Logo
Logo
×

সুস্থ থাকুন

আগামীকাল বিশ্ব হার্ট দিবস

হার্টের সুস্থতায়

‘Be a heart hero’ অর্থাৎ ‘হার্ট হিরো হোন’-এটি এ বছর বিশ্ব হার্ট দিবসের স্লোগান। ওয়ার্ল্ড হার্ট দিবস ২০১৯ (ডাব্লিউএইচডি) হার্ট হিরোসের একটি বিশ্ব সম্প্রদায় তৈরি করার দিকে মনোনিবেশ করেছে। কার্ডিওলজি নিয়ে গবেষণা এবং হার্টের রোগীদের স্বাস্থ্যসেবায় জড়িত পেশাদার থেকে শুরু করে সব মানুষ হার্টের যত্ন নিচ্ছেন এবং চেষ্টা করছেন কীভাবে সবাই হার্ট হিরো হতে পারে। লিখেছেন- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট অধ্যাপক ডা. এস এম মোস্তফা জামান

Icon

প্রকাশ: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

হৃদরোগীদের অনেক প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে দিয়ে দিনরাত কাটাতে হয়। চিকিৎসকের অ্যাপয়েনমেন্ট, চেম্বারের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং কারও কারও হাসপাতালে দিনের পর দিন ভর্তি থাকতে হয়। কারও হৃৎপিণ্ডে রিং পরানো বা ছুরি-কাঁচি চালাতে হয়। সবকিছু জয় করে একজন বীরের মতোই তাকে বাঁচার চেষ্টা করতে হয়। তাই প্রতিটি হৃদরোগীই একজন নায়ক। নায়ক যেমন কল্যাণ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করেন। রোগীও তেমনি নিজেকে সুস্থ করার জন্য অদম্য স্পৃহার মাধ্যমে কল্যাণের প্রতীক হয়ে ওঠেন।

হৃদরোগের জন্য ধূমপান বা তামাক ব্যবহার অত্যন্ত ক্ষতিকর, তাই ধূমপান ত্যাগ হৃদরোগ প্রতিরোধের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। ৩০ মিনিটের জন্য নিয়মিত শারীরিক অনুশীলন করা হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে এবং স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখার সঙ্গে শারীরিক ক্রিয়াকলাপের সংমিশ্রণ করা আরও বেশি উপকার যুক্ত করে। কিছু খাবার রয়েছে যা উদ্ভিদের ফলের মতো গোটা দানা জাতীয় খাবার, স্বল্প চর্বিযুক্ত দুগ্ধজাতীয় খাবার, মাছ, ত্বকবিহীন মুরগি, ডিম, বাদাম, বীজ এবং তেল জাতীয় সয়াবিন তেল এবং সূর্যমুখী তেলের মতো বহু-সংশ্লেষিত চর্বিযুক্ত ক্ষতিকারক খাবার হিসেবে বিবেচিত হয় অতিরিক্ত লবণযুক্ত খাবার, স্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং ট্রান্স ফ্যাট এবং আচারযুক্ত এবং প্রক্রিয়াজাত খাবারগুলো এড়ানো উচিত।

হৃদরোগ প্রতিরোধের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা। ১৮ বছর বয়সে শুরু হওয়া উচিত নিয়মিত রক্তচাপের স্ক্রিনিং, কোলেস্টেরল স্তর এবং ডায়াবেটিস রোগীদেরও নিয়মিত ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা।

মানুষের মৃত্যুর অন্যতম কারণ হল হৃদরোগ। প্রতি বছর বিশ্বে যে পরিমাণ লোক মারা যায় তার ৩১ শতাংশ মারা যাচ্ছে হৃদরোগে। এখন যে হারে হৃদরোগ হচ্ছে, তাতে আগামী ২০৩০ সালে বিশ্বে ২৩ মিলিয়ন লোক মারা যাবে। হৃদরোগের বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে নিু ও মধ্যম আয়ের দেশগুলো। ভৌগোলিক কারণে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ, ভারতসহ অন্য অঞ্চলে হৃদরোগের ঝুঁকি বেশি। কারণ আমাদের দেশের মানুষ অল্প বয়সে ধূমপান করে, চর্বিযুক্ত খাবার বেশি খায়। কোন খাবার স্বাস্থ্যকর আর কোনটা অস্বাস্থ্যকর সে বিষয়ে আমাদের দেশের অনেকেরই ধারণা কম। ভৌগোলিক কারণে এ দেশের মানুষের উচ্চতা কম, এর ফলে তাদের হার্টের করোনারি আর্টারি (ধমনি) সরু থাকে, যাতে অল্পতেই কোলেস্টেরলে বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়।

পুরুষ-নারীতে হার্ট অ্যাটাকের রকমফের

পুরুষ

* পুরুষের ক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাকের সময় বুকে সাধারণত প্রচণ্ড ব্যথা হয়।

* বাঁ হাত বা চোয়ালে ব্যথা অনুভূত হয়।

* শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সমস্যা দেখা দেয়।

নারী

* নারীদের ক্ষেত্রে কখনও কখনও পুরুষের মতো একই লক্ষণ দেখা দিতে পারে।

* নারীদের হার্ট অ্যাটাকের ব্যথা দেহের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ব্যথা ছড়িয়ে পড়তে পারে কাঁধ, ঘাড়, হাত ও তলপেটে। এই ব্যথা সব সময় নাও থাকতে পারে।

প্রথমবার হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত পুরুষদের তুলনায় নারীদের মৃত্যুর হার বেশি।

হৃদরোগের জন্য ছয়টি নিয়ন্ত্রণযোগ্য ঝুঁকির কারণ এবং কীভাবে প্রতিরোধ করা যায়

যদিও জেনেটিক্সের মাধ্যমে আপনার পিতামাতার কাছ থেকে কিছু সমস্যা চলে আসতে পারে, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করলে কিছু রোগ হওয়ার আশঙ্কা হ্রাস করতে পারে।

হৃদরোগ হওয়ার অসুবিধাগুলো কমাতে আপনি যে কয়েকটি বিষয় নিয়ে কাজ করতে পারেন-

* ধূমপান ও তামাক ব্যবহার করবেন না- সিগারেটের ধোঁয়া আপনার হার্ট এবং রক্তনালিগুলোকে সংকীর্ণ করে এবং রক্তের পক্ষে আপনার অঙ্গে অক্সিজেন এবং পুষ্টি সরবরাহ করতে শক্ত করে তোলে। শুধু ধূমপান ছেড়ে দিলে পঞ্চাশ শতাংশ হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি হ্রাস হতে পারে।

* চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত অ্যান্টিহাইপারটেনশন ওষুধ খাওয়া বন্ধ করবেন না- এটি আজীবনের রোগ। উচ্চ রক্তচাপের কোনো সতর্কতা সংকেত নেই, তাই প্রত্যেকেরই নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা করা উচিত। শারীরিক ক্রিয়াকলাপ বাড়িয়ে, স্বাস্থ্যকর খাবার পছন্দ করে এবং স্বাস্থ্যকর ওজন ধরে রাখার মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপ হ্রাস করা যায়। যদি চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ বন্ধ করেন তবে এটি স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক বা কিডনি রোগের কারণ হতে পারে।

* সপ্তাহের বেশিরভাগ দিনে প্রায় ৩০ মিনিট ব্যায়াম করুন- শারীরিক ক্রিয়াকলাপ ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে এবং উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কোলেস্টেরল এবং ডায়াবেটিসের মতো পরিস্থিতি তৈরির আশঙ্কা হ্রাস করতে সহায়তা করে। নিয়মিত শারীরিক কার্যকলাপ স্ট্রেস থেকে মুক্তিও দেয় এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। সপ্তাহের বেশিরভাগ দিনে ৩০ মিনিটেরও বেশি সময় ধরে মধ্যপন্থী বায়বীয় অনুশীলন করুন। প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে তিনবার অনুশীলন করুন এবং টানা দুই দিনের বেশি বিশ্রাম নেবেন না। অন্য কোনো contraindication না থাকলে পেশি শক্তিশালীকরণ ব্যায়াম প্রতি সপ্তাহে ২-৪ বার একসঙ্গে করা উচিত।

* কোলেস্টেরল সর্বদাই ক্ষতি করে- কিছু কোলেস্টেরল খাবার থেকে আসে। ফ্যাট এবং কোলেস্টেরল কম খাবার খাওয়ার মাধ্যমে আমরা আমাদের দেহে খারাপ কোলেস্টেরলের পরিমাণ হ্রাস করতে পারি। প্রাপ্তবয়স্কদের সাধারণত ৪০ বছর বয়সে প্রতি বছর কমপক্ষে একবার তাদের কোলেস্টেরল পরিমাপ করা উচিত।

* স্থূলতা একাধিক স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকির সঙ্গে যুক্ত। পুরুষদের কোমর পরিমাপ ৪০ ইঞ্চি (১০১.৬ সেন্টিমিটার বা সেমি)-এর বেশি হলে সাধারণত ওজন বেশি বলে বিবেচিত হয়। মহিলাদের কোমর পরিমাপ ৩৫ ইঞ্চি (৮৮.৯ সেমি)-এর বেশি হলে সাধারণত ওজন বেশি হয়। ওজন ৩ থেকে ৫ শতাংশ হ্রাস করলে ট্রাইগ্লিসারাইড এবং রক্তে শর্করা (গ্লুকোজ) এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি হ্রাস করতে সহায়তা করে।

* ডায়াবেটিসের যত্ন নিন- ডায়াবেটিস হলে ইনসুলিনের অভাবজনিত কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন এবং ফ্যাট বিপাকের সমস্যা হয়। ডায়াবেটিস হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলতে পারে। যদি ওজন স্বাভাবিক হয় এবং আপনার মধ্যে টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকির কারণ না থাকে তবে আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশন ৪০ বছর বয়সে স্ক্রিনিং শুরু করা এবং প্রতি বছর আবার পরীক্ষা করার পরামর্শ দেয়।

হার্ট সতেজ রাখতে খাদ্যাভ্যাসে ৫টি পরিবর্তন প্রয়োজন

পুষ্টি ফাউন্ডেশনের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, মানুষের দেহের অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটি অনুজীব মাইক্রোবায়োম যদি সুস্থ থাকে এবং কোমরের আকার যদি খুব বেশি বেড়ে না যায়, পাশাপাশি রক্তচাপ ও কোলেস্টেরলের মাত্রা কম রাখা যায় তাহলেই হৃদরোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।

আঁশযুক্ত খাবার বেশি করে খান

এসব খাবারের কারণে শরীরে স্বাস্থ্যকর ব্যাকটেরিয়া তৈরি হয়।

কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে সাহায্য করে এই ব্যাকটেরিয়া।

বেশি আঁশ আছে এরকম সবজির মধ্যে রয়েছে শিম ও মটরশুঁটি জাতীয় সবজি, কলাই ও ডাল জাতীয় শস্য এবং ফলমূল।

আলু এবং শেকড় জাতীয় সবজি খোসাসহ রান্না করলে সেগুলো থেকেও প্রচুর আঁশ পাওয়া যায়।

হোলগ্রেইন আটার রুটি এবং বাদামি চাল খাবারও পরামর্শ দেয়া হয়।

স্যাচুরেটেড ফ্যাট বা জমাট-বাঁধা চর্বি জাতীয় খাবার কমিয়ে ফেলুন

চিজ, দই, লাল মাংস, মাখন, কেক, বিস্কুট ও নারিকেল তেলে প্রচুর পরিমাণে স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে।

হৃদরোগ প্রতিরোধ করতে হলে স্যাচুরেটেড নয় এমন চর্বি (যেসব খাবারের ওপর চর্বি জমাট বাঁধে না) সে ধরনের খাবার খেতে হবে।

তেল সমৃদ্ধ মাছ, বাদাম ও বীজ। অলিভ, রেপসিড, সানফ্লাওয়ার, কর্ন এবং ওয়ালনাট তেল দিয়ে রান্নার বিষয়ে জোর দেয়া হয়।

দুধের বেলায় স্কিমড বা সেমি-স্কিমড (দুধ থেকে চর্বি সরিয়ে নেয়া) দুধ খেতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে খাবারে যাতে বাইরে থেকে চিনি মেশানো না থাকে। লাল মাংসের বদলে খেতে হবে মুরগির মাংস। মুরগির চামড়া তুলে ফেলে দিন। গরুর মাংস খেলে তার ওপর থেকে চর্বি ফেলে দিয়ে রান্না করতে হবে।

সপ্তাহে অন্তত একদিন এমন মাছ খেতে হবে যাতে প্রচুর তেল আছে। বিস্কিটের বদলে নানা ধরনের বাদাম ও বীজ খেতে পারেন।

লবণকে বিদায় জানান

লবণ বেশি খেলে শরীরে রক্তচাপ বেড়ে যায়। এর ফলে বৃদ্ধি পায় হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকিও। দিনে সর্বোচ্চ ৬ গ্রাম (এক চা চামচের পরিমাণ) লবণ খাওয়া যেতে পারে। লবণ কম-বেশি খাওয়া একটি অভ্যাসের ব্যাপার। লবণের পরিবর্তে মসলা দিয়ে খাবার প্রস্তুত করলে তা হৃদরোগের ঝুঁকি কমাবে।

ভিটামিন ও মিনারেল সমৃদ্ধ খাবার খান

ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং পটাশিয়ামের মতো খনিজ উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধ করে। এসবের জন্য ট্যাবলেটের ওপর নির্ভর করতে হবে না। তবে তার মধ্যে ব্যতিক্রম হচ্ছে ভিটামিন ডি।

কারও শরীরে ভিটামিন ও মিনারেলের অভাব থাকলে যেসব খাবার খাওয়া প্রয়োজন।

প্রতিদিন পাঁচটি ফল বা সবজি খাওয়া। ছোট্ট এক গ্লাস জুস। শিম ও ডাল জাতীয় শস্যও খেতে পারেন। বাদাম ও বীজ জাতীয় খাবারে থাকে ভিটামিন ই। মাছ, দুগ্ধজাত খাবার ও হোলগ্রেইনে পাওয়া যায় ভিটামিন বি। কলা, আলু এবং মাছে আছে পটাশিয়াম। ডাল ও হোলগ্রেইনে ম্যাগনেসিয়াম। দুগ্ধজাত খাবার ও সবুজ পাতার সবজি থেকে পাওয়া যায় ক্যালসিয়াম।

বেশি মোটা হলে ক্যালরি কমিয়ে দিন

হৃদরোগের ঝুঁকি কমিয়ে দেয়ার জন্য উপরের চারটি ধাপ অনুসরণ করলেই আপনি অনেক দূর অগ্রসর হয়েছেন।

মোটা হলে তা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। বিশেষ করে কোমরে চর্বি জমা হলে।

পুরুষের কোমর যদি ৩৭ ইঞ্চি আর নারীর কোমর ৩১ দশমিক ৫ ইঞ্চির বেশি হয় তাহলে ওজন কমাতে হবে।

ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে ওজন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

পর্যাপ্ত ঘুমান এবং মানসিক চাপ কমিয়ে আনুন

যে ব্যক্তিরা পর্যাপ্ত ঘুমান না তাদের স্থূলত্ব, উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট অ্যাটাক, ডায়াবেটিস এবং হতাশার ঝুঁকি বেশি থাকে। শারীরিক ক্রিয়াকলাপ, শিথিলকরণ অনুশীলন বা ধ্যান স্বাস্থ্যের উন্নতিতে সহায়তা করতে পারে।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম