Logo
Logo
×

সুস্থ থাকুন

জ্বর ও অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ে কিছু কথা

Icon

ডা. রফিক আহমেদ

প্রকাশ: ০৯ অক্টোবর ২০২০, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

জ্বর কোনো রোগ নয়- অনেক রোগের কারণে জ্বর হতে পারে। জ্বর কেবলই রোগের উপসর্গ মাত্র। এযাবৎকাল ৭২টি রোগের কারণে জ্বর হতে পারে বলে জানা গেছে- অজানা কারণের সংখ্যা জানা যায়নি।

জ্বর, সর্দি, ঠাণ্ডা-কাশি, হলেই অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হবে কি-না, সে বিষয়ে চিকিৎসকই সিদ্ধান্ত নেবেন। সাধারণত ভাইরাসজনিত কারণে ফ্লুর মতো হয় যা ৩-৫ দিনে চলে যায়, এখানে অ্যান্টিবায়োটিকের দরকার নেই। শুধু প্যারাসিটামল এবং অ্যান্টি হিস্টামিনই যথেষ্ট।

অ্যান্টিবায়োটিক হল এমন একটি উপাদান যা ব্যাকটেরিয়া বা ফাঙ্গাস থেকে সংগ্রহ করে অন্য ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া বা ফাঙ্গাসকে ধ্বংস করার জন্য বা তার বংশবৃদ্ধি রোধ করার জন্য ব্যবহার করা হয়।

ব্যাকটেরিয়া নিজে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে পারে না বিধায় নিজেদের অঞ্চল থেকেই তাদের খাদ্য সংগ্রহ করার কারণে তারা একই অঞ্চলে থাকা অন্য ব্যাকটেরিয়াগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে। এক অঞ্চলের ব্যাকটেরিয়া আরেক ব্যাকটেরিয়াকে মারার জন্য অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করে। এ অ্যান্টিবায়োটিক-ই আমরা ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে বিশ্বব্যাপী ‘বিশ্ব অ্যান্টিবায়োটিক সচেতনতা সপ্তাহ’ (১৬-২২ নভেম্বর) পালন করা হয়। এর উদ্দেশ্য হল মানুষকে এটি মনে করিয়ে দেয়া যে, অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে, তাই এটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়া দরকার।

আমাদের দেশে অ্যান্টিবায়োটিক যত্রতত্র মোয়া-মুড়কির মতো বিক্রয় করা হয়। রোগীরাও অপরিমিত, অপর্যাপ্ত অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করেন। এটি যে কত ভয়ংকর এবং ক্ষতিকর যা অল্প পরিসরে আলোচনা করা সম্ভব নয়। কেবল ব্যাকটেরিয়া নির্মূল করতেই অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। অনিয়মিত, অপর্যাপ্ত, অপরিমিত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করার ফলে ড্রাগ রেজিস্টেন্স হয়। অর্থাৎ ব্যাকটেরিয়া অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ক্ষমতা অর্জন করে; যা আমাদের অজ্ঞতার কারণেই ঘটছে।

প্রতিটি অ্যান্টিবায়োটিকের গায়ে স্পষ্টভাবে লেখা রয়েছে- রেজিস্ট্রার চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া সেবন করা যাবে না। বিক্রয় ও বিতরণ করা নিষেধ।

তথাকথিত সর্বরোগের চিকিৎসকরা তাদের ইচ্ছামতো অ্যান্টিবায়োটিক লিখছেন, বিক্রয় করা হচ্ছে, রোগীরাও সেবন করছেন।

অ্যান্টিবায়োটিকের সেবন বিধি: নির্দিষ্ট মাত্রার নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর নির্দিষ্ট দিন পর্যন্ত সেবন করতে হবে। মেডিকেল সায়েন্সে অ্যান্টিবায়োটিকের (ব্যবহার) সেবন বিধিতে বলা হয়েছে ৫-৭ দিন, ১০ দিন পর্যন্ত দেয়া যাবে। তবে ৩ দিনের কম নয়। আবার এমন কিছু রোগও আছে যেমন- যক্ষ্মার ক্ষেত্রে ৪ পদের অ্যান্টিবায়োটিক ২ মাস, ২ পদের অ্যান্টিবায়োটিক আরও ৪ মাস অর্থাৎ ৬ মাস সেবন করতে দেয়া হয়। ফুসফুসে ফোড়ার চিকিৎসায় ২ বা ৩ পদের অ্যান্টিবায়োটিক ৪-৬ সপ্তাহ দেয়া হয়।

টাইফয়েড, প্যারাটাইফয়েড, মেনিনজাইটিস, সেপটিসেমিয়া ইত্যাদি রোগের চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক দ্বিগুণ মাত্রায় দেয়া হয় দীর্ঘদিন পর্যন্ত। রোগের উপসর্গ চলে যাওয়ার পর আরও ৩ দিন উক্ত অ্যান্টিবায়োটিক চালিয়ে যেতে হবে।

বিদেশে নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ ওভার দা কাউন্টার যেমন- ঠাণ্ডা, সর্দি কাশি, জ্বর, মাথাধরা, মাথাব্যথা, ভিটামিন, ক্যালসিয়াম ইত্যাদি বিক্রি করতে পারেন; কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করতে পারবেন- কেবল রেজিস্ট্রার চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী।

মানবদেহে হাজার হাজার কোটি কোটি অনুজীব (ব্যাকটেরিয়া) বিশেষ করে পেটের ভেতর বসবাস করছে- যাদের খালি চোখে দেখা যায় না। ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ফাঙ্গাস ছাড়াও পরজীবী (কৃমি) পেটের মধ্যে বাস করে, আমাদের শরীর থেকেই তাদের খাবার সংগ্রহ করে। কিছু ব্যাকটেরিয়া আমাদের শরীরের জন্য উপকারী, তবে অধিকাংশই ক্ষতিকর।

আমাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা রয়েছে বিধায় সব ব্যাকটেরিয়া সব সময় রোগ সৃষ্টি করতে পারে না। কিছু কিছু রোগ যেমন- ডায়াবেটিস মেলাইটাস, ক্যান্সার, ক্যান্সার চিকিৎসার ওষুধ, স্টেরয়েড ইত্যাদি দীর্ঘদিন ব্যবহার করা হলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়।

অ্যান্টিবায়োটিক কেবল ব্যাকটেরিয়া নির্মূলের জন্য ব্যবহার করা হয়। যখন অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া নির্মূলে ব্যর্থ হয় তখন উক্ত ব্যাকটেরিয়াকে রেজিস্টেন্স ব্যাকটেরিয়া বলা হয়। এ রেজিস্টেন্স ব্যাকটেরিয়া হয়তো অন্য ওষুধে কাজ করবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, কোনো ব্যাকটেরিয়াকে কোনো ওষুধ দিয়ে নির্মূল করা যাবে- সেই সিদ্ধান্ত নেয়াটাই কঠিন। কালচার সেন্সেটিভিটি টেস্টই বলে দিতে পারে- কোন ওষুধ কাজ করবে কোনটি করবে না। এ পরীক্ষা ব্যয় বহুল এবং সবার পক্ষে করা সম্ভব নয়।

উন্নত দেশগুলোতে রোগ নির্ণয় না করে অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হয় না।

আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে রোগ নির্ণয় বা জীবাণু চিহ্নিত করে ওষুধ প্রয়োগ করা এখনও বিভিন্ন কারণে সম্ভব হচ্ছে না। অ্যান্টিবায়োটিকের সঠিক ব্যবহার করার জন্য এখানে চিকিৎসকদেরও বড় ভূমিকা পালন করা প্রয়োজন।

চিকিৎসকদের উচিত হচ্ছে, ওষুধ বিশেষ করে অ্যান্টিবায়োটিক দেয়ার পর রোগীকে আলোচনা ও সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে ব্যক্তিগত সামাজিক বা মনস্তাত্ত্বিক সমাধান পেশাদার আচরণের মাধ্যমে করণীয় নির্দেশনা প্রদান করা। কেবল তবেই রেজিস্টেন্স ব্যাকটেরিয়া কমবে বলে অভিজ্ঞজনরা মনে করেন।

গবেষকদের মতে চলতি বছরের মধ্যে আরও ১০টি নতুন অ্যান্টিবায়োটিক বাজারে আসবে। যেভাবে ব্যাকটেরিয়া রেজিস্টেন্স হচ্ছে, সে তুলনায় ওষুধ তৈরি হচ্ছে না। সারা বিশ্বে কী পরিমাণ ব্যাকটেরিয়া রেজিস্টেন্স হচ্ছে সে বিষয়ে ধারণা করা যাচ্ছে না। এক কথায় পরিস্থিতি মারাত্মক ও ভয়াবহ।

নিউ দিল্লিতে এক গবেষণা কার্যক্রম থেকে প্রকাশ ৭০-৮০ শতাংশ ডায়রিয়ার কারণ ভাইরাস। এখানে অ্যান্টিবায়োটিকের কোনো প্রয়োজন ছিল না। তারপরও ৪০ শতাংশ রোগীদের অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা করা হয়েছে। আবার কোথাও কোথাও ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়েছে।

দিন যত যাচ্ছে, অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যক্ষমতা ততই কমে যাচ্ছে। বছরে ৭ লাখ থেকে কয়েক মিলিয়ন (১০ লাখ = ১ মিলিয়ন) রোগীর অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্সজনিত কারণে অকাল মৃত্যু হচ্ছে। যার মূলে এ ওষুধের অপব্যবহারকেই দায়ী করা হচ্ছে।

নেদারল্যান্ডস, জার্মানি ও সুইডেনে তুলনামূলকভাবে কম অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হচ্ছে। গ্রিস, ফ্রান্স এবং বেলজিয়ামে সে তুলনায় বেশি অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি অ্যান্টিবায়োটিক অপব্যবহার করা হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে। যার দায়ভার বহন করতে হবে পরবর্তী প্রজন্মকে।

রাশিয়ার চিকিৎসা শাস্ত্রে ৫টি Early শব্দের বহুল প্রচলন আছে। Early Suspicion, Early Attention, Early Diagnosis, Early Treatment and management এবং Early Rehabilitation. একজন অভিজ্ঞ মা, অভিজ্ঞ পাড়া প্রতিবেশী এবং কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীরাই এটি করতে পারেন।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ, ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম