স্ট্রোক রোগীদের কর্মক্ষম ও নিরাপদ জীবনের জন্য
ডা. মো. শফিকুল ইসলাম
প্রকাশ: ২৭ নভেম্বর ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
উন্নত জীবন মানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শারীরিক মানসিক সমস্যা তথা রোগের ধরনেও পরিবর্তন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। কয়েক যুগ আগেও কলেরায় গ্রামের পর গ্রাম মানুষ মারা যেত শুধু স্যালাইন পানি খাওয়ানো ও সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার জ্ঞানের অভাবে।
গুটিবসন্ত পৃথিবীজুড়ে যে ভয়াল থাবা ছিল একবিংশ শতাব্দীর শিশুরা হয়তো তা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারবে না। মধ্যযুগের প্লেগ যে ব্লাক ডেথ হয়ে গিয়েছিল চার্চের কালোবিড়াল নিধনের মতো ছোট একটা সিদ্ধান্তে তা হয়তো অনেকেরই অজানা।
২০২০ সালে একজন বাংলাদেশির গড় আয়ু ৭২.৮ বছর যা পৃথিবীর সার্বিক গড় আয়ুর চেয়ে ০.৮ বেশি! কিন্তু আমাদের চারপাশে ষাটোর্ধ্ব ক’জনকে আমরা স্বাভাবিক জীবন উপভোগ করতে দেখি- রোগবালাই কিংবা শারীরিক অক্ষমতা ছাড়া?
সর্বোচ্চ গড় আয়ুর দেশ হংকং কিংবা জাপানে ৮৫ বছরেরও বেশি বয়স্ক মানুষকে আপনি হরহামেশাই দৌড়াতে দেখতে পারেন। ৮৪ বছর বয়স্ক ভারতীয় নিউরোস্পাইন সার্জন প্রফেসর রামানি এখনও অপারেশন করার পাশাপাশি বছরে একডজন ম্যারাথন দৌড়ান। আমরা কি তাদের জুতায় নিজেদের কল্পনা করতে পারি?
একবিংশ শতাব্দীতে এ করোনার বৈশ্বিক মহামারীর মধ্যেও মৃত্যুর প্রধান কারণ হার্ট অ্যাটাক, আর দ্বিতীয় হল ব্রেইন অ্যাটাক/স্ট্রোক। যা আবার তাৎক্ষণিক চিকিৎসার অভাবে দীর্ঘমেয়াদি পঙ্গুত্বের বিশ্বব্যাপী প্রধান কারণ! উচ্চরক্তচাপ কিংবা ডায়াবেটিসে ভুগছেন না চল্লিশোর্ধ্ব কেউ এমন পরিবার বাংলাদেশে আছে কিনা খুঁজে বের করতে পার্বত্য জেলাগুলোতে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই! অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, ধূমপান, উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ৫৫ বছরের বেশি বয়স্কদের ব্রেন স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি।
স্ট্রোক মস্তিষ্কের রক্তনালির মারাত্মক রোগ। এ রোগে আক্রান্ত হওয়া মানেই মৃত্যুবরণ করা কিংবা আমৃত্যু পঙ্গুত্ববরণ করে পরিবার ও সমাজের বোঝা হয়ে বেঁচে থাকা- এটা। আমরা সবাই মেনে নিয়েছি নিয়তি হিসেবে। চলুন একটু বোঝার চেষ্টা করি এ জীবনসংহারী স্ট্রোক রোগটি আসলে কী?
মস্তিষ্কের রক্তনালি বাধাপ্রাপ্ত হলে কিংবা ছিঁড়ে রক্তক্ষরণ হলে স্নায়ুকোষে রক্ত চলাচল ব্যাহত হয়। এটিই স্ট্রোক বা ব্রেইন অ্যাটাক! রক্তনালিতে চর্বি বা থ্রম্বাস জমে সরু হয়ে যে স্ট্রোক হয় সেটি ইসকেমিক স্ট্রোক। আর রক্তনালি ফেটে রক্তক্ষরণ হলে সেটাকে হেমোরেজিক স্ট্রোক বলে। দ্বিতীয়টির মৃত্যু ঝুঁকি বেশি হলেও আমেরিকান স্ট্রোক অ্যাসোসিয়েশনের জরিপ অনুযায়ী, ৮৭ ভাগ স্ট্রোকই ইসকেমিক ধরনের হয়ে থাকে।
এছাড়া ট্রান্সিমেন্ট ইসকেমিক স্ট্রোক (TIA) বা ওয়ার্নিং স্ট্রোক নামে কিছুক্ষণ বা ২৪ ঘণ্টার কম সময়ের জন্য রোগী স্ট্রোকের মতো উপসর্গে ভুগে যেটা মাইল্ড স্ট্রোক নামে জনপ্রিয়। যথাযথ চিকিৎসা না নিলে এদের ১০ জনে ১ জন ৩ মাসের মধ্যে মেজর স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়।
হার্ট অ্যাটাক বা হৃদরোগ মৃত্যুর প্রধান কারণ হলেও স্ট্রোকের মৃত্যুহার রোগ হিসেবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এবং সামগ্রিক জীবনমান ও আর্থ সামাজিক ক্ষতি অপরিমেয়। ওয়ার্ল্ড স্ট্রোক অর্গানাইজেশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী- প্রতি ১ মিনিটে ১০ জন মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। তাদের ২০ শতাংশের বয়স ৪০ বছরের নিচে। সবচেয়ে ছোট স্ট্রোক আক্রান্ত বাচ্চার বয়স ২ বছর! সম্প্রতি জরিপে প্রমাণিত যে, প্রতি ৪ জনের মধ্যে ১ জন জীবদ্দশায় স্ট্রোকে আক্রান্ত হবেন। (তথ্য সূত্র : Worldometer, WHO & WSO)। আপনিই সেই একজন নন তো?
করোনা মহামারীতে আমরা সবাই আতঙ্কিত। বিশ্বজুড়ে করোনা তাণ্ডবে এ পর্যন্ত ৫৬.২৫ মিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত হলেও মারা গেছে ১.৩ মিলিয়ন যা শতকরা ২ ভাগেরও কম। অন্যদিকে স্ট্রোকে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৩০ শতাংশ তৎক্ষণাৎ মারা যান ও বাকিদের মধ্যে ৩০-৪০ ভাগ আজীবনের জন্য পঙ্গুত্ববরণ করেন। তাই করোনা ও অন্যান্য সংক্রামক মহামারীগুলো সম্বন্ধে জানার পাশাপাশি নীরব ঘাতক ক্রনিক নন কমিউনিকেবল রোগব্যাধিগুলো যেমন স্ট্রোক, উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার ইত্যাদি সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা অতীব জরুরি।
লেখক : স্ট্রোক বিশেষজ্ঞ ও এন্ডোভাস্কুলার নিউরো সার্জন, সহযোগী অধ্যাপক, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
