স্ট্রোক রোগীদের নিরাপদ ও কর্মক্ষম জীবনের জন্য
পর্ব-২
ডা. মো. শফিকুল ইসলাম
প্রকাশ: ০৪ ডিসেম্বর ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ব্রেন স্ট্রোকের ব্যাপ্তি ও ভয়াবহতা সম্পর্কে আমরা গত পর্বে জেনেছি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ৯০ শতাংশ স্ট্রোক প্রতিরোধ করা সম্ভব স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যাভ্যাস ও নিয়মমাফিক জীবনযাপন করলে।
আশার আলো হল, দ্রুত রোগ নির্ণয় করতে পারলে ৭০ শতাংশের বেশি রোগী এর মারাত্মক ছোবল থেকে রেহাই পেতে পারেন।
বাংলাদেশেই এখন স্ট্রোকের সর্বাধুনিক চিকিৎসা দেয়া সম্ভব। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে গড়ে উঠেছে অত্যাধুনিক নিউরো ক্যাথল্যাব, ইন্টারভেনশন ও অপারেশন থিয়েটার যা কমপ্রিহেনসিভ অ্যাপ্রোচ বা হাইব্রিড পদ্ধতি নামে নিউরোসার্জনদের মধ্যে জনপ্রিয়।
স্ট্রোক হয়েছে বুঝবেন কীভাবে
যদি আচমকা হাত, পা বা শরীরের কোনো এক দিক অবশ লাগে বা চোখে দেখতে বা কথা বলতে অসুবিধা হয় কিংবা তীব্র মাথাব্যথা হয় ও হঠাৎ ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যান- এমন কোনো একটি লক্ষণ দেখার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত হাসপাতালে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন। এগুলো BE FAST (Balance, Eye, Face, Arm, Speech & Time) হিসেবে পরিচিত।
হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা : শ্বাসপ্রশ্বাস ও রক্ত সঞ্চালন নিশ্চিত করার পর দ্রুত মাথার সিটি স্ক্যান করে স্ট্রোকের ধরন নির্ণয় করবেন চিকিৎসকরা। রোগীর স্বজনদের উচিত এ সময় রোগীকে মুখে কিছু না খাওয়ানোর চেষ্টা করা এবং এক দিকে কাত করে বালিশ ছাড়া মাথা নিচু করে শোয়াতে হবে। ওষুধ ও পথ্য নিশ্চিতকরণে প্রয়োজনে নাকে নল দিতে হতে পারে।
তাৎক্ষণিক চিকিৎসার সুবর্ণ সময়
সিটি স্ক্যানে ইসকেমিক স্ট্রোক নির্ণয় হলে এন্টিপ্লেটলেট ও এন্টিকোয়াগুলেন্ট ওষুধের পাশাপাশি সম্প্রতি ‘অ্যালটিপ্লেজ’ নামক থ্রোম্বোলাইটিক থেরাপি যা দ্রুত জমাট বাঁধা রক্ত গলিয়ে দেয়- প্রয়োগের মাধ্যমে সাড়ে চার ঘণ্টা পর্যন্ত মস্তিষ্কের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি বা প্যারালাইসিস রোধ করা সম্ভব। এটি স্ট্রোক চিকিৎসার গোল্ডেন আওয়ার বা সুবর্ণ ঘণ্টা নামে জনপ্রিয়। পরবর্তী সময়ে এমআরআই ইমেজের ওপর ভিত্তি করে ৬-১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত সময়ে এন্ডোভাস্কুলার নিউরোসার্জনরা না কেটে সরু নলের সহায়তায় জমাট বাঁধা রক্ত বা চর্বির দলা বের করে আনতে পারেন।
এছাড়াও গলায় অবস্থিত ক্যারোটিড ধমনি বেশি সংকুচিত হয়ে গেলে রিট্রাইভার মেশিনের সহায়তায় স্টেনটিং ও বেলুন এনজিওপ্লাস্টি করে মস্তিষ্কের রক্তসঞ্চালন পুনরায় ফিরিয়ে দিতে সক্ষম। উন্নত বিশ্বে প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত মেকানিক্যাল থ্রম্বেক্টমির চেষ্টা করা হয়- যা এখন ঢাকাতেই সম্ভব। খেয়াল রাখতে হবে টাইম ইজ ব্রেইন স্ট্রোকের পর প্রতি মিনিটে ২ মিলিয়ন স্নায়ু কোষ চিরতরে মারা যায়।
হেমরেজিক বা রক্তক্ষরণজনিত স্ট্রোক হলে থ্রোম্বোলাইটিক
ওষুধ প্রয়োগে আরও বিপত্তি হবে। রক্তক্ষরণের কারণ নির্ণয় করে- এন্ডোভাস্কুলার নিউরোসার্জনদের দক্ষ টিম এনিউরিজম (রক্তনালির ফোস্কা) ক্লিপিং ও কয়েলিং করতে পারেন। ক্ষেত্র বিশেষে শিশু ও কিশোরদের বিরল রক্তনালির জন্মগত ত্রুটিপূর্ণ গঠন দেখা দিলে তা স্ট্রোকের মতো উপসর্গ হিসেবে দেখা দেয়।
এসব জটিল ক্ষেত্রে একইসঙ্গে ক্যাথল্যাব এ এন্ডোভাস্কুলার অ্যাপ্রোচের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করে পরে মাথার খুলি হাইস্পিড ড্রিলের মাধ্যমে কেটে বিকৃত রক্তনালি সম্পূর্ণরূপে অপসারণ সম্ভব। নতুন এ দ্বৈত শল্যচিকিৎসা পদ্ধতিকে হাইব্রিড পদ্ধতি বলা হয়। বাংলাদেশে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগে এ সেবা সম্প্রতি চালু হয়েছে।
তাৎক্ষণিক চিকিৎসার প্রধান উদ্দেশ্য মৃত্যুঝুঁকি কমানোর পাশাপাশি কর্মক্ষমতা ফিরিয়ে আনা, প্যারালাইসিস প্রতিরোধ এবং পরবর্তী স্ট্রোকের ঝুঁকি হ্রাস করা। সময়মতো যথাযথ চিকিৎসা পেলে ৩০ শতাংশ রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে কর্মময় জীবনযাপনে ফিরে যেতে পারবেন। অনেকের স্ট্রোক-পরবর্তী পুনর্বাসন প্রোগ্রাম (Physiotherapy & Rehabilitation) পালন করতে হতে পারে।
লেখক : স্ট্রোক বিশেষজ্ঞ ও এন্ডোভাস্কুলার নিউরো সার্জন, সহযোগী অধ্যাপক, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
