হার্ড ইমিউনিটি আশঙ্কার নীতি

 ডা. শাহরিয়ার রোজেন ও মুহম্মদ রহমান 
১১ জুলাই ২০২০, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

সাম্প্র্রতিক সময় বাংলাদেশে হার্ড ইমিউনিটি নিয়ে বেশকিছু কথাবার্তা হচ্ছে। এর অধিকাংশই অত্যন্ত আশঙ্কাজনক, সেসঙ্গে হতাশাজনক তো বটেই।

হার্ড ইমিউনিটি’র পক্ষে যে যুক্তিগুলো সেগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, এখানে অর্থনীতি, সমাজব্যবস্থা, মানুষের বিহেভিওরিয়াল ব্যাপারগুলো আলোচিত হলেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটিই কিন্তু একেবারে পুরোপুরি উপেক্ষিত হয়েছে। সেটি হচ্ছে- ‘জীবন’। এটি কেবল হতাশার কথা- তাই নয়, এর চেয়ে বড় উদ্বেগের আর কিছু এ মুহূর্তে হতে পারে না।

আমাদের দেশে মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি বলেই কি তাদের জীবন এত মূল্যহীন?

হার্ড ইমিউনিটি’র কার্যকারিতার ব্যাখ্যায় যাওয়ার আগে এটি কীভাবে কাজ করে- তা সংক্ষেপে বলা যাক। কোনো একটি অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ যখন একটি ভাইরাসের প্রতি ইমিউন বা প্রতিরোধী হয়ে ওঠে তখন বলা যায়, ওই বিশেষ জনপদটি সামষ্টিকভাবে ইমিউনিটি বা প্রতিরোধ ব্যবস্থা অর্জন করেছে। তখন কোনো একজন ব্যক্তি যদি আক্রান্ত হয় তবে সে যাদের সংস্পর্শে আসে তাদের অধিকাংশই যেহেতু আগে থেকে ইমিউন তাই রোগটি আর খুব বেশি মানুষকে সংক্রমণ করতে পারে না।

সাধারণত একটি দেশের ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ মানুষ যখন সংক্রমিত হয়ে যায় তখন দেশটি Herd Immunity-তে পৌঁছায়। তবে এ সংখ্যাটি একেবারে সম্পূর্ণ সত্য নয়। কোন মহামারী কতটা সংক্রামক তার ওপর নির্ভর করে এ সংখ্যাটিও কম-বেশি করতে পারে।

হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করতে হলে আমাদের ১৮ কোটি জনগোষ্ঠীর শতকরা ৬০ থেকে ৬৫ ভাগকে (অথবা আরও বেশি) করোনায় আক্রান্ত হতে হবে- তাই নয়, যারা বেঁচে থাকবে তাদের পুরোপুরি করোনাপ্রতিরোধীও হয়ে উঠতে হবে। ব্যাপারটি একইসঙ্গে ফ্যান্টাসি এবং হরর-এর সংমিশ্রণ।

ফ্যান্টাসি এ কারণে যে, আমাদের কাছে এখনও কোনো ধরনের তথ্য-প্রমাণ নেই যেটি দাবি করে, একই মানুষ একাধিকবার করোনায় আক্রান্ত হতে পারে না বরং একাধিকবার আক্রান্ত হওয়ার খবর আমরা দেখেছি এবং সেটি কেবল বৃদ্ধ-রুগ্ন মানুষের ক্ষেত্রে নয়- একেবারে সুঠাম কমবয়সী মানুষের ক্ষেত্রে ঘটেছে।

অন্যদিকে হরর বা ভয়াবহ এ কারণে যে, আমাদের ১৮ কোটি মানুষের ৬০ থেকে ৬৫ ভাগ মানুষ বলতে কিন্তু বোঝায় একটি অবিশ্বাস্য ধরনের বড় সংখ্যা। যদি করোনা আক্রান্ত রোগীর শতকরা ৫ ভাগও হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় এবং শতকরা ১ ভাগ মৃত্যুবরণ করে তবে সেই সংখ্যা কত ভয়াবহ হবে- সেটি আমরা সবাই বুঝতে পারছি। আমাদের দেশের হাসপাতালগুলোর ধারণ ক্ষমতার কথা চিন্তা করলে ভয়াবহতা আরও অনেকগুণ বেড়ে যায়।

ব্রিটেন প্রথমদিকে হার্ড ইমিউনিটি’র এ বিপজ্জনক কথা ভেবেছিল। তবে বিজ্ঞানী ফার্গুসনের মডেলে তাদের প্রায় ৫ লাখ মানুষের মৃত্যুর প্রেডিকশন দেখে তাদের টনক নড়ে ওঠে এবং তারা এ ভয়ঙ্কর চিন্তা থেকে সরে আসে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রোগতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ ডা. মারিয়া ভ্যান কারকোভ তাই সরকারগুলোকে বারবার সাবধান করছেন অপেক্ষা করার জন্য। একটি কার্যকরী ওষুধ কিংবা ভ্যাকসিন না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা ছাড়া আমাদের এখনও দ্বিতীয় কিছু ভাবার সময় আসেনি।

হার্ড ইমিউনিটি’র জন্য সুইডেনের উদাহরণ অনেকে ব্যবহার করেন। সুইডেন অনেক স্বল্প জনসংখ্যার একটি দেশ বলে পারসন-টু-পারসন সংক্রমণ হওয়ার ঝুঁকি কম ছিল। তাছাড়া সে দেশের জনগণ অনেক সচেতন কিন্তু তারাও সাম্প্রতিক সময়ে পার্শিয়াল লকডাউনের কথা ভাবছে। সুইডেনে যেখানে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে মাত্র ২৫ জন মানুষ বসবাস করে সেখানে বাংলাদেশের প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১১০০ জনেরও অধিক মানুষ বাস করে অর্থাৎ স্যাটায়ারিকভাবে বলা যায়, বাংলাদেশের জনবসতির ঘনত্বের সঙ্গে তুলনা করলে সুইডেন সব সময়ই আইসোলেশনে থাকে। তাই কোনোভাবেই এ দু’দেশের তুলনা বাস্তব সম্মত নয়।

এতদিন দেশ lockdown করার পর এখন হার্ড ইমিউনিটির কথা বললে জনগণ বিভ্রান্ত হবে। পাশাপাশি যারা এতদিন সোশ্যাল ডিসটেন্সের নিয়ম মেনে চলছিল তারাও নিয়মের প্রতি উদাসীন হবে। কাজেই হার্ড ইমিউনিটি’র কথা না বলে আমাদের উচিত হবে-

* দেশজুড়ে টেস্ট করার পরিমাণ আরও বাড়ানো। বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১৪০০০-১৫০০০ টেস্ট করা হচ্ছে যা যথেষ্ট নয়।

* টেস্ট করে পাওয়া আক্রান্ত ব্যক্তিদের ট্রেসিং করতে হবে। অর্থাৎ আক্রান্ত ব্যক্তির টেস্ট পজিটিভ আসার আগে তার দ্বারা যারা সংক্রমিত হতে পারে তাদের চিহ্নিত করা। এভাবে ট্রেসিং করে ঝুঁকির মাঝে থাকা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তাদের জানাতে হবে এবং কোয়ারেন্টিন করতে হবে।

* গার্মেন্টস, শপিংমলসহ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করতে হবে, যাতে তারা কর্মক্ষেত্রে সব কর্মচারীর জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, প্রতিষ্ঠানগুলোতে ডিসইনফেকট্যান্ট ব্যবহার, প্রবেশের আগে তাপমাত্রা পরীক্ষা করা, স্যানিটাইজার সরবরাহ এবং ব্যবহার করা, কেউ অসুস্থ হলে নোটিফাই করা বাধ্যতামূলক করা, দু’জন কর্মচারীর মাঝে কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখা এবং করোনা প্রতিরোধে বেসিক ট্রেইনিংয়ের ব্যবস্থা করা। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো এসব নীতি মেনে না চললে জরিমানাসহ শক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।

* জনগণের মাঝে সোশ্যাল ডিসটেন্সিং এবং হাইজিন-এর (হাত ধোয়া, স্যানিটাইজার ব্যবহার করা, মাস্ক ব্যবহার করা) চর্চা করার জন্য জনসচেতনতা বাড়ানোর জন্য সোশ্যাল ক্যাম্পেইনের ব্যবস্থা করতে হবে তবে তাও হতে হবে নিয়ম মেনে। আমরা অনেক দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের দেখেছি, ৫০ ব্যাগ রিলিফ দিতে শতাধিক মানুষের বহর নিয়ে শোডাউন করতে। এতে জনস্বাস্থ্য আরও ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।

* অসুস্থদের চিকিৎসাসেবা অব্যাহত রাখার জন্য চিকিৎসকদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে।

পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশই এখন করোনার সঙ্গে লড়ছে, যার যা কিছু আছে সবটুকু সম্বল নিয়ে। বাংলাদেশের লড়াই চলছে তবে এখনই কোনোভাবেই হাল ছাড়ার সময় নয়।

লেখক : জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও সিনিয়র পলিসি লিড, আল-বার্টা, কানাডা এবং প্রকৌশলী ও পিএইচডি গবেষক

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন