই ফরমায়েশ দিয়ে অনেক অনুনয় বিনয় করে কখনো পয়সা দিয়ে কার্যসিদ্ধি করতে হতো। আর টুনিও বৃদ্ধার বাড়িতেই বেশি সময় ধরে থাকত। বৃদ্ধাও টুনিকে নিজের মেয়ে বলেই সম্বোধন করত। দুজনের বোঝাপড়াটাও বেশ ভালো। সেই থেকে বৃদ্ধা টুনির মা হিসাবে পরিচিত হয়ে ওঠে।

টুনির বিয়ের সিংহভাগ খরচ বৃদ্ধা বহন করে। বিয়ের পর টুনি স্বামী নিয়ে বৃদ্ধার বাড়িতেই ওঠে। একে একে তারা একে অপরের পরিপূরক হয়ে যায়। বৃদ্ধাও টুনির শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে যায় মাঝে মধ্যে। বয়সের ভারে এখন আর শরীর চলে না।

এরই মধ্যে একটা আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটে যায়। টুনির মায়ের স্বামী বার্মা থেকে দেশে আসে স্ত্রী ও দুই সন্তানসহ। টুনির মা বুঝে উঠতে পারে না খুশি হবে না বেজার হবে। টুনির মায়ের স্বামী আর সতীনের বাচ্চারা বাড়িতে থাকা শুরু করে। টুনির মা একদিন সাত সকালে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। কিছুদূর গিয়ে একটা গাছের নিচে বসে বিশ্রাম নেয়। হাঁটতে হাঁটতে টুনির শ্বশুর বাড়িতে পৌঁছে যায়। টুনি কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে তার সেই ডাকা মাকে। কোনো প্রতিউত্তর পায় না। টুনির মা ক্লান্তিবোধ করে। ঘরে যায়। শোয়ার ঘরে খাটে গা এলিয়ে দিতেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়। টুনি খাবার রেডি করে। সবাই খাবার টেবিলে অপেক্ষমাণ। টুনি বারবার মাকে ডাকে। কোনো সাড়া শব্দ নেই। টুনি শেষমেশ কিছুটা চিৎকারের ভঙ্গিতে ডেকেও কোনো সাড়া পায় না। হাত দিয়ে নাড়া দিতেই কাত হয়ে পড়ে যায়। টুনি চিৎকার করে সবাইকে ডাকে। দৌড়ে আসে সবাই। কেউ নাকে হাত দেয়। কেউ চোখ খোলার চেষ্টা করে। লাভ হয় না। টুনির মা গভীর ঘুমে অতলে তলিয়ে যায়। চিরনিদ্রায়। এই নিদ্রা ভাঙাতে কেউ আর ডাকবে না। জীবনের যত আফসোস আর অতৃপ্তি স্বস্তির ঘুমে চুকে যায় একই সমীকরণের মহারণে।

হাসানপুর, ফেনী

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম