ডায়াবেটিক রোগীদের রোজায় সতর্কতা
অধ্যাপক ডা. খাজা নাজিম উদ্দীন
প্রকাশ: ০৮ মে ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
রোজা রাখার কোনো নিষেধ নাই। কারও কারও জন্য ঝুঁকি বেশি থাকতে পারে। যেমন-
* অ্যাডভান্সড কিডনি রোগ যাদের ডিহাইড্রেশন হলে বিপজ্জনক
* হার্টের রোগী যারা দিনে আট-দশটা ওষুধ খায়
* অনেক বেশি সুগার। ফলে জটিলতার ভয় থাকে
* সম্প্রতি ডায়াবেটিসের জটিলতা নিয়ে চিকিৎসা নিতে হয়েছে (যেমন কিটোএসিডসিস)
* গর্ভবতীর রোজা রাখা ঠিক না
* বারবার ইনসুলিন নিলে বা অন্য ওষুধ নিলে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হওয়ার আশংকা থাকলে
* সতর্ক না হলে স্তনদাতা মায়ের জন্যও রোজা বিপজ্জনক
রোজার মাসে খাবার
খাওয়ার বিশেষ কোনো নিষেধ নাই। আমরা অন্য সময় যা খাই তাই খেলে সমস্যা হতো না। রোজার সময় বিশেষ খাবার খাই বলেই সমস্যা হয়। ইফতারের প্রথম অর্থাৎ রাতের প্রথমার্ধে দিনের খাবারের অধিকাংশটুকু খেয়ে ফেলি, ৬ বারের খাবার ৩ বারে সারতে হয়। মিষ্টি জাতীয় খাবারও বেশি খাওয়া হয়। ক্যালরি ঠিক রেখে খেতে পারলেই হল। নাশতা যদি ইফতার হয় ডিনার যদি সাহরি হয় তারাবির পর যদি লাঞ্চ করি তাতে সমস্যা নাই। সমস্যা হল কেউ কেউ ইফতারেই রাতের খাবার সেরে নেন; অনেকেই শেষ রাতে কিছু খান না বরং ইফতারের পর থেকে সাহরি পর্যন্ত এটা-ওটা (স্ন্যাক্স) খেয়ে কাটিয়ে দেন। শেষ রাতে খেতে হবে রেগুলার খাবার। রোজাদারের জন্য মিষ্টি বাদ দিতে হবে। চর্বি জাতীয় খাবার ও ভাজাপোড়া কম খেতে হবে। ভাজাপোড়ায় তেল/চর্বি বেশি (চর্বিতে ক্যালরি বেশি)। ভূরিভোজ চলে না। বারবার কম করে খাওয়া ভালো। রোজার দিনে খাবারের পরিমাণ, মেন্যু, সময় সবই বদলায়।
ফল
সবার জন্য ফল খাওয়া ভালো। ডায়াবেটিস রোগীর প্রতিদিন একটা মিষ্টি ফল খাওয়া উচিত। টক ফল খাওয়া খুব ভালো। ফলে ফ্রুক্টোজ থাকে। ফ্রুক্টোজ স্বাদে চিনির মতো মিষ্টি কিন্তু এতে গ্লুকোজ নেই। যে ফলে যত বেশি ফ্রুক্টোজ ডায়াবেটিস রোগীর জন্য সেটা তত ভালো। রোজার দিনে আমাদের খেজুর খাওয়ার অভ্যাস। খেজুর নিষেধ নয়। পরিমাণ (প্রতিদিন ১/২টি) ঠিক রেখে খেলে বরং উপকার।
রোজার দিনে ডাক্তারের দায়িত্ব
* রোগীর রোজা রাখার সামর্থ্য আছে কিনা যাচাই করা
* রোজার সম্ভাব্য জটিলতা ও তার সমাধানের ধারণা দেয়া
* রোজা রেখে ব্লাড গ্লুকোজ পরীক্ষা করা যায় কিনা তার ধারণা দেয়া
* ওষুধ ও ব্যায়াম সম্পর্কে ধারণা দেয়া
* সঠিক সহজ ডোজের ট্যাবলেট বাতলে দেয়া
রোজাদারের কী কী সমস্যা হতে পারে
ডিহাইড্রেশন : পানি কম খাওয়া, অপরিমিত কায়িক শ্রম, ওষুধ ইত্যাদির কারণে পানিস্বল্পতা হওয়ার আশংকা থাকলেও বাস্তবে কম হয়। রাতের বেলা পানি খেতে হবে। ফজরের আজানের আগ পর্যন্ত পানি খাওয়া যেতে হবে। দিনের প্রথমভাগে কাজ বেশি করা যেতে পারে। রোজার শুরুতে সমস্যা হলেও পরের দিকে অ্যাডজাস্ট হয়ে যায়।
হাইপোগ্লাইসেমিয়া (হাইপো) : সুগার অনেক কমে গেলে কিছু উপসর্গ দেখা দেয়। স্বাভাবিক মানুষের গ্লুকোজ ২.৫ মিলিমোল বা তার কম হলেও হয়। যারা ডায়াবেটিসের ওষুধ খান তাদের ৩.৫ হলেই হাইপোগ্লাইসেমিয়া হয়। ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তের পরিমাণ দেখার চেয়ে উপসর্গ দিয়েই হাইপো বিবেচনা করতে হয়।
ভীতি থাকলেও পরিসংখ্যান আমাদের ধারণাকে সমর্থন করে না। রোজা রাখলেই হাইপো হবে এ ধারণা ঠিক না। ডায়াবেটিসের ওষুধ না খেলে হাইপো হয় না। সব ওষুধে হাইপো হওয়ার আশংকা সমান নয়। ১২-১৪ ঘণ্টা না খেয়ে থাকলেও কারও হাইপোগ্লাইসেমিয়া হয় না। যারা সালফোনিলুরিয়া ট্যাবলেট খান ও ইনসুলিন নেন তাদের হাইপো হওয়ার আশংকা অনেক বেশি। তাই ওষুধ ও ডোজ অ্যাডজাস্টমেন্ট করতে হয়। সন্দেহ হলে আঙ্গুল থেকে রক্ত পরীক্ষা করতে হবে। নিশ্চিত হলে মিষ্টি খেয়ে নিতে হবে। রাতের শেষ ওয়াক্তে সাহেরি খেতে হবে। ইফতারে ভূরিভোজ আর সাহরিতে লাইট খাবার বা নো খাবারের অভ্যাস বাদ দিতে হবে। দিনের বেলায় যতটা সম্ভব কায়িক শ্রম কমাতে হবে। তারাবিতে কায়িক শ্রম ধরেই দিনের ব্যায়ামের পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে।
কিটোএসিডোসিস, হাইপারঅসমলার স্টেট/হাইপোগ্লাইসেমিয়া : ডিহাইড্রেশন একটা বড় ফ্যাক্টর বিশেষ করে বয়স্ক লোকদের। হাইপোগ্লাইসেমিয়ার ভয়ে ওষুধ অনেকেই বাদ দেন বা অনেকে অযৌক্তিক কমিয়ে দেন। পরিশ্রম কম করে বিধায় সুগার বেশি হয়ে যায়। গ্লুকোজসমৃদ্ধ খাবার এবং পার্টি ভোজন কম করা ভালো। মাত্রাতিরিক্ত সুগার (হাইপোগ্লাইসেমিয়া) কমাতে ফাইন সুগার কম খেতে হবে। কমপ্লেক্স শর্করা (রুটি, ভাত) ও শাক-শবজি, ডাল, ফল এবং আঁশসমৃদ্ধ খাবার বেশি খেতে হবে।
খাদ্যনালির সমস্যা : ইফতার ও সাহরিতে অনভ্যস্ত খাবার ও রাস্তাঘাটের খাবার এটার কারণ। সারাদিন খালি থাকা খাদ্যনালি সবকিছু সহ্য নাও করতে পারে। কিছু কিছু ওষুধও বাদ দেয়া লাগতে পারে। বমি, পাতলা পায়খানা হলে সোডিয়াম পটাশিয়াম কমে যাওয়ার ও প্রস্রাব কমে যাবার আশংকা থাকে।
রোজার দিনে রক্ত পরীক্ষা : রোজার তিনমাস আগে থেকেই গ্লুকোজ কন্ট্রোল থাকলে একমাসে কিছু হওয়ার কথা নয়, অযৌক্তিক কিছু না করলে। বাংলাদেশ, মিসর, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশের আলেমদের মতানুযায়ী আঙ্গুল থেকে রক্ত পরীক্ষা করলে রোজা ভাঙে না। যার গ্লুকোজ কন্ট্রোলে নাই সাহরির দু’ঘণ্টা পরে, ইফতারের আগে, ইফতারের দু’ঘণ্টা পরে এক/একাধিকবার রক্ত পরীক্ষা করতে হয়। নাশতার আগে ৬ মিলিমোল ও খাওয়ার পরে ৮-১০ মিলিমোল টার্গেট করতে হবে। বিকাল ৫টার দিকে ৪ মিলিমোল কম হলে অন্য যে কোনো সময় ৩০০ মিলিগ্রাম (১৬.৭ মিলিমোল)-এর বেশি হলে রোজা ভেঙে ফেলা ভালো। হাইপোগ্লাইসেমিয়ার উপসর্গ হলে সুগার পরীক্ষা করে কনফার্ম করতে হবে, নিয়মমাফিক রোজা ভাঙতে হবে।
ওষুধ নিয়মিতকরণ : সহজতর হল সকালের ওষুধটা সন্ধ্যায় অর্থাৎ ইফতারের পানি পান করে ওষুধ নিলে হয়। বাকিটা রাতে ভাগ করে খেয়ে নিলেই হল।
ইনসুলিন : যারা দিনে দুই ডোজ নেন তারা সকালেরটা সন্ধ্যায় নেবেন। মনে রাখা সহজ হল ইফতার অর্থ নাশতা আমরা রোজার দিনে নাশতা করি সন্ধ্যায় তাই অন্য দিনের নাশতার ডোজটা ইফতারে (নাশতায়) নিলেই হল। দ্বিতীয় ডোজটা শেষরাতে নিলেই হল। (প্রেসক্রিপশনের প্রথম ওষুধ প্রথম রাতে, শেষের ওষুধ শেষরাতে)। তবে সতর্কতা হল ইফতারের পানি পান করে ওষুধ খেতে/ইনজেকশন নিতে হবে; ইনজেকশন নিয়ে আগে খেতে হবে, খাওয়ার পর নামাজ; নামাজ পড়ে এসে খাবার নয় (হাইপোগ্লাইসেমিয়া ঠেকানোর জন্য)। রোজার প্রথম দিকে দ্বিতীয় ডোজটা অর্ধেক নেয়া যেতে পারে। ৪-৫ দিন পরে সাহরির পর (সকাল ৮-১০টা) সুগার পরীক্ষা করে দেখতে হবে। যদি রক্তে সুগার ১০-এর বেশি থাকে শেষ রাতের ইনসুলিন বাড়াতে হবে। বাস্তবতা হল যেসব রোগীর ইনসুলিন ছাড়া কন্ট্রোল হয় না তাদের ডোজ কমানো দরকার পরে না। ইদানীং একবেলা দিলে হয় অর্থাৎ একবার দিলে সারা দিন রক্তে থাকে এমন ইনসুলিন পাওয়া যায়। ডেগ্লুডেগ (ট্রেসিবা এ রকম ওষুধ), গ্লারজিন, লিভেমিরও অনেকটা এরকম। লিরাগ্লুটাইড ইনসুলিনের ভেঙে যাওয়াটা কমায় তাই অনেকটা এমন। এসব ওষুধ শেষ রাতে দিয়ে অন্য বেলায় সাসটেইন/মডিফাইড (এস আর, এম আর, এক্স আর) ট্যাবলেট দেয়া যায়। তবে লাগলে প্রতি খাওয়ার আগে রাপিড অ্যাক্টিং ইনসুলিন দিতে হবে। মিক্স ইনসুলিন বা কোফর মুলেশন /রাপিড অ্যাক্টিং কম্বিনেশন দিলে ডোজ ঠিক করতে বেশি করে পরীক্ষা দরকার হয়। এ ক্ষেত্রে প্রথম রাতে মিক্স ইনসুলিন দিয়ে রাতে হাইপো হয় না বা কম হয় এমন ট্যাবলেট দেয়া যেতে পারে।
লেখক : মেডিসিন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ, বারডেম হাসপাতাল, ঢাকা
