রক্তনালির প্রদাহজনিত সমস্যা ভাস্কুলাইটিস
ডা. আবুল হাসান মুহম্মদ বাশার
প্রকাশ: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ভাস্কুলাইটিস শব্দের অর্থ রক্তনালির প্রদাহজনিত সমস্যা। ‘সেরেব্রাল ভাস্কুলাইটিস’ মস্তিষ্কের রক্তনালির প্রদাহ। শরীরের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের রক্তনালিই প্রদাহজনিত সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারে।
উপসর্গ : উপসর্গ নির্ভর করে মূলত কোনো অঙ্গ আক্রান্ত তার উপর। যেমন-
* হাতে রক্ত সরবরাহকারী ধমনী আক্রান্ত হলে হাতে ব্যথা, ঘা বা গ্যাংগ্রিন হতে পারে।
* পায়ের ছোট ধমনী আক্রান্ত হলে আঙুলে ঘা বা গ্যাংগ্রিন হতে পারে।
* হাত পা বা শরীরের অন্যত্র বড় এলাকা জুড়ে লালচে ফোঁটা ফোঁটা দাগ হতে পারে।
* পাকস্থলী বা অন্ত্রের রক্তনালি আক্রান্ত হলে পেটে ব্যথা (বিশেষত খাবার পর) হতে পারে।
* কিডনির রক্তনালি আক্রান্ত হলে রোগী কিডনির জটিলতা নিয়ে আসতে পারে।
* চোখের রক্তনালি আক্রান্ত হলে চোখের সমস্যা হতে পারে।
* মস্তিষ্কের ভাস্কুলাইটিসে মাথাব্যথা, স্ট্রোক, কখনও আবার রোগী আপাত কোনো কারণ ছাড়া অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে।
* ফুসফুসের ভাস্কুলাইটিসে কাশির সঙ্গে রক্ত আসতে পারে, শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
শ্রেণীবিন্যাস
* ছোট রক্তনালির প্রদাহ (যে কোনো অঙ্গের ভেতরের ছোট ছোট রক্তনালি)।
* মাঝারি রক্তনালির প্রদাহ (পাকস্থলী, অন্ত্র, কিডনি, লিভারে রক্ত সরবরাহকারী মাঝারি ধমনী ও শিরা)।
* বড় রক্তনালির প্রদাহ (হৃৎপিণ্ড থেকে উৎপন্ন মহাধমনী ও তার শাখা-প্রশাখা)।
তাকায়াসু আর্টারাইটিস : শরীরের বড় ধমনীর প্রদাহজনিত সমস্যার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ ‘তাকায়াসু আর্টারাইটিস’। এ রোগে আক্রান্ত হয় মূলত হাতে রক্ত সরবরাহকারী সাবক্লাভিয়ান ধমনী ও মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহকারী ক্যারোটিড ধমনী। ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রায় ৫ গুণ বেশি। এক্ষেত্রে হাতে রক্ত সরবরাহকারী ধমনী সরু হতে হতে বন্ধ পর্যন্ত হতে পারে।
উপসর্গ : হাতে রক্ত সরবরাহকারী সাবক্লাভিয়ান ধমনী বন্ধ হয়ে গেলে হাত দিয়ে কাজ করতে গেলে হাতে ব্যথা অনুভূত হয়। রোগী হাতের আঙুলে ঘা বা গ্যাংগ্রিন নিয়ে আসতে পারে।
তাকায়াসু আর্টারাইটিসের একটা গুরুত্বপূর্ণ উপসর্গ হতে পারে মাথা ঘোরা, এমনকি মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া। হাত দিয়ে ভারী কাজ করার সময় এরকম হওয়ার আশঙ্কা বেশি। এই উপসর্গের নাম ‘ভার্টিব্রোব্যাজিলার স্টিল’।
তাকায়াসু আর্টারাইটিসে কদাচিৎ মহাধমনীর পেটের ভেতরকার অংশসহ শরীরের অন্যান্য বড় ধমনী আক্রান্ত হতে পারে। সে ক্ষেত্রে ওই অংশের ধমনীর সমস্যা সংক্রান্ত উপসর্গ প্রকাশ পায়।
জায়ান্ট সেল আর্টারাইটিস : এটি বয়স্কদের রোগ। বয়স ৫০-এর ওপরে না হলে সাধারণত এ রোগের আশঙ্কার কথা বিবেচনা করা হয় না। একে টেম্পোরাল আর্টারাইটিসও বলা হয়। এই রোগ পুরুষদের বেশি হয়। মাথাব্যথা, কপালের দু’পাশে চাপ দিলে ব্যথা এবং সেখানে চামড়ার নিচে দৃশ্যমান রক্তনালি দেখে একজন অনুসন্ধিৎসু মেডিসিন বিশেষজ্ঞের মনে এই রোগের সন্দেহ তৈরি হয়। রক্ত পরীক্ষায় রোগের প্রমাণ মেলে। কখনও কপাল থেকে রক্তনালির অংশ নিয়ে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে পরীক্ষা করে দেখার প্রয়োজন হয়।
সেরেব্রাল ভাস্কুলাইটিস : সব ভাস্কুলাইটিসের পেছনেই ‘অটো ইমিউনিটি’কে কারণ হিসেবে দায়ী করা হয়। অটো ইমিউনিটি এমন এক পরিস্থিতি যেখানে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিজের শরীরের অংশ বিশেষকেই শত্রু হিসেবে বিবেচনা করে। অটো ইমিউনিটি ছাড়াও জীবাণু সংক্রমণ, ক্যান্সার এবং কিছু ওষুধকে (বিশেষ করে হেরোইন, কোকেন বা অ্যামফেট্যামিন জাতীয় নেশাকারক ওষুধ) এ রোগের কারণ হিসেবে চিন্তা করা হয়। মাথাব্যথা, গিটে ব্যথা, ক্লান্তিবোধ, শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের বোধ শক্তি বা নাড়াচাড়ার ক্ষমতা কমে যাওয়া, চিন্তা ও আচার আচরণ এলোমেলো হয়ে যাওয়া, জ্ঞান হারান- এসব সেরেব্রাল ভাস্কুলাইটিসের লক্ষণ।
রোগ শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া : ভাস্কুলাইটিসের জন্য বিশেষ কিছু পরীক্ষা-নীরিক্ষা রয়েছে। এগুলো মূলত রক্ত পরীক্ষা। অনেক সময় এক্সরে, সিটি স্ক্যান, এমআরআই, অ্যানজিওগ্রামও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে পারে। কখনও কখনও আক্রান্ত অংশের টিস্যু নিয়ে পরীক্ষা করার প্রয়োজন হয়।
চিকিৎসা : ভাস্কুলাইটিসের চিকিৎসা খুব সন্তোষজনক নয়। এই চিকিৎসার কেবল একটা অংশ ভাস্কুলার সার্জনের হাত দিয়ে সম্পন্ন হয়। দীর্ঘমেয়াদে রোগীকে মূলত একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ বা রিউম্যাটোলজিস্টের চিকিৎসাধীন থাকতে হয়। রোগ শনাক্ত হলে বিশেষ কিছু ওষুধ দীর্ঘদিন সেবন করতে হয়। স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ এই চিকিৎসার প্রথম অস্ত্র। অন্যান্য ওষুধও ধাপে ধাপে প্রয়োগ করা হয়। ছোট ধমনীর ভাস্কুলাইটিসে ওষুধই একমাত্র চিকিৎসা। ভাস্কুলাইটিসের কারণে বড় বা মাঝারি আকারের ধমনীতে ব্লক দেখা দিলে তার চিকিৎসায় রক্তনালি বিশেষজ্ঞ অংশগ্রহণ করেন। এ চিকিৎসা মূলত পেরিফেরাল ভাস্কুলার ডিজিজে আক্রান্ত অন্যান্য ধমনীর মতোই, অর্থাৎ অ্যানজিওপ্লাস্টি অথবা বাইপাস। তবে এক্ষেত্রে চিকিৎসার সময়টা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এসব রোগী সব সময় অপারেশন বা অ্যানজিওপ্লাস্টির জন্য উপযুক্ত হন না।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল। বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতাল, শ্যামলী, ঢাকা
